ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৩ জুন ২০২৫, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

আসুন, গাছ লাগাই, উষ্ণতা কমাই

সোহেল রানা

প্রকাশিত: ১৯:০৭, ১ মে ২০২৪; আপডেট: ১৯:৪৩, ১ মে ২০২৪

আসুন, গাছ লাগাই, উষ্ণতা কমাই

গাছ। প্রতীকী ছবি

ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে পৃথিবী। দিনদিন তাপদাহ বাড়ছে বাংলাদেশেও। ছাড়িয়ে যাচ্ছে অতীতের সব রেকর্ড। গণমাধ্যমের খবরে আগে শুনেছি, মধপ্রাচের দেশগুলোতে ৪০ ডিগ্রির ওপরে তাপমাত্রা উঠে। এখন আমাদের দেশেই এই তাপমাত্রা বয়ে যাচ্ছে। তা থেকে বাঁচতে পরিকল্পিতভাবে গাছ লাগানোই মনে হয় উত্তম। এছাড়া, আর কী বিকল্প হতে পারে! নিজের এলাকাকে সজীব রাখতে গাছ লাগানোই সর্বোৎকৃষ্ট কাজ। আসুন, গাছ লাগাই, গাছের যত্ন নিই। অন্যকে বৃক্ষ রোপণ করতে উৎসাহিত করি। মূলত, গাছ লাগাতে হবে জাতির বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে।

তাপদাহে ঢাকা শহরের মানুষের জীবন নাভিশ্বাস। রাজধানীর সড়কগুলো দিয়ে হাঁটাই যাচ্ছে না। যশোরে সড়কের পিচ গলে গেছে। রাস্তার দুই ধারে গাছ থাকলে এমনটা হতো না নিশ্চয়ই। ঘর থেকে মানুষ বের হতে পারছেন না চুয়াডাঙ্গায়। অনেক জায়গায় হিট স্ট্রোক করে মারাও যাচ্ছে মানুষ। তাপদাহে জনজীবন অতিষ্ঠ মানিকগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা, নাটোর, দিনাজপুর ও রংপুরে। ভালো নেই নরসিংদীর মানুষও। গরমে মরে গেছে বাগেরহাটের পুকুরের মাছও। সারাদেশের চিত্র একই। অচিরেই কোন উদ্যোগ না নিলে এর ভয়াবহতা আর বাড়বে। আরও দুঃসহ হয়ে উঠবে জনজীবন।

একবার কল্পনা করুন তো, রমনা পার্ক, বোটানিক্যাল গার্ডেন, লাউয়াছড়া, সাতছড়ি উদ্যান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, নরসিংদী সরকারি কলেজে অনার্স ভবনের পেছনের রাস্তার কথাটি। এসব স্থানগুলো যেন সবুজের গালিচা। খারাপ মনটাও আপনা আপনি ভালো হয়ে যাবে-এই জায়গাগুলো দিয়ে হাঁটলে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। মন থাকবে প্রশান্ত। যেখানে গাছ থাকবে, সেখানের তাপমাত্রা স্বাভাবিকভাবে চার ডিগ্রি কম থাকে। 

আরব আমিরাত, সৌদি আরব, কুয়েত-সহ মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোতে গাছ লাগানোর ব্যাপক কর্মযজ্ঞ হাতে নিয়েছে। বালু মাটিতেই বিশেষ পদ্ধতিতে গাছ লাগানোর জন্য নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে দুবাই। মরুভূমির দেশগুলোতে এমনিতেই তাপমাত্রা বেশি থাকে। তারা চিন্তা করেছে, এখন থেকে তাপমাত্রাকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে না আসা যায় তাহলে ভবিষ্যতে অবস্থা আরও খারাপের দিকে ধাবিত হবে। ঢাকা শহর ও বিভাগীয় মহানগরীতে যে উড়ালসড়ক হয়েছে বা হচ্ছে, ইচ্ছে করলে কম শিকড় ছাড়ে এমন গাছ সড়কের দুই পাশে রোপণের পরিকল্পনা নেওয়া যেতে পারতো! নিলে সারাবিশ্বে মডেল হিসেবে দাঁড়িয়ে যেতো। তাহলে আমাদের দেশে সম্ভব নয় কেন? আমরা তো ছাদ বাগান করছি। সেখানে তো সব ধরনের গাছই জন্মে। এবং ফলও দেয়। আমাদের দেশের মাটি উর্বর। যে কোন উদ্যোগই সহজে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হতো। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? আমরা কেন যথাযথ উদ্যোগ নিচ্ছি না! 

