ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৪ মে ২০২৫, ৩১ বৈশাখ ১৪৩২

অসহায় শিশুদের চোখে সমাজ

সাদিয়া সুলতানা রিমি

প্রকাশিত: ১৬:৪৩, ১৪ মে ২০২৫

অসহায় শিশুদের চোখে সমাজ

শিশুদের চোখে সমাজ মানে একটি স্বপ্নময় জগৎ, যেখানে তারা ভালোবাসা, নিরাপত্তা ও আনন্দের আশায় বুক বাঁধে। কিন্তু বাস্তবতা অনেক সময় ভিন্ন। বিশেষ করে অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য সমাজ একটি কঠিন বাস্তবতার নাম, যেখানে তাদের শৈশব কষ্ট, বঞ্চনা ও নির্যাতনের ছায়ায় ঢাকা পড়ে। এই প্রবন্ধে আমরা অসহায় শিশুদের দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজের বাস্তবতা, তাদের সমস্যা, কারণ ও সমাধান নিয়ে আলোচনা করব। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে অসংখ্য শিশু তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ আশ্রয় ও পুষ্টিকর খাদ্য থেকে বঞ্চিত হয়ে জীবনের শুরুতেই সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে। বিশ্বে প্রায় ১৬ কোটি ৮০ লাখ শিশু শ্রমে নিয়োজিত, যার মধ্যে প্রায় অর্ধেক ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিযুক্ত। বাংলাদেশে ৫-১৪ বছর বয়সি শিশুশ্রমিকের সংখ্যা মোট শিশু জনসংখ্যার ১৯ শতাংশ, ছেলে শিশুদের হার ২১.৯ শতাংশ এবং মেয়ে শিশুদের হার ১৬.১ শতাংশ।
অসহায় শিশুদের জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হলো শিশুশ্রম। দারিদ্র্য, শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব, এবং সামাজিক নিরাপত্তার ঘাটতি শিশুদের শ্রমে ঠেলে দেয়। তারা গৃহকর্ম, কারখানা, নির্মাণ, কৃষি, পরিবহন, হোটেল, দোকানসহ বিভিন্ন খাতে কঠোর পরিশ্রম করে। অনেক সময় তারা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। শিশুশ্রম শিশুদের শৈশব কেড়ে নেয়, তাদের শিক্ষা ও উন্নয়নের পথ রুদ্ধ করে। অসহায় শিশুরা অনেক সময় বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ পায় না। দারিদ্র্য ও পরিবারের চাহিদা মেটাতে তারা কাজ করতে বাধ্য হয়। ফলে তারা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ে, যা তাদের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। শিক্ষার অভাবে তারা দক্ষতা অর্জন করতে পারে না, ফলে ভবিষ্যতে ভালো কাজ পাওয়ার সম্ভাবনাও কমে যায়। অসহায় শিশুরা পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। তারা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করে এবং কাজ করে, যা তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অনেক সময় তারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়, কিন্তু সঠিক চিকিৎসা পায় না।
অসহায় শিশুদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল। তারা নির্যাতন, শোষণ ও সহিংসতার শিকার হয়, কিন্তু তাদের সাহায্য করার মতো ব্যবস্থা অনেক সময় অনুপস্থিত থাকে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নজরদারি ও সুরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী না হওয়ায় তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। অসহায় শিশুদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক সময় সহানুভূতিশীল নয়। তাদের সমস্যাগুলোকে গুরুত্ব না দিয়ে অনেক সময় অবহেলা করা হয়। তাদের শ্রমকে স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নেওয়া হয়, যা তাদের শোষণকে বৈধতা দেয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন না হলে অসহায় শিশুদের অবস্থার উন্নয়ন সম্ভব নয়।

সমস্যার কতিপয় কারণ

দারিদ্র্য : অসহায় শিশুদের সমস্যার মূল কারণ দারিদ্র্য। পরিবারের আয় কম হওয়ায় শিশুরা কাজ করতে বাধ্য হয়।
শিক্ষার অভাব : শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা ও সচেতনতার অভাবে শিশুরা বিদ্যালয়ে যেতে পারে না।
আইন প্রয়োগের দুর্বলতা: শিশুশ্রম ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে আইন থাকলেও তা সঠিকভাবে প্রয়োগ হয় না।
সামাজিক সচেতনতার অভাব: সমাজের অনেকেই শিশুশ্রম ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে সচেতন নয়।


সমাধান ও করণীয়
দারিদ্র্য দূরীকরণ: সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে দরিদ্র পরিবারের জন্য কর্মসংস্থান ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে।
শিক্ষা নিশ্চিতকরণ: সকল শিশুর জন্য বাধ্যতামূলক ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
আইন প্রয়োগ: শিশুশ্রম ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে বিদ্যমান আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি: গণমাধ্যম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ: অসহায় শিশুদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়, স্বাস্থ্যসেবা ও পরামর্শ সেবা নিশ্চিত করতে হবে।

অসহায় শিশুদের চোখে সমাজ একটি কঠিন বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। তাদের শৈশব কষ্ট, বঞ্চনা ও নির্যাতনের ছায়ায় ঢাকা পড়ে। এই অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতা ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শিশুরা আমাদের ভবিষ্যত; তাদের সুরক্ষা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করাই আমাদের দায়িত্ব।


 লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

প্যানেল

×