ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৪ জুন ২০২৫, ১০ আষাঢ় ১৪৩২

প্রসঙ্গ ইসলাম

কুরআনের উদ্ধৃতি দিয়েই যে মহিলা আজীবন কথা বলতেন

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ২০:৩৫, ২৪ আগস্ট ২০২৩

কুরআনের উদ্ধৃতি দিয়েই যে মহিলা আজীবন কথা বলতেন

প্রসঙ্গ ইসলাম

জ্ঞান, গবেষণা ও অলৌকিকত্বের এক অপূর্ব নজির। গোটা জীবন তাকওয়ার মধ্যে কাটিয়েছেন, ছিলেন মিতভাষী। আর যখনই কথা বলতেন কুরআনের আয়াত ছাড়া বলতেন না। কাউকে কোনো প্রশ্ন করলেও কুরআনের আয়াতের উদ্ধৃতিতে প্রশ্ন করতেন। আবার জবাব দিলেও কুরআনের আয়াত থেকে রেফারেন্স দিয়ে জবাব দিতেন। এমন একজন মহীয়সী মহিলার সন্ধান রয়েছে ইসলামের ইতিহাস ও তাজকাতুল আউলিয়া গ্রন্থসমূহে। সমসাময়িক যুগের একজন শ্রেষ্ঠ হাদিস বিশারদ, বীর মুজাহিদ, ব্যবসায়ী, সুসাহিত্যিক, লেখক ও পর্যটক  ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহমাতুল্লাহ আলাইহি (মৃ. ১৮১ হি./৭৯৭ খ্রি.) বলেন: আমি একবার হজে গিয়ে মরুভূমির ভেতরে রাস্তা অতিক্রম করতে গিয়ে এক স্থানে একাকি এক বৃদ্ধা মহিলাকে বসা দেখলাম। বিজন মরু প্রান্তরে তাকে একাকি এভাবে দেখে আমার মনে হলো, তিনি বিপদগ্রস্ত কেউ হবেন। তার সঙ্গে আমার কথোপকথন ছিল বিস্ময়কর। তিনি আমার প্রত্যেকটি কথার জবাব কুরআনের আয়াত দ্বারা দিয়েছিলেন। কথোপকথন বিস্তারিত তুলে ধরা হলো:
অধিকাংশ ইসলামী স্কলারগণের মতে এই মহীয়সী নারীর নাম উম্মে ইয়াহইয়া রাবিয়্যাহ।
আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) প্রথমে বলেছিলেন- ‘আসসালামু আলাইকুম।’
উম্মে ইয়াহইয়া রাবিয়্যাহ : ‘সালামুন ক্বাওলাম মির রাব্বির রাহীম।’ অর্থ: ‘দয়াবান রবের পক্ষ থেকে সালাম।’ (সূরা ইয়াসিন, ৫৮ আয়াত)
আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) বলেন, আমি বললাম : আল্লাহ আপনার উপর রহম করুন। ‘আপনি এখানে বসে কী করছেন?’ জবাবে রাবিয়্যাহ তিলাওয়াত করলেন সূরাহ কাহাফের এই আয়াত: ‘আল্লাহ পাক যাকে পথহারা করেন, তাকে পথ দেখানোর কেউ থাকে না।’ (সূরাহ আরাফ, ১৮৬ আয়াত)
আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) বলেন, আমি বুঝতে পারলাম মহিলাটি পথ হারিয়ে ফেলেছে। তাই জিজ্ঞেস করলাম : ‘কোথায় যেতে চান আপনি?’ উত্তরে রাবিয়্যাহ তিলাওয়াত করলেন : ‘তিনি একটি পবিত্র সত্তা যিনি তাঁর বান্দাকে রাতেরবেলায় মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আকছায় ভ্রমণ করিয়েছেন।’ (সূরাহ ইসরা, ১ আয়াত)।
আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) বলেন, আমি বুঝতে পারলাম মহিলাটি হজের কাজ শেষ করেছেন। এখন তিনি বাইতুল মুকাদ্দাস যেতে চান। জিজ্ঞেস করলাম : ‘কতক্ষণ এখানে বসে আছেন?’ রাবিয়্যাহ উত্তরে তিলাওয়াত করলেন : ‘সালাসা লা ইয়ালিন সাবিয়া।’ অর্থ : ‘পূর্ণ তিনটি রাত ধরে।’ (মারইয়াম, ১০ আয়াত) আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) জিজ্ঞেস করলেন : ‘আপনার কাছে আহারের কিছু দেখছি না। কি খেয়ে কাটাচ্ছেন?’ রাবিয়্যাহ তিলাওয়াত করলেন: ‘তিনি আমাকে খাইয়ে থাকেন এবং তিনিই আমাকে পান করিয়ে থাকেন।’ (সূরা, ৭৯ আয়াত) আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) জিজ্ঞেস করলেন: ‘কিসের দ্বারা অজু করে থাকেন?’ উম্মে ইয়াহইয়া তিলাওয়াত করলেন: ‘ফাতাইয়াম্মামু সাঈদান তাইয়্যিবা।’ অর্থ: পাক মাটি দিয়ে তখন তায়াম্মুম করে নিও।’ (৪ : ৪৩)। আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) বললেন: ‘আমার কাছে কিছু খাবার আছে। খাবেন?’ রাবিয়্যাহ তিলাওয়াত করলেন: ‘রাত আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করে (অর্থাৎ, সূর্যাস্তের পরে ইফতার করে) রোজাকে পূর্ণ কর।’ (২ : ৮৭)
আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) বললেন : ‘কিন্তু এটাতো রমজান মাস নয়।’ রাবিয়্যাহ তিলাওয়াত করলেন: ‘ওয়ামান তাতাউয়া খাইরান ফাইন্নাল্লাহা শাকিরুন আলিম।’ অর্থ : ‘যে ব্যক্তি সাওয়াব লাভের উদ্দেশ্যে নফল ইবাদত করে থাকে আল্লাহ তার কদর করে থাকেন এবং তিনি সব জানেন।’ (২: ১৫৮)
আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) বললেন : ‘মুসাফির অবস্থায় ফরজ রোজাও তো না রাখা জায়েজ আছে।’ রাবিয়্যাহ তিলাওয়াত করলেন: ‘(কত যে সাওয়াব) তোমরা যদি জানতে তাহলে রোজা রাখাটাই ভালো মনে করতে।’ (সূরা বাক্কারা, ১৮৪ )
আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) জিজ্ঞেস করলেন : ‘আপনি আমার মতো করে কথা বলছেন না কেন?’ জবাবে রাবিয়্যাহ তিলাওয়াত করলেন : ‘মানুষ যে কথাটিই বলছে খবরদারির জন্য তার কাছে একজন ফিরিশতা প্রস্তুত আছে।’ (সূরা ক্কাফ, ১৮)। আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) জিজ্ঞেস করলেন: ‘আপনি কোন্ গোত্রের লোক?’ উম্মে ইয়াহইয়া রাবিয়্যাহ তিলাওয়াত করলেন : ‘যে বিষয়ে জানতে নেই, সে বিষয়ের পেছনে লেগো না।’ (সূরা ইসরা, ৩৬)। আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) বললেন, আমি আরজ করলাম: ‘ভুল হয়ে গেছে আমি মাফ চাচ্ছি।’ উত্তরে রাবিয়্যাহ তিলাওয়াত করলেন : ‘আজ তোমাদের প্রতি কোনো তিরস্কার নেই। আল্লাহ তোমাদের মাফ করে দিন।’ (সূরা ইউসূফ, ৯২)
আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) বললেন, ‘আমি বললাম: যদি চান তবে আমার উটনির পিঠে সওয়ার হয়ে আপনার দলের লোকের কাছে যেতে পারেন।’ উম্মে ইয়াহইয়া রাবিয়্যাহ তিলাওয়াত করলেন: ‘তোমরা যা কিছু ভালো কাজ কর আল্লাহ তা জেনে থাকেন।’ (২: ১৯৭)
আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) বললেন, ‘এই আয়াত শোনার পরে আমি আমার উটনিকে বসালাম।’ কিন্তু মহিলা তার পিঠে সওয়ার হওয়ার আগে বললেন: ‘মুমিন ব্যক্তিদের বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নিচের দিকে করে রাখে।’ (সূরা  নূর, ৩০)
আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) বললেন, আমি আমার দৃষ্টিকে নিম্নগামী করে তাকে বললাম : ‘এবার সওয়ার হোন।’
মহিলা সওয়ার হতে গেলেন। কিন্তু, উটনি ভয় পেয়ে পালাতে উদ্যত হলো। ধস্তাধস্তির ফলে বৃদ্ধা মহিলার কাপড় ছিঁড়ে গেল। তখন রাবিয়্যাহ তিলাওয়াত করলেন : ‘যত মুছিবত এসে থাকে তা তোমাদের আমলের কারণে।’ (সূরা, ৩০)
আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) বললেন, ‘আমি তাকে বললাম: একটু অপেক্ষা করুন। উটনি বেঁধে দিচ্ছি। তারপরে সওয়ার হোন।’ উম্মে ইয়াহইয়া রাবিয়্যাহ তিলাওয়াত করলেন : ‘এসব বিষয়ের সমাধান আমি সুলাইমান (আ:) কে শিখিয়ে দিয়েছি।’ (সূরা আম্বিয়া, ৭৯)
আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) বললেন, ‘আমি উটনিকে ভালো করে বাঁধলাম। তারপর তাকে বললাম : এবার সওয়ার হোন।’ তখন রাবিয়্যাহ উটের পিঠে সওয়ার হয়ে এই আয়াত তিলাওয়াত করলেন: ‘সুবহানাল্লাজি সাখখারা লানা হাজা ওয়ামাকুন্না লাহু মুকরিনিন ওয়াইন্না ইলা রব্বিনা লা মুনক্বালিবুন।’ অর্থ: ‘পবিত্র সেই সত্তা যিনি এটাকে আমাদের আয়ত্তাধীন করে দিয়েছেন। আমাদের ক্ষমতা ছিল না তাকে আয়ত্ত করার। আর আমরা আমাদের পরওয়ারদেগারের কাছে নিঃসন্দেহে ফিরে যাব।’ (সূরা যুখরূফ, ১৩, ১৪ )
আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) বললেন, ‘আমি উটনির লাগাম ধরে হাঁটতে লাগলাম। খুব জোরে হাঁটছিলাম আর চিৎকার করে করে উটনি তাড়াচ্ছিলাম।’ এই দেখে তিনি তিলাওয়াত করলেন ‘স্বাভাবিক পন্থায় হাঁট আর তোমার স্বর অবনত কর।’ (সূরা লুকমান, ১৯ )
আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) বললেন, ‘এবার আমি আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগলাম এবং কবিতার কয়েকটি ছন্দ গুন গুন করে গাইতে লাগলাম।’ এই দেখে তিনি তিলাওয়াত করলেন : ‘কুরআন থেকে যে অংশ সহজ মনে হয় তাই পড়।’ (সূরা মুজ্জাম্মিল, ২০)
আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) বললেন, আমি তাকে বললাম: ‘আল্লাহপাক সত্যি আপনাকে নেককার মহিলা হিসেবে সৃষ্টি করেছেন।’ তখন উম্মে ইয়াহইয়া  রাবিয়্যাহ এই আয়াত তিলাওয়াত করলেন : ‘যাদের জ্ঞান আছে তারাই শুধু শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে।’ (৩: ৭ )। আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) বললেন, ‘কিছুক্ষণ চুপচাপ চলার পর তাকে জিজ্ঞেস করলাম : আপনার স্বামী আছে?’ তখন রাবিয়্যাহ এই আয়াত তিলাওয়াত করলেন : ‘তোমরা এমন বিষয় জিজ্ঞেস করো না, যা প্রকাশ পেলে তোমাদের কাছে খারাপ লাগতে পারে।’ (৫: ১০১)।
আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) বললেন, ‘এবার আমি পুরোপুরি চুপ হয়ে গেলাম। যতক্ষণ কাফেলা না পাওয়া গেল আমি তার সঙ্গে কোনো কথা বললাম না। কাফেলা যখন সামনে দেখতে পেলাম তখন তাকে বললাম : এই যে সামনে কাফেলা এসে গেছে। এই কাফেলায় আপনার কে আছে?’