মনে হয়, আমরা সবাই বড় বড় বাড়ি বানাতে চাই। সেখানে এসি লাগিয়ে গরম থেকে বাঁচতে চাই। ভাই, সবার তো এসি লাগানোর সামর্থ্য নেই। এসিও তো উষ্ঞতা বাড়াচ্ছে। বাড়ি বানানোর প্ল্যানে যদি গাছ লাগানের জোরালো নির্দেশনা থাকতো। তা যদি মনিটরিং করা হতো-তাহলে মন্দ হতো না। এসবের দেখভালের দায়িত্ব রাজউক, সিটি করপোরেশন কিংবা পৌরসভার হাতেই। প্রাকৃতিক পরিবেশ উন্নত হলে ভালো থাকবে নতুন প্রজন্ম। দেশের সবকটি সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ইচ্ছে করলে পারে শহরকে ছায়াময় করতে। এসি-ফ্যান দিয়ে গরম থেকে কয়দিন বাঁচা যাবে? এতে চাপ বাড়ছে বিদ্যুৎতের ওপর। শিশুদের হাতে গাছ তুলে দেন বৃক্ষপ্রেমিকরা। ছবি: ফলদ বাংলাদেশ।ধরে নিই, গাছ লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হলো, গাছ তো লাগালেই হবে না! তার যত্নও নিতে হবে? খরচ বেশি না। প্রয়োজন শুধু সদইচ্ছার। পাড়া-মহল্লার সামাজিক সংগঠনগুলোও গাছ লাগানোর উদ্যোগ নিতে পারে। গাছ লাগানোর ব্যাপারে জুমার দিন মসজিদের ইমামরাও বয়ান করতে পারেন! সকলের সম্মলিত উদ্যোগেই একটি দেশ ও সমাজকে সুন্দরভাবে সাজানো যায়। ভালো রাখা যায় সবাইকে।

আমার মনে আছে, ক্লাসে শিক্ষকরা বৃক্ষ রোপণের কথা বলতেন। হাট থেকে চারা কিনে আমাদের দিয়ে রোপণ করাতেন। এখন স্কুল-কলেজে এই চর্চাটা হয় কি-না জানা নেই। হয়ে থাকলে প্রশংসা পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন ওইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ ইচ্ছে করলে পারে তার প্রতিষ্ঠানকে বৃক্ষময় করে তুলতে। ছায়াময় করে তুলতে। পাখিদের আবাস্থল গড়ে তুলতে।তালবীজ রোপণ চলছে।বইয়ে পড়েছি, একটি দেশের মোট ভূমির ২৫ শতাংশ বৃক্ষ বা বন থাকা প্রয়োজন। আমাদের দেশে এই অনুপাতে বনভূমি আছে কী? গেল বছর দাবদাহে ব্রাক্ষণবাড়িয়া এলাকায় রেল লাইন বেঁকে গেছে। রেল লাইন সচল রাখতে রেল মন্ত্রণালয় গাছ লাগানোর কোন উদ্যোগ নিয়েছে কী? এমন দৃশ্য চোখে পড়লে জানাবেন। তবে তীব্র গরমে রেল মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে সকল আন্তঃনগর ট্রেন স্থান ভেদে ৪০ কি.মি. গতিতে ট্রেন চালানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। চালকরাও নাকি সেই নির্দেশনা মেনেই ট্রেন চালাচ্ছেন।

একটু সময় গল্পে গল্পে কাটাই। আশা করি, ভালো লাগবে। হৃদয়কেও ছুঁয়ে যেতে পারে। সমাজে মানুষ অনেকভাবেই অবদান রাখতে পারে! আমার সামর্থ্য থাকার পরও কেন আমি কোন ভূমিকা রাখছি না? মনে হবে, এখনই শুরু করা দরকার। মাইনুদ্দীন আমার বন্ধু, বড় ভাই। একই ক্যাম্পাসে পড়াশোনা। দেড় যুগেরও বেশি চেনাজানা। বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা। তিনি  কাজটি নাও করতে পারতেন। তারপরও বেশ কয়েক বছর ধরে নিজ উদ্যোগে করে যাচ্ছেন। নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার গ্রামে গ্রামে ঘুরে রোপণ করে যাচ্ছেন তালবীজ ও নারিকেল গাছ। নিজের পকেটের টাকা খরচ করে। কাজটি করছেন বিবেকের তাড়নায়। তাল পাকার মৌসুমে কাপাসিয়া-কালিগঞ্জের বিভিন্ন হাট থেকে পাকা তাল সংগ্রহ করেন তিনি। প্রক্রিয়াজাত করে তালের রসও প্রতিবেশিদের বিলিয়ে দেন। এই কাজে সহযোগিতা করেন তাঁর গ্রামের কয়েকজন যুবক। খুব নিভৃতে কাজটি করে যাচ্ছেন তিনি। তা নিয়ে ফেসবুকেও কোন স্ট্যাটাস দেননি। বাহবা পাওয়ার চেষ্টা করেননি। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের উড়াল পথে (নরসিংদী জেলা হাসপাতাল সংলগ্ন) যে গাছগুলো দেখেন, সব ওনাদের হাতে রোপিত। তিনি চিন্তা করেছেন উড়াল সড়কে গাড়ি চলাচলে অনেক সময় অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। প্রখর রোদে মহাসড়ক উতপ্ত হতে পারে। গাছ থাকলে তো কিছুটা হলেও প্রতিকার সম্ভব। তার ফলও এখন আমরা পাচ্ছি। উড়াল সড়কে উঠলেই হিম বাতাস শরীরে লাগে। সবুজে চোখে স্বস্তি আসে। রাতের সুনসান নীরবতায় শোনা যায়, পাখিদের কলরব।

কেন তালবীজ রোপণ করেন? তার সুন্দর একটা ব্যাখ্যাও দিলেন মাইনুদ্দীন। তাল গাছ শতবষর্ষী। ফল-কাঠ দুইটিই পাওয়া যায়। বজ্রপাত নিরোধী। রোপণের পর গরু ছাগল খায় না। নিজ গুণেই বড় হয় গাছ। যত্নও খুব বেশি নিতে হয় না। বছরে একবার ছেঁটে দিলেই চলে। মোট কথা হচ্ছে- বৃক্ষ পাখি-কীটপতঙ্গের আবাসস্থল। বাস্তুসংস্থানে ভারসাম্য রাখে। বৃক্ষ-পানি ছাড়া তো মানুষের জীবন হুমকি স্বরুপ। অতিমাত্রায় নগরায়ন ডেকে আনছে পরিবেশের বিপদ। বড় বড় কোম্পানিগুলো অট্টালিকা করছে, শিল্পকারখানা বানাচ্ছে, পরিবেশ রক্ষায় কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন তারা? এই দায় প্রকৌশলীরাও এড়াতে পারবেন কী!বৃক্ষরোপণের জন্য সহযোগিতা করছেন ফলদ বাংলাদেশের এক কর্মী।বাংলা‌দেশ ব‌্যাংকের সহকারী প‌রিচালক জু‌বেল আল মনসুর। আমার বন্ধু শামীম মৃধা। সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক। দুই জনে মিলে শিবপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে গত বছর বপন করেছেন ২ হাজার তাল বীজ। জানালেন, এবারও বর্ষা মৌসুমে বৃক্ষ রোপণ করবেন তারা। সেই সময় ফেসবুকে প্রচার-প্রচারণাও চালিয়েছেন। সম্পৃক্ত করেছেন গ্রামের মানুষদের। 

