ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ১৮ আশ্বিন ১৪৩১

শিউলি ফোটার দিন

​​​​​​​মো. জোবায়ের আলী জুয়েল

প্রকাশিত: ২০:৩৬, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪

শিউলি ফোটার দিন

.

বর্ষা শেষে যখন বৃষ্টির মাত্রাটা একটু কমে আসে, আকাশে ঘন কালো মেঘের বদলে তুলার মতো সাদা মেঘদল ঘুরে বেড়ায়, ঝক ঝক আকাশের উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে, তখন আমরা বুঝতে পারি শরৎ এসেছে। শিশিরস্নাত উজ্জ্বল শারদ প্রভাতে ঝরা শেফালির মদির সুবাসে আকাশ বাতাস ভরপুর। তাই কবি বলেন-

আজি কী তোমার মধুর মুরতি

হেরিনু শারদ প্রভাতে।

হে মাত বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ

ঝলিছে অমল শোভাতে।

প্রকৃতির পালা বদলের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মনও বদলে যেতে থাকে। বর্ষার বৃষ্টিমুখর অনুজ্জ্বল দিনের পর শরতের মেঘের মতো আমাদের মনও যেন হাল্কা হয়ে যায়। শরতের দিনগুলোকে স্বপ্নের মতোই মনে হয়। চারপাশে অনেক স্বপ্ন ছড়িয়ে আছে। আমরা সে সব স্বপ্ন কুড়িয়ে নিয়ে নানা কিছু ভাবতে বসি। আমাদের ভাবনাগুলোকে সতেজ করে শরতের শুভ্রতা। কেন শরৎ সাদা বা শুভ্র? শরৎ এলেই যে কাশ আর শিউলি ফুল ফোটে, আর আকাশে ভেসে বেড়ায় পেঁজা তুলার মতো তুলতুলে সাদা মেঘ। শরতের আকাশে, শরতের নদীতে, শরতের ফুল সবই কেমন মায়াময়। শরতের এই শুভ্র রূপ পবিত্রতার প্রতীক। বিলের শাপলা, নদী তীরের কাশ ফুল, আঙিনার শিউলি, এরা সবাই কোমল পবিত্র। দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। যখন শিশিরের শব্দের মতো টুপ টাপ শিউলি ঝরে তখন শরতের গন্ধ পাই। কাশবনে দল বেঁধে আসে চড়ুই পাখিরা। এভাবে শুরু হয় শরতের যাত্রা।

শরতের এই স্নিগ্ধ শোভাকে আরও মোহময় করে মৌসুমের বিচিত্র ফুলেরা। নদী কিংবা জলার ধারে ফোটে কাশ-ফুল, ঘরের আঙিনায় ফোটে শিউলি-শেফালি, খাল-বিল-পুকুর ডোবায় থাকে অসংখ্য জলজ ফুল। আর শেষ রাতের মৃদু কুয়াশায় ঢেকে থাকা মায়াবী ফুলেরা যেন আরও রূপসী হয়ে ওঠে। শিশির ভেজা শিউলি, বাতাসে মৃদু দোল খাওয়া কাশবনের মঞ্জরি পদ্ম-শাপলা-শালুকে আচ্ছন্ন জলাভূমি শরতের চিরকালীন রূপ সত্যিই বিচিত্র রূপ নিয়ে শরৎ আমাদের চেতনায় ধরা দেয়।

আমাদের অন্য ঋতুগুলো অনেক ফুলের জন্য বিখ্যাত হলেও মাত্র কয়েকটি ফুল নিয়েই শরৎ গরবিনী। কাশ-শিউলির শোভা উপভোগ করতে হলে আমাদের শরতের কাছেই যেতে হবে। শরৎ মানেই এক ধরনের ভালো লাগা, এই সুখ বা আনন্দ একেবারেই আমাদের নিজস্ব।

শরৎ মানেই শিউলি ফোটার দিন। শিউলির মধু গন্ধ ভেসে বেড়ানোর দিন। শিউলির আরেক নাম শেফালি। শেফালি ফুলকলিরা মুখ তোলে সন্ধ্যায়। তাই শরতের রাত শিউলির গন্ধে ভরপুর। সূর্যের সঙ্গে এদের আড়ি, নিশি ভোরেই ঝরে পড়ে মাটিতে। শরতের শিউলি তলা শিশুদের খুবই প্রিয়। ফুল কুড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়লেও ফুল যেন শেষ হতে চায় না। এর পাপড়িরা বহুক্ষণ গন্ধ বিলায়, বোঁটার হলুদ রং টিকে থাকে বহুদিন। শিউলির মালা দিয়ে ঘর সাজানো যায়। আর শিউলির মালা খোঁপায়ও পরা যায়। প্রাচীনকালে এর বোঁটার রং পায়েস বা মিষ্টান্নে ব্যবহার করা হতো। হিন্দুদের পূজার উপকরণ হিসেবে এর কদর অনেক। ছাড়াও শিউলির আছে অনেক ঔষধি গুণ। কবিরাজরা গাছের বিভিন্ন অংশ ওষুুধ তৈরিতে কাজে লাগান।

শরতের সকালে একটু একটু শীত অনুভূত হয়। হেমন্ত পেরিয়ে শীত আসবে যেন তারই পদধ্বনি। কুয়াশার রহস্য জাল কাটিয়ে চন চনে রোদ আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে আকাশে, সবুজ শস্য খেতে ঝলমলে রোদ এসে মিষ্টি চুম্বন এঁকে দেয়। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ খুব চমৎকার ভাষায় শরতের রূপকল্প তুলে ধরেছেন তার গানে-

আজ ধানের খেতে রৌদ্র ছায়ায়

লুকোচুরির খেলা,

আকাশে আজ কে ভাসাল

সাদা মেঘের ভেলা।

শরৎ উৎসবের ঋতু। শরতের বহুমাত্রিক রূপের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য হয়ে আছে গ্রাম বাংলার হিন্দু সম্প্রদায়ের আবহমানকালের দুর্গাপূজা।

শরতের স্নিগ্ধ রূপ আমাদের সাহিত্যেও ঠাঁই করে নিয়েছে। শারদ সকালের অপূর্ব সৌন্দর্য নিয়ে লেখা হয়েছে বহু কবিতা, বহুগান, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের অনেক কবিতা গানে, জীবনানন্দ দাশের কবিতায় শরতের স্নিগ্ধ শোভা অপূর্ব সৌন্দর্যে চিত্র রূপময়তা পেয়েছে। আবহমান বাংলার চিরায়ত রূপে শরৎকালের স্নিগ্ধ সকাল জাগায় ভিন্ন ব্যঞ্জনা, যা অমলিন, অবিনশ্বর।

শরতের স্তব্ধতা ঘুমপাড়ানি গানের মতো শান্ত, মধুর। নদীতে পালতোলা নৌকা, আকাশে পালতোলা মেঘ। প্রকৃতিতে সাদা কাশফুলের মেলায় মনটা কেবল উদাস হয়ে যায়। যেন শরতের এক স্নিগ্ধ স্বপ্নের জগৎ।

শেষ লগ্নে শরৎ আবার কানে কানে বলে যায় আবার আসব এক বছর পরে-তোমাদের আঙ্গিনায় শিশির ভেজা শিউলি আর কাশ ফুলের বন্যা নিয়ে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা

[email protected]

 

 

×