
মূল্যায়ন একটি ধারাবাহিক ও পদ্ধতিগত ও অবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া
মূল্যায়ন একটি ধারাবাহিক ও পদ্ধতিগত ও অবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া। শিক্ষণ শিখন প্রক্রিয়া ও মূল্যায়ন পাশাপাশি চলে। মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ধরে নেওয়া হয় যে, শিক্ষার উদ্দেশ্যগুলো পূর্বেই শনাক্ত ও বর্ণনা করা হয়েছে। মূল্যায়নের সঙ্গে তথ্য সংগ্রহের বিভিন্ন প্রকার পদ্ধতি ও অভীক্ষা জড়িত শিক্ষণের চেয়ে শিখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার উদ্দেশ্য অনুসারে শিখন অভিজ্ঞতা এমন প্রাসঙ্গিক হতে হবে যেন এগুলো শিক্ষামূলক উদ্দেশ্য অর্জনের দিকে শিক্ষার্থীকে পরিচালিত করে শিক্ষার্থীর আচরণ সম্পর্কে প্রমাণ সংগ্রহের সব উপায় কাজে লাগায়। মূল্যায়ন বর্ণনামূলক ও পরিমাণগতও বটে।
মূল্যায়ন ৪টি বিষয়ের সঙ্গে জড়িত উদ্দেশ্য, বিষয়বস্তু, শিখন অভিজ্ঞতা, মূল্যায়ন কৌশল ও উপকরণ। মূল্যায়ন কেন দরকার? এর উত্তরে বলা যায় ত্রুটিহীন, যুক্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু শিক্ষামূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণে মূল্যায়ন প্রয়োজন। শিক্ষা থেকে শিক্ষার্থীর কি লাভ হবে বা শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে সমাজ, জাতি ও দেশ কি পাচ্ছে তা মূল্যায়নের ফলাফল থেকেই জানা সম্ভব। মূল্যায়ন শিক্ষাক্রম উন্নয়নে সহায়তা করে। উত্তম মূল্যায়ন পদ্ধতি শিক্ষার লক্ষ্যকে ব্যাখ্যা ও সুস্পষ্টকরণে সহায়তা করে। একজন শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করতে হলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। যথোপযুক্ত শিখন অভিজ্ঞতা পরিকল্পনা করার পরবর্তী ধাপটি হলো শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা।
শিখনের ফলে শিক্ষার্থীর মধ্যে কি পরিবর্তন ঘটল বা কি শিখন ফল পাওয়া গেল তা শিক্ষক পর্যবেক্ষণ করে মূল্যয়ন করেন বা পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর কৃতিত্ব পরিমাপ করতে পারেন। এই জন্য তাকে মূল্যায়নের সঠিক কৌশল নির্বাচন অথবা উদ্ভাবন করতে হবে। মূল্যায়নের সময় শিক্ষককে তিনটি বিষয় মনে রাখতে হবে-উদ্দেশ্য, প্রাসঙ্গিক শিক্ষণ বিষয় ও শিখন কার্যাবলী। কিন্তু সব সময়ই মূল্যায়নের কেন্দ্রবিন্দু থাকবে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের ওপর। এ কাজটি তিনি প্রাসঙ্গিক শিক্ষণ বিষয়ের তালিকা তৈরি এবং শিখন কার্যাবলীর পরিকল্পনা না করে করতে পারবেন না। শিক্ষক যে শিখন কার্যাবলী উপস্থাপন করেন তার থেকে শিক্ষার্থী শিখন অভিজ্ঞতা লাভ করে।
যে প্রাসঙ্গিক শিক্ষণীয় বিষয় নিয়ে শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে আলোচনা করেছেন এবং শ্রেণিশিক্ষক থেকে শিক্ষার্থীরা যে শিখন অভিজ্ঞতা লাভ করেছে তার অধিকাংশকে অন্তর্ভুক্ত করে শিক্ষক অভীক্ষা তৈরি করতে পারেন। তিনি নিতে পারেন কোনো মৌখিক পরীক্ষা বা লিখিত পরীক্ষা। এ ছাড়াও তিনি ব্যবহারিক পরীক্ষাও নিতে পারেন। তিনি তৈরি করতে পারেন নৈর্ব্যক্তিক অভীক্ষা বা রচনামূলক অভীক্ষা বা কোনো পর্যবেক্ষণ ছক। যে অভীক্ষাই তিনি তৈরি বা নির্বাচন করেন না কেন? তাকে মনে রাখতে হবে সেটি যেন সর্বোত্তমভাবে উদ্দেশ্য, প্রাসঙ্গিক শিক্ষণীয় বিষয় ও শিক্ষার্থীর শিখন অভিজ্ঞতা মূল্যায়ন করে।
ধারাবাহিক মূল্যায়নের প্রক্রিয়া বা ধাপসমূহ হলো- পরিকল্পনা প্রণয়ন, মূল্যায়ন কৌশল ও টুলস নির্বাচন, মূল্যায়ন পরিচালনা ও তথ্য সংরক্ষণ এবং সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ ও কার্র্যকর ফলাবর্তন প্রদান। একজন শিক্ষার্থীর শিখন নিশ্চিতকল্পে শিখনের ৩টি ক্ষেত্রÑ জ্ঞান, মনোপেশিজ এবং আবেগিক ক্ষেত্রের ওপর ভিত্তি করে ধারাবাহিক মূল্যায়ন করা হবে। ধারাবাহিক মূল্যায়নের প্রয়োগক্ষেত্র ৩টিÑ জ্ঞান, দক্ষতা এবং দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ। প্রতিটি প্রয়োগক্ষেত্রের আবার কয়েকটি উপক্ষেত্র রয়েছে। জ্ঞানের প্রয়োগক্ষেত্রের উপক্ষেত্র হলো জানা, অনুধাবন ও প্রয়োগ। আবার দক্ষতার উপক্ষেত্রসমূহ হলো সৃজনশীলতা, সূক্ষ্মণ-চিন্তন, যোগাযোগ ও সহযোগিতা।
একইভাবে মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি উপক্ষেত্রসমূহের কয়েকটি হলো সহমর্মিতা, পরমতসহিঞ্চুতা, আগ্রহ ও কৌতূহল। ধারাবাহিক মূল্যায়নের বিভিন্ন কৌশল ও টুলস্ হলো- মৌখিক প্রশ্নোত্তর, লিখিত প্রশ্নোত্তর, পর্যবেক্ষণ (একক ও জোড়ায় কাজ, দলগত কাজ, প্রকল্প ব্যবহারিক কাজ ইত্যাদি)। সাক্ষাৎকার, স্ব-মূল্যায়ন, সতীর্থ/সহপাঠী কর্তৃক মূল্যায়ন। তবে আমাদের সবার মনে রাখতে হবে ধারাবাহিক মূল্যায়ন কোনো আনুষ্ঠানিক মূল্যায়ন নয়। তাই এই মূল্যায়নের জন্য আলাদা কোনো অনুষ্ঠানাদির পরীক্ষা নেওয়া যাবে না। ধারাবাহিক মূল্যায়নের মূল লক্ষ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীকে তার শিখনে সহায়তা করা। শিখন-শেখানে কার্যাবলী চলাকালে প্রয়োজনীয় ফলাবর্তনের মাধ্যমে এই শিখন নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে স্বাভাবিক ও আনন্দময় পরিবেশে ধারাবাহিক মূল্যায়ন করবেন।
শিক্ষার্থীর এই মূল্যায়ন শুধু শিক্ষকই করবেন না। শিক্ষকের পাশাপাশি কিছু কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর অভিভাবক, সহপাঠী এবং এলাকার লোকজন/কমিউনিটি/ স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এই মূল্যায়নে অংশগ্রহণ করবে। শিক্ষার্থীর জন্য নির্ধারিত কাজগুলোতে তাদের মূল্যায়নের এই সুযোগ রাখা হয়েছে। এই লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের ছক, মতামত ও পরামর্শ প্রদানের ঘর/বক্স রাখা হয়েছে যা প্রমাণক হিসেবে কাজ করবে। মূল্যায়ন শিক্ষার্থীর নিকট খুবই উপকারী। নিয়মিত মূল্যায়ন করা হলে শিক্ষার্থী বিষয়টি প্রয়োজনবোধে বারবার পড়ে। ফলে তার মধ্যে ভালো অধ্যয়ন অভ্যাস গড়ে ওঠে। ঘন ঘন মূল্যায়ন করা হলে শিক্ষার্থী তার দুর্বলতা ও অগ্রগতি জানতে পারে এবং সে অনুযায়ী ভবিষ্যৎ প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারে।
মূল্যায়ন শিক্ষার্থীর অগ্রগতির সারসংক্ষেপ তৈরি ও তা রিপোর্টিংয়ে সহায়তা করে। শিক্ষণ পদ্ধতি ও পরিকল্পিত শিখন কার্যাবলীর কার্যকারিতা নির্ণয়ে মূল্যায়নে সহায়তা করে থাকে। তাছাড়া, মূল্যায়ন শিক্ষার্থীদের অগ্রগতির সারসংক্ষেপ তৈরি ও তা জানিয়ে দেওয়ার কাজে সহায়তা করে। এ ছাড়া, মূল্যায়ন থেকে শিক্ষার্থীদের সফলতা ও দুর্বলতা শনাক্ত করে তাকে ফিডব্যাক প্রদান করা যায়। এটি শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ফিডব্যাক থেকে শিক্ষার্থী তার সফলতা ও দুর্বলতা কোথায় ও তা সংশোধনের উপায় জানতে পারে এবং সে অনুযায়ী প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারে। বর্তমানে এই পরীক্ষা পদ্ধতি বাদ দিয়ে ২০২৩ সাল থেকে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের মাধ্যমে তাদের কৃতিত্বের বিচার পরিমাপ করতে বলা হয়েছে। এ নতুন শিক্ষাক্রমে মূল যোগ্যতা থাকবে ১০টি।
শিক্ষার্থীদের বাড়ির কাজ কমানোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত সকলের জন্য ১০টি বিষয় রাখার কথা বলা হয়েছে। থাকবে না কোনো বিভাগ। পরীক্ষা ও মুখস্থনির্ভর পড়াশোনার পরিবর্তে পরিদর্শিতাকে গুরুত্ব দিয়ে ১০ শ্রেণি শেষে পাবলিক পরীক্ষা এবং একাদশ শ্রেণি শেষে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষাক্রম ভিত্তিতে দ্বাদশ শ্রেণি শেষে পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। ৯ম ও ১০ম শ্রেণিতে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য কৃষি, সেবা বা শিল্প খাতের একটি অকুপেশনের ওপর পেশাদারি দক্ষতা অর্জন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোনো পরীক্ষা ভীতি থাকবে না। বাড়ির কাজের চাপ কমিয়ে শিক্ষার্থীদের বাস্তবমুখী এবং যুগোপযোগী শিক্ষাদান ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত কোনো প্রাইভেট, কোচিং পড়তে হবে না। প্রাইভেট বা কোচিং প্রথাকে সম্পূর্ণভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে বর্তমান শিক্ষাক্রমে। শিক্ষার্থীরা আনন্দঘন পরিবেশে লেখাপড়া করে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে, এটাই সকলের প্রত্যাশা।
লেখক : মাস্টার ট্রেইনার ও
সিনিয়র শিক্ষক