রাবিয়্যাহ এই আয়াত তিলাওয়াত করলেন : ‘সম্পদ এবং সন্তান এসবই দুনিয়ার জীবনের বিলাসিতা।’ (সূরা কাহাফ, ৪৬ )
আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) বললেন, ‘আমি বুঝতে পারলাম এই কাফেলায় তার ছেলে আছে।’ জিজ্ঞেস করলাম : ‘কি কাজ করে সে এই কাফেলায়?’ রাবিয়্যাহ এই আয়াত তিলাওয়াত করলেন : ‘অনেক চিহ্ন আছে। আর নক্ষত্রের সাহায্যে তারা পথের নির্দেশ গ্রহণ করে থাকে।’ (সূরা নহল, ১৬)
আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) বললেন, ‘বুঝতে পারলাম তার ছেলে এই কাফেলার পথ নির্দেশক ‘রাহবর’। মহিলাকে নিয়ে কাফেলার তাঁবুতে গেলাম। সেখানে গিয়ে বললাম: এইবার বলুন, এখানে আপনার কে আছে?’ রাবিয়্যাহ  এই আয়াত তিলাওয়াত করলেন : ‘এবং আল্লাহতাআলা ইবরাহীম (আ:) কে দোস্ত হিসেবে গ্রহণ করেছেন।’ (৪: ১২৫)। আর ‘মূসা (আ:) এর সঙ্গে আল্লাহপাক কথা বলেছেন।’ (৪: ১৬৪)। ‘ইয়া ইয়াহিয়া খুজিল কিতাব বিকুয়া।’ অর্থ: ‘হে ইয়াহইয়া! শক্ত করে কিতাব ধারণ কর।’ (সূরা  মারইয়াম, ১২)
আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) বললেন, এই আয়াতগুলো শোনার পরে আমি চিৎকার করে ডাকতে লাগলাম: ‘হে ইবরাহীম! হে মূসা! হে ইয়াহইয়া!
কিছুক্ষণ পর চাঁদের মতো সুন্দর কয়েকজন নওজোয়ান আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। আমরা যখন স্থির হয়ে আসন গ্রহণ করলাম তখন মহিলা তার ছেলেদের বললেন :  ‘এই টাকা দিয়ে তোমাদের মধ্যে হতে কাউকে শহরে পাঠাও। সে অনুসন্ধান করে দেখবে কোন খাবারটি অধিক পবিত্র। তখন সে তোমাদের জন্য সেখান থেকে কিছু খাবার নিয়ে আসবে।’ : (সূরা কাহাফ, ১৯ আয়াত)।
আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) বললেন, ‘এই আয়াত শুনে তাদের মধ্য থেকে একটি ছেলে উঠে গেল এবং কিছুক্ষণ পরে খাবার নিয়ে আসল।’ খাবার আমার সামনে যখন রাখা হলো তখন মহিলাটি বলল: ‘সানন্দে খাও এবং পান কর। এগুলো তোমাদের সেই কাজের  বিনিময় যে কাজ তোমরা ইতিপূর্বে করে এসেছো।’ (সূরা আল হাক্কাহ, ২৪ আয়াত)
আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) বললেন, ‘আমি আর থাকতে পারলাম না।’ ছেলেদের বললাম : ‘এই খাবার আমার জন্য হালাল হবে না যতক্ষণ ন তোমরা এই মহিলার রহস্য বলছো।’
ছেলেরা বলল : ‘চল্লিশ বছর যাবত আমাদের মায়ের এই অবস্থা। এই চল্লিশ বছরে তিনি কুরআন পাকের আয়াত ছাড়া একটি বাক্যও বলেননি। এই জন্য এই নিয়ম তিনি পালন করছেন যেন জিহ্বা থেকে কোনো অপ্রয়োজনীয় কথা বের না হয়ে পড়ে। তাহলে আল্লাহ নারাজ হবেন।’
আমি বললাম : ‘এসব আল্লাহপাকের অনুগ্রহের নিআমত। যাকে ই্চ্ছা প্রদান করেন। আর আল্লাহতাআলা অনুগ্রহশীল  মহান।’ (সূরা হাদীদ, ২১ আয়াত)
লেখক :  অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও 
জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব

[email protected]

×