
প্রসঙ্গ ইসলাম
আগ্রাবাদ সিডিএ বায়তুল আমিন জামে মসজিদের দীর্ঘদিনের খতিব এবং ইমাম ছিলেন আবদুল হামিদ। সম্প্রতি ছোট একটা বাচ্চা কুকুর তাকে আঁচড় দিয়েছিল। আঁচড়টা নরমাল ছিল তাই তিনি এতটা পাত্তা দেননি। কিন্তু তার বিষক্রিয়া খুব দ্রুত জলাতঙ্ক রোগে রূপ নেয়। এ রেবিস রোগ ধরা পড়ার পর ডাক্তাররা ৪৮ ঘণ্টা সময় দিয়েছিলেন তার জীবন প্রদীপ নিভে যাওয়ার। কিন্তু তিনি তার আগেই মারা গেলেন। তার মৃত্যু অনেকেই নানা মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পেরেছেন। এ ছিল এক ভয়ানক মৃত্যু।
রেবিস রোগী মৃত্যুর আগে পাগলের মতো আচরণ করে। তখন ডাক্তাররা বুঝে যান যে, রোগীর অবস্থা চরম খারাপ পর্যায়ে চলে গেছে। কুকুরের কামড়ে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত ইমাম সাহেবের যখন শেষ পর্যায় তখন দেখা গেল নার্সরা রুম থেকে সবাইকে বের করে দিয়ে রুম তালাবদ্ধ করে দেন। কারণ শেষ মুহূর্তে রোগিটি প্রচণ্ড উন্মাদনার বশবর্তী হয়ে সামনে যাকে পাবে তাকে কামড় বা আঁচড় দিবে। আর এই রোগী যাকে কামড় দেবে তারও মৃত্যু অনেকটা নিশ্চিত।
দরজা তালা মেরে দেওয়ার পর বাঁচার জন্য লোকটি কী যে করল, কত চাইল রুম থেকে বের হতে, রুমের ভিতর দৌড়াদৌড়ি করতে লাগল এবং শুধু ধাক্কা খাচ্ছিল দেওয়াল আর চৌকির সঙ্গে, এটা দেখে তাদের আত্মীয়রা নার্সদের থেকে অনুমতি চাইলেন দরজা খুলে তাকে একটু ধরে রাখবে, যাতে ধাক্কা না খান। কিন্তু নার্সরা অনুমতি দিলেন না।
তারা বললেন, তিনি আর ১০/১৫ মিনিটের মধ্যে মারা যাবেন, অপেক্ষা করুন। ওনার জন্য তো আমরা আপনাদের মৃত্যুর মুখে ফেলে দিতে পারি না। একটা দেশী মুরগি জবাই দেওয়ার পর মুরগিটি যেভাবে ছটফট করে মৃত্যুবরণ করে জলাতঙ্ক রোগীর মৃত্যুও প্রায় সেভাবেই হয়ে থাকে।
১৪০০ বছর আগে আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহম্মদ (সা.) বলে গিয়েছেন কুকুর নাপাক প্রাণী। ১৪০০ বছর পর মেডিকেল সায়েন্স বলছে জলাতঙ্ক ভেকসিন করা নেই ঐ ধরনের কুকুরকে আপনি হাত দিয়ে স্পর্শ করলে আপনারও হয়ে যেতে পারে জলাতঙ্ক। কুকুর স্পর্শ করে আমরা যদি আমাদের শরীর চুলকাই বা আমাদের শরীরের কোনো ক্ষত স্থানে সে হাত লাগাই তাহলেও রিস্ক থাকে জলাতঙ্কের।
রেবিস ভাইরাস রক্তের মাধ্যম আমাদের শরীরে প্রবেশ করে না, রেবিস ভাইরাস আমাদের চামড়ার নিচে যে সাদা একটা চর্বির আস্তর থাকে সেই চর্বি থেকে মাথায় চলে যায়। প্রথমে আমাদের ব্রেনে আক্রমণ করে ব্রেন ইনজুরড করে দেয়। পরে আস্তে আস্তে গলায় নামতে শুরু করে এবং গলার যে নার্ভ থাকে তা ধ্বংস করে দেয়। গলার নার্ভের মাধ্যমে আমরা পানি খেয়ে থাকি বা অন্যান্য খাবার খেয়ে থাকি। নার্ভ যখন পুরোপুরি বিকল হয়ে যায় তখন এই রোগী গলা দিয়ে কোনো পানি বা খাবার খেতে পারে না।
