ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৪ মে ২০২৫, ৩০ বৈশাখ ১৪৩২

ওয়ানডের আকাশে শঙ্কার কালো মেঘ

শাকিল আহমেদ মিরাজ

প্রকাশিত: ০০:৫৮, ১৪ মে ২০২৫

ওয়ানডের আকাশে শঙ্কার কালো মেঘ

ব্যর্থতা ভুলে প্রিয় ফরম্যাট ওয়ানডে ক্রিকেটে আবার এভাবে উল্লাস করতে চায় টিম বাংলাদেশ

এশিয়া কাপের ফাইনাল, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল, বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালÑ বাংলাদেশের ক্রিকেটে স্মরণীয় যত অর্জন তার পুরোটাই ওয়ানডে ফরম্যাটে। একটা সময় তো ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও পাকিস্তানের মতো সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে টপকে র‌্যাঙ্কিংয়ের ছয়ে উঠে গিয়েছিল টাইগাররা। বিশ্বের যে কোনো দল বাংলাদেশকে সমীহ করত, অনেক দল আতঙ্কে থাকত, সেখানে এমন পরিণতি মেনে নেওয়া কঠিন।

আইসিসি দলীয় র‌্যাঙ্কিংয়ে এক ধাপ পিছিয়ে ১০ নম্বরে নেমে গেছে নাজমুল হোসেন শান্তর দল। এর আগে ২০০৬ সালে ওয়ানডে র‌্যাঙ্কিংয়ে দশে ছিল বাংলাদেশ। ১৯ বছর পর এমন অধপতনে প্রশ্ন উঠছে বাংলাদেশ কি সরাসরি বিশ্বকাপে খেলতে পারবে? ২০২৭ সালে ওয়ানডে ফরম্যাটের ১৪তম বিশ্বকাপের আসর বসবে দক্ষিণ আফ্রিকা-জিম্বাবুয়ে ও নামিবিয়ায়। ১৪ দলের সেই আসরে স্বাগতিক হিসেবে সরাসরি সুযোগ পাবে দক্ষিণ আফ্রিকা ও জিম্বাবুয়ে।

এ ছাড়া বাছাই পর্ব ছাড়াই সরাসরি বিশ্বকাপের টিকিট পাবে র‌্যাঙ্কিংয়ের সেরা ৮ দল। আর বাকি ৪ দলকে বিশ্বকাপে জায়গা পেতে খেলতে হবে বাছাই পর্ব। স্বাগতিক হলেও আইসিসির পূর্ণ সদস্য না হওয়ায় নামিবিয়াকেও বাছাই পর্বে খেলতে হবে।
র‌্যাঙ্কিংয়ে দশম স্থানে নেমে যাওয়ায় বাংলাদেশের সরাসরি বিশ্বকাপে খেলা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। যদিও বিশ্বকাপে জায়গা নির্ধারিত হবে ২০২৭-এর ৩১ মার্চের র‌্যাঙ্কিং অনুযায়ী, কিন্তু যেভাবে বাংলাদেশের অবনতি হচ্ছে, তাতে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়তে বাধ্য। র‌্যাঙ্কিংয়ে উন্নতি না ঘটলে বাংলাদেশকে হয়তো বিশ্বকাপের টিকিট পেতে বাছাই পর্বে অংশ নিতে হবে। আগামী বিশ্বকাপের স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকা এই মুহূর্তে ষষ্ঠ স্থানে আছে।

আরেক স্বাগতিক জিম্বাবুয়ে বাংলাদেশের ঠিক পরেই। দক্ষিণ আফ্রিকা যদি সেরা দশের বাইরে চলে না যায় বা জিম্বাবুয়েও যদি সেরা দশে জায়গা করে নিতে না পারে, তবে নবম স্থানে থেকেও সরাসরি বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পাবে বাংলাদেশ। কিন্তু যদি জিম্বাবুয়েও সেরা দশে ঢুকে পড়ে তবে দশম স্থানে থেকেও বিশ্বকাপে সরাসরি সুযোগ পাবে টাইগাররা। উল্লেখ্য, দুই স্বাগতিক ও র‌্যাঙ্কিংয়ের সেরা আট দল বাদে বাকিরা খেলবে বাছাই পর্বে।

যেখানে আইসিসির পূর্ণ সদস্য দেশ আয়ারল্যান্ড ছাড়াও স্কটল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাষ্ট্র, ওমান, কানাডা, নেপাল, নামিবিয়ার মতো দলগুলোর বিপক্ষে খেলতে হতে পারে। বার্ষিক হালনাগাদ র‌্যাঙ্কিংয়ে ২০২৪ সালের মে মাস থেকে এখন পর্যন্ত হওয়া সব ম্যাচের ফলের গুরুত্ব ১০০ ভাগ ধরা হয়েছে। এর আগের দুই বছরের ম্যাচগুলোর ফলের গুরুত্ব কমে হয়েছে শতকরা ৫০ ভাগ। যার অর্থ সাম্প্রতিক যারা ভালো করেছে, তাদের পয়েন্ট বেশি বেড়েছে। আর যারা খারাপ করেছে, তারা বেশি পয়েন্ট হারিয়েছে। বাংলাদেশ ওয়ানডে র‌্যাঙ্কিং পড়ে গেছে সাম্প্রতিক বাজে ফলের কারণেই। 
গত এক বছরে ওয়ানডেতে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স যাচ্ছেতাই। এই সময়ে ৫০ ওভারের সংস্করণে আট ম্যাচ খেলে কেবল একটি জিততে পেরেছে তারা। গত ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তান ও দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে প্রথম দুই ম্যাচ হেরে গ্রুপ পর্ব থেকেই ছিটকে পড়ে তারা। এর আগে নভেম্বরে শারজাহতে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ২-১ ব্যবধানে হারে তিন ম্যাচের সিরিজ। ডিসেম্বরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে তিন ম্যাচের সিরিজে হয় হোয়াইটওয়াশড। ওয়ানডেতে ৪ রেটিং পয়েন্ট হারিয়েছে বাংলাদেশ।

৭৬ পয়েন্ট নিয়ে দশম স্থানে আছে তারা। আর গত এক বছরে ৯ ওয়ানডে খেলে ৬টিতে জেতা ওয়েস্ট ইন্ডিজের বেড়েছে ৫ রেটিং পয়েন্ট। ৮৩ পয়েন্ট নিয়ে তারা এখন নবম স্থানে। বাংলাদেশে নিজেদের ওয়ানডে ইতিহাসে দুইবার সর্বোচ্চ ছয় নম্বরে উঠেছিল, ২০১৭ ও ২০২২ সালে। ২০০৫ সালে কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর আগে বাংলাদেশ ছিল ওয়ানডেতে ১১ নম্বর দল। সে সময় কেনিয়াও ওপরে ছিল বাংলাদেশের। ২০০৫ সালের আগস্টে প্রথমবার কেনিয়াকে টপকে ১০ নম্বরে ওঠে বাংলাদেশ।

২০০৬ সালের অক্টোবরে জিম্বাবুয়েকেও টপকে নয়ে ওঠে বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশ ২০১৫ সালে বিশ্বকাপে ভালোর করার পর পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টানা তিনটি সিরিজ জিতে উঠে আসে ওয়ানডে র‌্যাঙ্কিংয়ের সাতে। দুই বছর পর ২০১৭ সালে মে মাসে বাংলাদেশ ওঠে ৬ নম্বরে। ওয়ানডে র‌্যাঙ্কিংয়ে যা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ অবস্থান। 
২০২২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে হারানোর পর আবারও ছয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ। এরপর সময়ের সঙ্গে শুধু অবনমনই হয়েছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে এই পতনের সরাসরি কারণ বিগত এক বছরের ওয়ানডে পারফরম্যান্স। ২০২৩ বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে জেতার অর ২৪ ওয়ানডে খেলে জিতেছে কেবল ছয়টি। আইসিসি টুর্নামেন্ট এবং দ্বিপক্ষীয় সিরিজে তাদের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স প্রমাণ করে যে দলটি তাদের এক সময়ের উচ্চাকাক্সক্ষা থেকে কতটা দূরে সরে গেছে।

তারা যে ছয়টি দ্বিপক্ষীয় সিরিজ খেলেছে, তার মধ্যে জিতেছে মাত্র একটি  (শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২-১ ব্যবধানে জয়)। বিশ্বকাপ এবং চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি অভিযান ছিল তো বিপর্যয়কর। হারের সঙ্গে হারের ধরনও ছিল পীড়াদায়ক। আসল সমস্যা আরও গভীরে দেশের ক্রিকেটের একেবারে ভিত্তিমূলে : ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ (ডিপিএল)। অধিকাংশ ক্রিকেট খেলুড়ে দেশে ঘরোয়া কাঠামো আন্তর্জাতিক সাফল্যের ভিত্তি তৈরি করে। বাংলাদেশের জন্য ডিপিএল এক সময় সেই ভিত্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ ছিল।

১৯৮০ থেকে ২০০০-এর দশকের শুরুতে ডিপিএল ছিল শ্রেষ্ঠত্বের আঁতুড়ঘর এবং এটি বাংলাদেশের সেরা কিছু খেলোয়াড় তৈরি করেছে। তবে আজ, ডিপিএল প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত। এই পতনের কারণ অনেক। টি২০ ক্রিকেটের উত্থান, আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের ক্রমবর্ধমান আকর্ষণ এবং ঘরোয়া ক্রিকেটের প্রতি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের ক্রমবর্ধমান উদাসীনতা এই সবই ভূমিকা রেখেছে। তবে সম্ভবত সবচেয়ে ক্ষতিকর দিকটি হলো বিষাক্ত ক্লাব রাজনীতি যা লীগটিকে শ্বাসরুদ্ধ করে ফেলেছে।

ক্রিকেটের মূল ফোকাস সরে গিয়েছে বোর্ডরুমের কৌশল এবং রাজনৈতিক লাভের দিকে। যা একসময় তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক লীগ ছিল, তা এখন অনুমেয় এবং বস্তাপচা হয়ে গেছে। ক্রমাগত অব্যবস্থাপনায় খেলোয়াড়দের হতাশ ও নিষ্পৃহ করে তুলেছে। 
ডিপিএলের এই পতন সরাসরি আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের দুর্দশার সঙ্গে যুক্ত। একসময়, ডিপিএল ছিল খেলোয়াড়দের নিজেদের প্রমাণ করার, নির্বাচকদের প্রতিভা চিহ্নিত করার এবং দেশের একটি প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্র তৈরির প্রধান প্ল্যাটফর্ম। এখন লড়াইয়ের ঝাঁজহীন ম্যাচের সংখ্যাই বেশি।

এছাড়া আর্থিক প্রণোদনা কমে যাওয়ার কারণে, ক্রিকেটারদের পরবর্তী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করার মতো কিছুই নেই এখানে। উদ্বেগজনকভাবে, এমনকি নির্বাচকরাও প্রতিভা অনুসন্ধানের জন্য ডিপিএল ম্যাচগুলো মাঠে গিয়ে দেখতে আগ্রহ বোধ করছেন না।

×