
জুলাই-আগস্টের সেই অভ্যুত্থানে জাতি প্রত্যক্ষ করেছে তরুণদের অদম্য সাহস, এক চিরন্তন শক্তির বিস্ফোরণ। ইতিহাস বলছে, যখনই জাতির ক্রান্তিকাল আসে, তখনই তরুণরা বুক চিতিয়ে দাঁড়ায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে। এবারের অভ্যুত্থান ছিল তারই এক জ্বলন্ত প্রমাণ। এক ভয়ংকর সশস্ত্র স্বৈরাচারী বাহিনীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে যেভাবে তরুণরা রাজপথে নেমে এসেছিল, তাতে গোটা জাতি নতুন করে ভরসা পেয়েছে যে, আমাদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ। কারণ, আমাদের তরুণ প্রজন্ম জেগে আছে। শুধু জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থান নয়, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের দীর্ঘ ১৬ বছরের অত্যাচারিত শাসনামলে বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠন সকল বাধা বিপত্তি মোকাবিলা করে গণতন্ত্রের জন্য মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করে গেছে। সেই লড়াইয়ে অগ্রভাগে ভূমিকা রেখেছে তরুণ সমাজের প্রতিনিধিরা।
তরুণদের শক্তিকে রাজনৈতিক সংগঠিত রূপ দিতে যে মহৎ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় বিএনপির তিন সহযোগী সংগঠন যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল দেশব্যাপী আয়োজন করেছিল এক অনন্য কর্মসূচি, যার মূল লক্ষ্য তরুণদের চিন্তা, স্বপ্ন ও নেতৃত্বকে একটি কাঠামোয় নিয়ে আসা।
এসব তরুণের সমাগম শুরু হয়েছে বীর চট্টলার মাটি থেকে যে মাটি ভিজে আছে ছাত্রদল নেতা ওয়াসিম আকরামের রক্তে, যিনি শহীদ হয়েছিলেন জুলাই অভ্যুত্থানে। চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক সম্মেলন ও সমাবেশ ছিল কেবল একটি আয়োজন নয়, বরং ছিল এক নীরব বিপ্লবের সূচনা। যে বিপ্লব তরুণদের অধিকার, স্বপ্ন ও নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার সনদ রচনা করছে।
গত শুক্রবার চট্টগ্রামের চট্টেশ্বরী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত ‘কর্মসংস্থান ও বহুমাত্রিক শিল্পায়ন নিয়ে তারুণ্যের ভাবনা’ শীর্ষক সেমিনার ছিল এক ব্যতিক্রমধর্মী চিন্তার মঞ্চ। এটি রাজনৈতিক গণ্ডির বাইরে গিয়ে এক ধরনের পলিসি প্ল্যাটফর্মে রূপ নিয়েছিল। যেখানে শিক্ষাবিদ, উদ্যোক্তা, অর্থনীতিবিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সমাজকর্মীরা একত্রিত হয়ে আলোচনা করেছেন ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের পথরেখা নিয়ে। এরকম নীতিনির্ভর ও বাস্তবসম্মত আলোচনা আমাদের রাজনীতিতে খুব কমই দেখা যায়।
এই সেমিনারেই স্পষ্ট হয়েছে তরুণদের কাছে এখন আর শুধু স্লোগান নয়, তারা চায় সমাধান; চায় ভিশন, চায় তাদের অংশগ্রহণে নির্মিত নতুন বাংলাদেশ। এই আয়োজন ছিল তারই উত্তর। তরুণদের মুখে মুখে ফিরেছে কর্মসংস্থানের বাস্তব চিত্র, শিক্ষা ব্যবস্থার গলদ, প্রযুক্তিনির্ভর ভবিষ্যতের কথা। তারা নিজেরাই প্রশ্ন তুলেছে, নিজেরাই উত্তর খুঁজেছে এটাই তো গণতন্ত্রের প্রাণ। এই আয়োজন এমন এক অভিনব আয়োজন যেখানে যারা আয়োজন করেছেন তারা বক্তব্য শুনেছেন। বিভিন্ন পর্যায়ের যারা বিজ্ঞজন আছেন, তারা কথা বলেছেন। সবার জ্ঞানভিত্তিক আলোচনায় মুখর হয়েছে মিলনায়তন। একটা রাজনৈতিক দলের আয়োজনে অরাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা হয়েছে। এটাই আসলে রাজনৈতিক বন্দোবস্তের অভিনব এক আলেখ্য উপাখ্যান।
পরদিন ঐতিহাসিক পলোগ্রাউন্ড মাঠে অনুষ্ঠিত হয় ‘তারুণ্যের অধিকার প্রতিষ্ঠার সমাবেশ, যা এক কথায় ছিল একটি জাগরণ। লাখো তরুণের উপস্থিতি সেই সমাবেশকে দিয়েছে এক আশ্চর্য রূপ। সেদিন বক্তৃতা ছিল না, ছিল অভিজ্ঞতা, ছিল স্বপ্ন, ছিল হৃদয়ের কথা। তরুণদের স্বরই এখন দেশের সব প্রান্তরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ২০২৩ সালের জুনে বিএনপির তরুণ সংগঠনগুলো ছয়টি বিভাগীয় শহরে আয়োজন করেছিল তারুণ্যের সমাবেশ। সেই সমাবেশের স্লোগান ছিল ‘তরুণ প্রজন্ম দেব ভোট, রাজপথে বিজয় হোক’। সমাবেশে চাকরি বঞ্চিত, গুম হওয়া নেতাকর্মীদের পরিবারের সদস্য, ভোট দিতে না পারা তরুণ-তরুণীসহ এই সরকারের আমলে চাকরিচ্যুতরা বক্তব্য রাখেন।
তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি যে ৩১ দফা রাষ্ট্র সংস্কার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে, সেখানে সবচেয়ে সুস্পষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তরুণদের ওপর। বলা হয়েছে, ‘যুব সমাজের ভিশন, চিন্তা ও আকাক্সক্ষাকে ধারণ করিয়া আধুনিক ও যুগোপযোগী যুব উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করা হইবে।’ এক বছরব্যাপী বা কর্মসংস্থান না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষিত বেকারদের বেকার ভাতা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি যেমন বাস্তব, তেমনি চাহিদা ভিত্তিক শিক্ষা, স্কিল ডেভেলপমেন্ট, আন্তর্জাতিক মানের সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো, গবেষণাভিত্তিক শিক্ষা নীতি- এসবই স্পষ্ট নীতিগত অঙ্গীকার।
বিএনপির ঘোষিত রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বিপুল তরুণ জনগোষ্ঠীকে সম্পদে পরিণত করতে ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ (Demographic Dividend) অর্জনের লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এর অংশ হিসেবে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে ‘চাহিদাভিত্তিক শিক্ষা’ (Demand based Education) এবং ‘জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা’ (Knowledge-based Education System) চালুর, যাতে করে শিক্ষার সঙ্গে শ্রমবাজারের বাস্তব সংযোগ স্থাপন করা যায়। পাশাপাশি স্কিল ডেভেলপমেন্ট (Skill Development), গবেষণা ও উদ্ভাবনে (Research and Innovation) বিনিয়োগ, শিক্ষা খাতে জিডিপির ৫% বরাদ্দ এবং অনলাইন উদ্যোক্তা ও ফ্রিল্যান্সারদের জন্য ‘পে-পাল’ (PayPal) চালুর প্রতিশ্রুতি রয়েছে, যা তরুণদের কর্মসংস্থান ও নেতৃত্ব বিকাশে এক গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি গড়ে তুলবে।
আজকের তরুণরা কেউ আর কষ্ট করে বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে না। বরং চায়- এই দেশেই যেন সে স্বপ্নের বাস্তবায়ন হয়। বিএনপির এই রাজনৈতিক প্যারাডাইম শিফট একটি মৌলিক পরিবর্তনের বার্তা দেয়। এটা আর কেবল পুরানো ধাঁচের রাজনীতি নয়; এটি অংশগ্রহণমুখী, ভিশন ভিত্তিক, তরুণ সমর্থিত এক নতুন রাজনীতির সূচনা।
চট্টগ্রামের এই আয়োজন শুধু একটি শহরের বিষয় নয়, এটি জাতীয় তরুণ রাজনীতির কেন্দ্রস্থলে উঠে এসেছে। এখান থেকেই যে জোয়ার উঠেছে, তা পেরিয়ে যাবে খুলনা, বগুড়া, ঢাকায়। শেষ হবে না, থামবেও না। এই তরুণদের জোয়ারে ভেসে যাবে সকল অন্যায়-অসংগতি। প্রতিষ্ঠিত হবে মানুষের অধিকার। পতপত করে উড়বে গণতন্ত্রের বিজয়পতাকা।
আজকের তরুণরা আর শুধু ভবিষ্যৎ নয়, তারা বর্তমানও। তাদের হাতে যে আগুন জ্বলছে তা দিয়ে জ্বলে উঠবে নতুন বাংলাদেশের আলোকবর্তিকা। চট্টগ্রাম থেকে যে প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে, তা কোনো কণ্ঠ নয়, তা ইতিহাসের ডাক এক নতুন রেনেসাঁর, এক নতুন বাংলাদেশ গড়ার!
লেখক : রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক
প্যানেল