গলায় কিছু গেলেই রোগীর শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। কারণ যে নার্ভ খাবার গিলতে সাহায্য করে তা আর কাজ করে না। তাই আক্রান্ত রোগী পানির পিপাসায় এক সময় মারা যান। এসব রোগী পানি দেখলেই ভয় পান। কারণ পানি গলায় গেলে তিনি আর শ্বাস নিতে পারেন না। আমাদের একটা ভুল ধারণা আছে, আমরা মনে করি কুকুর কামড়ালে বা আঁচড় দিলে রেবিস ভেকসিন দিতে হয়। কিন্তু মেডিক্যাল সায়েন্স বলছে, কুকুরের লালাতে সবচেয়ে বেশি জলাতঙ্ক ভাইরাস রেবিস থাকে। কুকুর তার জিহ্বা দিয়ে তার শরীর চাটে।
এই চাটার কারণে কুকুরের পুরা শরীরে রেবিস জীবাণু থাকার রিস্ক থাকে। যদি কোনো কুকুরের শরীর পানি দ্বারা ভেজা থাকে আর সেই ভেজা কুকুরের গায়ে আপনার হাত বা পায়ের স্পর্শ লাগে সঙ্গে সঙ্গে এই স্থান সাবান দিয়ে প্রায় ১৫ মিনিট ধৌত করবেন। আর রেবিস ভেকসিন কখনো সরকারি মেডিক্যাল ছাড়া অন্য জায়গায় দিবেন না। যে কোন টিকা সরকারি মেডিক্যাল ছাড়া অন্য জায়গায় দিবেন না। আমরা অনেকে ফার্মেসিতে ভেকসিন বা টিকা নিয়ে থাকি, এটা ঠিক না।
বিড়ালেরও জলাতঙ্ক হয়, যদি সেই বিড়াল কুকুরের কামড় খায় বা কুকুর যে জায়গায় খাবার খায় একই জায়গায় বিড়াল মুখ দেয় তাহলে সে বিড়ালও জলাতঙ্কে আক্রান্ত হয়। তাই বিড়ালের কামড় বা বিড়ালের আঁচড় বা বিড়াল আপনার পা চেটে দিয়েছে তাহলেও আপনার ভেকসিন নিয়ে শতর্ক থাকতে হবে। একবার আপনার শরীরে রেবিস ভাইরাস ঢুকে গেলে নিশ্চিত মৃত্যু। কারণ জলাতঙ্ক রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। আল্লাহ সবাইকে সুস্থ রাখুন।
কুকুর, বিড়ালসহ আমাদের চারপাশে বাস করা জীবজন্তু ও পশুপাখির মুখ দেওয়া খাবার খাওয়া ও পানি ব্যবহার করার ক্ষেত্রে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। কারণ এর সঙ্গে পবিত্রতা-অপবিত্রতার বিষয় জড়িত। সব ধরনের প্রাণীর উচ্ছিষ্ট পবিত্র নয়। কোন প্রাণীর উচ্ছিষ্ট পবিত্র এবং কোন প্রাণীর উচ্ছিষ্ট অপবিত্র তা ফিকহের কিতাবে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে।