জু‌বেল আল মনসুর বলেন, গেল বছ‌রও তালবীজ লা‌গি‌য়ে‌ছি। এবারের বর্ষা মৌসুমেও তা‌ল বীজ রোপণের পরিকল্পনা আছে। তালবীজ রোপ‌ণে প্রথম যে বিষয়‌টি মাথায় ছিল, তা হ‌লো- বজ্রপা‌তে অধিক সংখ‌্যক প্রাণহা‌নি। বজ্রপা‌তে মৃত‌্যু ঝুঁকি হ্রাসে তালগাছ খুবই সহায়ক। বেশি করে তাল গাছ লাগালে প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা কমে আসবে। এছাড়া, ভূ‌মি ক্ষয় রো‌ধে সহায়তা করে তাল গাছ। 

কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও কবি দ্রাবিড় সৈকত। তিনিও সতীর্থদের নিয়ে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে ফলজ ও ওষুধি বৃক্ষ রোপণ করছেন বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে। তাঁর ভাষায়, কিছু কিছু গাছ পরিবেশের ক্ষতি করে। সেসব গাছ লাগানো থেকে বিরত থাকতে হবে। নিষেধ করলেন, রেনট্রি ও ইউক্যালিপটাস গাছ না লাগাতে। এইসব গাছের পাতা দীর্ঘদিনেও পচে না। ফলে মাটির গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়।পাহাড়ের পথে পথে রোপণ করা হচ্ছে গাছের চারা। ছবি: ফলদ বাংলাদেশ

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা কী ভাবছেন প্রকৃতি নিয়ে? সভা-সমাবেশে গাছ লাগানো, গাছ রক্ষার ব্যাপারে কোন কথা বলছেন কী? প্রতিবাদ করছেন কী গাছ নিধনের ব্যাপারে? কিংবা নিজ নিজ এলাকায় বৃক্ষরোপণের কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন কী? যদি ছাত্রদল, যুবদল, ছাত্রলীগ, যুবলীগ গাছ লাগানোর উদ্যোগ নিত তাহলে দেশটাকে অচিরেই সবুজ বানিয়ে ফেলা যেতো! তীব্র গরম থেকে বাঁচতো এদেশের মানুষ। দুঃখের বিষয়, কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে তীব্র দাবদাহের মধ্যেই ৩ হাজার গাছ কাটার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এই গাছ রক্ষার ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসন কোন পদক্ষেপ নিয়েছেন কী?

কোথায় গাছ লাগানো যেতে পারে? এই যেমন: সড়ক বিভাজক, রাস্তার দুই ধারে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, মসজিদ-মন্দিরে, গোরস্থানে, পতিত জমিতে, সড়ক-মহাসড়কে, রেল লাইনের দুই পাশে, নদী ও খালের ধারে। 

ওই সব স্থানে কী ধরনের গাছ লাগাবো? একটু তথ্য জেনে নিই।  রাস্তার ধারে (Roadside): নিম, জারুল, কদম, সোনালু, কৃষ্ণচূড়া। রাস্তার বিভাজক (Road Divider): জবা, রতনগাছ ,হিজল । উদ্যান (Park): বটগাছ, কদম, চাপালিশ, কনক চাঁপা ও অশোক। পায়ে হাঁটার পথ (Footpath): পারুল, চেরি, ঝাউ গাছ  ও দেবদারু। খোলা জায়গা (Open Space): মেহগনি, কৃষ্ণচূড়া, শিমুল ও অর্জুন গাছ ও বহেড়া। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (Institutional Areas): আম, কাঁঠাল, জাম্বুল, বেল, হরিতকি ও আমলকি। বাড়ির আঙ্গিনা (Homestead): আম ,কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, নারিকেল, কলা গাছ, জাম্বুরা, কামরাঙ্গা ও বেল। 

গাছ রোপণে বেশি প্রাধান্য দিতে হবে ফলজ ও ওষুধি গাছকে। তাতে ঘাটতি মিটবে পুষ্টি চাহিদার। ফলে বেড়ে উঠবে আগামীর বাংলাদেশে স্বাস্থ্যবান প্রজন্ম।

লেখক: সাংবাদিক

×