
ছবি- দৈনিক জনকণ্ঠ
নকশায় ছোঁয়া, কাঠে ঘ্রাণ, টিনে রঙ—মুন্সীগঞ্জের অলিগলিতে হঠাৎ করেই যেন উঁকি দিচ্ছে এক অনন্য শৈল্পিক বিপ্লব। গৃহ নির্মাণ এখন আর শুধু ‘পাকা দালান’ নয়, বরং নতুন করে গুরুত্ব পাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী কাঠ ও টিনে তৈরি দোতলা ঘর। চাহিদার তীব্রতা এমন যে, জেলার প্রায় প্রতিটি উপজেলায় গড়ে উঠেছে ঘরের হাট। তৈরি হচ্ছে ‘রেডিমেড’ দোতলা ঘর—যা কিনা একদিনেই বসবাসের উপযোগী করে তোলা যাচ্ছে। গৃহনির্মাণে এই নতুন ধারা এখন আর শুধু প্রয়োজন নয়, রুচি ও আত্মপরিচয়ের প্রতীক।
পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী আর ইছামতীর টানে গড়া মুন্সীগঞ্জ যেন নদীর সন্তান। প্রতি বছর বর্ষায় যেভাবে নদী ভাঙন হঠাৎ করে লণ্ডভণ্ড করে দেয় জনপদ, তাতে মানুষ এখন আর পাকা ভবন নয়, চায় সহজে খোলা-ভাঙা যায় এমন আবাস। কাঠ ও টিনে নির্মিত ঘর তাই হয়ে উঠেছে তাদের স্থায়ী ঠিকানা—যে ঠিকানা সহজেই ভাঙা যায়, বহন করা যায়, আবার বসিয়ে নেওয়া যায়।
রেডিমেড এই ঘরগুলো শুধু কাঠামো নয়, একেকটি ছোট্ট বাসযোগ্য জীবন। প্রয়োজন হলে বিক্রিও করা যায়, আবার নামমাত্র লোকসানে ঘর বদলেও সম্ভব।
ঘর কিনতে হলে এখন আর রাজমিস্ত্রির পেছনে ছুটতে হয় না। সদর উপজেলার চুড়াইন, বজ্রযোগিনী, হাতিমারা, লৌহজংয়ের কনকসার, টঙ্গীবাড়ির কুন্ডের বাজার, শ্রীনগরের বালাশুর বটতলা কিংবা সিরাজদিখানের বালুচর—প্রায় প্রতিটি উপজেলায় গড়ে উঠেছে ঘরের হাট।
সেখানে সাজিয়ে রাখা রয়েছে দোতলা, দেড়তলা, এমনকি তিনতলা পর্যন্ত ঘর। চোখ জুড়িয়ে যায়—লালচালা, নীলচালা, সবুজ চালা ঘরের সারি সারি দৃশ্য দেখে। টব, আই-২৩, চৌচালা, সাতচালা, নাকটিন—নানান ঢঙের নাম, নানান রকম ঘর। দামও রয়েছে বিশাল পরিসরে—দুই লাখ থেকে শুরু করে বিশ লাখ পর্যন্ত। কেউ কেউ আবার মনের মতো নকশা দিয়ে অর্ডার করে নিচ্ছেন ঘর।
এই ঘর শুধু থাকার জন্য নয়—রুচি ও স্মৃতির আশ্রয়। ঝুলন্ত বারান্দা, কাঠের সিঁড়ি, দরজায় কারুকাজ আর জানালায় নকশা—মিলে যায় এক ঐতিহ্যবাহী আবাসিক অভিজ্ঞতা। বৃষ্টির দিনে টিনের ছাদে টাপুরটুপুর ধ্বনি যেন গ্রামীণ আবেগের স্পর্শ এনে দেয় শহুরে জীবনের ক্লান্তিতে।
একসময় বার্মার লোহাকাঠ, শাল কাঠে তৈরি হলেও এখন ব্যবহৃত হচ্ছে নাইজেরিয়ান লোহাকাঠ, দেশি সেগুন ও উন্নতমানের টিন। আধুনিক স্ক্রু-বোল্ট সিস্টেমে ঘর এমনভাবে তৈরি হয়, যাতে তা পাটে পাটে খুলে ফেলা যায় এবং সহজে আবার গড়া যায়। টেকসইতাও নজরকাড়া—৫৫ বছর থেকে শুরু করে অনেক ঘরই ৭০ বছরের বেশি স্থায়ী হয়।
এই শিল্প শুধু বাড়ি নয়, গড়ছে জীবিকা। প্রতিটি হাট ঘিরে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় শতাধিক ঘর তৈরির কারখানা। প্রতিদিন ঘর তৈরিতে কাজ করছেন অগণিত শ্রমিক। ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতিদিন তারা পাচ্ছেন চার-পাঁচটি ঘরের অর্ডার। কাঠ-মিস্ত্রি থেকে শুরু করে রঙের কারিগর পর্যন্ত প্রতিটি ঘর যেন একটি ক্ষুদ্র শিল্পচক্র।
স্থানীয়ভাবে পাইকারি দামে কাঠ ও টিন সংগ্রহ, স্থায়ী মিস্ত্রির দল এবং দক্ষ নকশাকার—সব মিলিয়ে এখানকার ঘরের দাম তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী। ব্যবসায়ীরা আরও বলেন, “নিজে ঘর করতে গেলে খরচ বেড়ে যায়, কিন্তু আমরা মাসিক কাঠ মিস্ত্রী ও যন্ত্রপাতির সাহায্যে কম খরচে উন্নত ঘর দিতে পারি।”
মুন্সীগঞ্জের দোতলা রেডিমেড ঘর এখন আর শুধু স্থানীয় চাহিদায় সীমাবদ্ধ নেই। জেলার বাইরের মানুষরাও আসছেন ঘর কিনতে। প্রবাসফেরত কেউ ঘর কিনছেন স্মৃতির জন্য, কেউ ঝুল বারান্দা থেকে প্রকৃতি দেখার জন্য, কেউ বা বৃষ্টির দিনে কাঠের ঘরে থাকার অনুভূতির জন্য।
চাহিদা বাড়ায় অনেক কারখানার শাখাও খোলা হচ্ছে। আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহারে নকশা ও ফিনিশিং উন্নত হচ্ছে। একইসঙ্গে ঘরের দামে যুক্ত হচ্ছে কাঠ ও টিনের মান। কাঠ যেমন মূল্যবান, তেমনি পুনরায় বিক্রিও সম্ভব—এটা আলাদা একটি বাজারমূল্য সৃষ্টি করেছে।
টিন-চাল, কাঠের দোতলা, ঝুল বারান্দা—সব মিলিয়ে বিক্রমপুরের এই রেডিমেড ঘর হয়ে উঠেছে ঘরের চেয়েও বেশি কিছু। এটি একধরনের সাংস্কৃতিক প্রকাশ, আত্মপরিচয়ের বাহক। নদীভাঙনের ক্ষত মুছে নতুন আশ্রয়ের পথ তো বটেই, এই ঘর এখন এক নতুন জীবনভাবনা—স্বপ্নের কাঠের ফ্রেমে বাঁধা এক আভিজাত্যের গল্প।
নোভা