মানুষের মুখ দেওয়া সব ধরনের পানাহারের উপকরণ ও পানি পবিত্র এবং তা খেতে ও ব্যবহার করতে শরিয়তের দৃষ্টিতে কোনো অসুবিধা নেই। মানুষটি মুসলিম হোক বা অমুসলিম, পবিত্র হোক বা অপবিত্র, ঋতুস্রাবের সময়ে হোক বা অন্য সময়ে- সব সময় মানুষের উচ্ছিষ্ট পবিত্র এবং খাওয়ার যোগ্য। হাদিসে এসেছে, আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমি ঋতুস্রাবের সময় পানি পান করে বাকি অংশটুকু মহানবীকে (সা.) দিতাম।
তিনি আমার মুখ রাখা স্থানে মুখ রেখেই তা পান করতেন। কখনো আমি ঋতুস্রাব চলাকালে হাড়যুক্ত মাংস খেতাম; কিছুটা খেয়ে বাকি অংশ মহানবীকে (সা.) দিতাম। তিনি আমার মুখ রাখা স্থানে মুখ রেখেই খেতেন।’ (মুসলিম)
যেসব পশুপাখির মাংস খাওয়া হালাল সেসব পশুপাখির মুখ দেওয়া খাবার ও পানীয় পবিত্র। তা খাওয়া ও ব্যবহার করা জায়েজ। কারণ মৌলিকভাবে কোনো বস্তুর অপবিত্র হওয়ার কোনো দলিল না থাকলে তা পবিত্রই বিবেচনা করা হয়। তবে যেসব মুরগি সবখানে বিচরণ করার সুযোগ পায় সেগুলোর মুখ দেওয়া খাবার খাওয়া বা পানি পান অথবা ব্যবহার করা অনুচিত। কারণ এসব মুরগি নাপাক বস্তু খেয়ে বেড়ায়।
যেসব পাখি শিকারি ও হিংস্র হওয়ার কারণে খাওয়া নাজায়েজ, যেমন ইগল, শকুন, কাক ইত্যাদির উচ্ছিষ্ট অপবিত্র। কারণ এসব পাখিও অপবিত্র জিনিস খেয়ে বেড়ায়। তবে এ ধরনের পাখি খাঁচায় বন্দি থাকলে এবং এগুলোর অপবিত্র বস্তু এড়িয়ে চলার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেলে তা খাওয়া বা ব্যবহার করা মাকরুহ হবে না। শূকরের উচ্ছিষ্ট অপবিত্র। পবিত্র কুরআনে শূকরের সবকিছুই অপবিত্র বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই তা অপবিত্র।’ (সুরা আনআম: ১৪৫)
একইভাবে কুকুরের উচ্ছিষ্টও অপবিত্র। কুকুর কোনো পাত্রে মুখ দিলে তা ধুয়ে ফেলতে হবে। কোনো হাদিসে তিনবার এবং কোনো হাদিসে পাঁচবার ধুয়ে ফেলার কথা এসেছে। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘কুকুর মুখ দেওয়ার কারণে পাত্র তিনবার ধুতে হবে।’ (দার কুতনি)। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘পাত্রে কুকুর মুখ দিলে তা সাতবার ধুয়ে নাও, প্রথমবার মাটি দিয়ে।’ (বুখারি ও মুসলিম)। উল্লেখ্য, ইসলামে শখের বশে কুকুর পোষা বৈধ নয়।
কারণ ইসলামে শখ করে কুকুর পালন করা নিষেধ। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ঘরে কুকুর আছে সে ঘরে রহমতের ফেরেশতারা প্রবেশ করে না।’ (বুখারি)। তবে শিকার করা, ফসলের সুরক্ষা, পশুপাখির নিরাপত্তা, ঘরবাড়ি, দোকান ও অফিস পাহারা দেওয়া এবং অপরাধী চিহ্নিত করার জন্য কুকুর পোষা বৈধ। (মুসলিম, তিরমিজি, ফতোয়ায়ে আলমগিরি: ৪/২৪২)
লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব