ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৪ জুন ২০২৫, ১০ আষাঢ় ১৪৩২

বিখ্যাত অভিনেতা ও নাট্যকার তুলসী লাহিড়ীর জমিদার বাড়ি বিলুপ্তির পথে 

নিজস্ব সংবাদদাতা, গাইবান্ধা

প্রকাশিত: ১১:১৬, ২৪ জুন ২০২৫

বিখ্যাত অভিনেতা ও নাট্যকার তুলসী লাহিড়ীর জমিদার বাড়ি বিলুপ্তির পথে 

ভারত উপমহাদেশের বিখ্যাত নাট্যকার  ইতিাসের পাতায় লেখা নাম তুলসী লাহিড়ী। কে এই তুলসী লাহিড়ী অনেকেই হয়ত জানেন না। কেউ জানলে বা শুনে থাকলে জানেন না তার জন্ম ও কর্মময় জীবনের নানা স্মৃতি ও জীবন ইতিহাস।

কালের বিবর্তনে ক্রমান্বয়ে কালজয়ী এই মহাপুরুষের সবকিছুই আজ ঢাকা পড়ছে। তবুও এ নিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজের নেই কোন ভাবনা। গাইবান্ধা জেলার প্রায় ২৫ কি. মি. ও সাদুল্লাপুর উপজেলা থেকে ১২ কি. মি. দুরে নলডাঙ্গা ইউনিয়নে অবস্থিত ১৮৯৭ খ্রি. জমিদার পরিবারে তুলসী লাহিড়ীর জন্ম। তার পিতার নাম সুরেন্দ্রনাথ লাহিড়ী, মায়ের নাম শৈলবালা দেবী। পিতার সঙ্গীত গাওয়া চর্চায় তুলসী লাহিড়ীর হাতে খড়ি। পিতার অনুপ্রেরণায় তুলসি লাহিড়ী বিনোদন জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে গোটা উপমহাদেশে খ্যাতি অর্জন করেন।

নলডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের  চেয়ারম্যান  মো: আব্দুল গফুর বলেন, নলডাঙ্গার জমিদার বাড়িতে প্রখ্যাত সঙ্গীত জগতের পথিকৃত তুলসী লাহিড়ী জন্ম। সংস্কার ও মেরামতের অভাবে অবহেলিত জমিদার বাড়িটির অনেক পুরানো স্মৃতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অনতিবিলম্বে তুলসি লাহিড়ীর জন্মভুমি জমিদার বাড়ির হারানো অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারের নিকট জোর দাবি জানাচ্ছি।

স্মৃতি বিজড়িত ও ইতিহাস খ্যাত কালের সাক্ষী গৌরবজ্জ্বল জমিদার বাড়িটির চারিদিকে ঝোঁপ জঙ্গলে আর গাছপালায় ঘিরে ফেলছে। এক সময়ের ঐতিহ্যবহনকারী শৈশব কৈশোরের ধুলো বালি মাখা নানা স্মৃতি সম্বলিত তুলসি লাহিড়ীর সেই আদি নিবাসটি অযত্নে অবহেলায় আজ ম্লানের পথে।
তুলসী লাহড়ীর আদি নিবাসের নজরকাঁড়া নানা ধরনের স্মৃতি চিহ্নগুলো ধ্বংসলীলায় মুছে যাচ্ছে। ফলে এক সময়ের প্রাণচাঞ্চল্যে এই বাড়িটির দিকে কেউ আর ফিরে তাকায় না। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা দেশবরেন্যে নাট্যভিনেতা তুলসী লাহিড়ীর চিরচেনা জন্মভুমি বেহালদশার জমিদার বাড়িটি অনেকের কাছে অচেনা অজানা।


তিনি ছিলেন বাংলা ছায়াছবির জনপ্রিয় চিত্রনাট্যকার। তার নাটক  রচনা, ও অভিনয় দিয়ে ছিলেন বাংলা ছায়াছবির জনপ্রিয় চিত্রনাট্যকার। তার নাটক  রচনা, ও অভিনয় দিয়ে নাট্য আন্দোলনের এক নব দিগন্তের উম্মোচিত হয়েছিল।  প্রখ্যাত নাট্যশিল্পী, গীতিকার, সুরকার তুলসী লাহিড়ী একাধারে বি.এ. ও বি.এল. পাস করে তিনি প্রথমে রংপুর শহরে ও পরে কলকাতায় আলিপুর কোর্টে আইন পেশায় যোগদেন।

তুলসী লাহিড়ী (১৮৯৭-১৯৫৯) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের এক অসাধারণ প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব। নাট্যক্ষেত্রে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়; বিশেষ করে তাঁর লেখা ‘ছেঁড়া তার’ নাটকটি বাংলা নাট্যসাহিত্যের এক মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত। চলচ্চিত্র জগতেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। অভিনয়, চিত্রনাট্য রচনা এবং পরিচালনার মাধ্যমে তিনি বাংলা চলচ্চিত্রকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর গান এবং গীতিনাট্যও বাংলা সংস্কৃতিতে নিজস্ব স্থান করে নিয়েছে। গ্রামোফোন কোম্পানির সুরকার, বাংলা ছায়াছবির জনপ্রিয় চিত্রনাট্যকার, নাটক রচনা ও অভিনয় দিয়ে নাট্য আন্দোলনের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছিলেন তিনি। ২২ জুন তুলসী লাহিড়ীর ৬৬তম প্রয়াণ দিবস। ১৯৫৯ সালের এই দিনে কলকাতায় তিনি মারা যান।

নাট্যকার তুলসী লাহিড়ী ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ৭ এপ্রিল (২৩ চৈত্র, ১৩০৩ বঙ্গাব্দ) গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার নলডাঙ্গায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা- সুরেন্দ্রনাথ লাহিড়ী, মাতা- শৈলবালা দেবী, স্ত্রী- কৃষ্ণা প্রেমাঙ্গিনী দেবী। জমিদার পিতা সুরেন্দ্রনাথ লাহিড়ী খ্যাতিমান ক্লারিওনেট বাদক ছিলেন। রংপুরে তুলসী লাহিড়ীর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। রাজনৈতিক কারণে পড়ালেখা বন্ধ হবার উপক্রম হলে প্রকৃত নাম হেমেন্দ্র চন্দ্র লাহিড়ী বদলে তিনি তুলসী লাহিড়ী নাম গ্রহণ করেন। কলকাতা সারদা চরণ ইনস্টিটিউট থেকে ম্যাট্রিক, বঙ্গবাসী কলেজ থেকে আইএ এবং বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। রিপন কলেজ থেকে আইনশাস্ত্রে ডিগ্রি নেন। অল্প দিন পর এস্রাজ, তবলা ও সারেঙ্গীতে দক্ষতার স্বীকৃতি পান লক্ষৌয়ের মরিস মিউজিক কলেজ থেকে  স্নাতক ডিগ্রি অজর্ন করে।

প্রথমে বাবা সুরেন্দ্রনাথ লাহিড়ীর কাছ থেকে সঙ্গীতের প্রেরণা লাভ করেন তুলসী লাহিড়ী। এরপরে রংপুরে শ্রীতারাপ্রসন্ন সান্যালের কাছে অভিনয় শেখেন। শেষে ওস্তাদ জমিরুদ্দিন খাঁর সহযোগিতায় ১৯২৯-এ হিজ মাস্টারস্ ভয়েস থেকে নিজের লেখা দুইটি গানের রেকর্ড প্রকাশ করেন। এইভাবে সুরকার-গীতিকার-অভিনেতা হিসেবে তুলসী লাহিড়ীর আত্মপ্রকাশ ঘটে। নাট্যমঞ্চে ‘স্বয়ংবরা’, ‘পোষ্যপুত্র’, ‘মন্দির’ প্রভৃতি নাটকে সুর সংযোজন করেন। প্রগতিশীল নাট্যধারার সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হয় তাঁর।

কিন্তু, নীতি ও আদর্শগত বিরোধের ফলে ১৯৮১ খ্রীস্টাব্দে কলকাতার সিনেমা জগৎ ও গ্রামোফোনের জগৎ ছেড়ে দিয়ে জলপাইগুড়ি জেলায় জমি কিনে তুলসী লাহিড়ী চাষবাসের চেষ্টা করেন। সে সময়ই কৃষকজীবনের সঙ্গে তার প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটে এবং কৃষকদের জীবন নিয়ে সৃষ্টিশীল নাটক রচনার সূচনা হয়। জন্মস্থান গাইবান্ধা ও উত্তরবঙ্গের অভিজ্ঞতা, পারিবারিক শিক্ষা ও সংস্কৃতি, কৃষিজীবন সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং পঞ্চাশের মন্বন্তরের কঠিন আঘাত, বিশেষ আদর্শবোধ ও মূল্যবোধে আস্থা তাঁকে সৃষ্টিশীল নাটক রচনায় অনুপ্রাণিত করে। তিনি দক্ষ অভিনেতা হিসেবে কলকাতার ‘বহুরূপী’ ও ‘রূপকার’ নাট্যদলে অভিনয় করেন। অভিনয় করেন ৫২টি চলচ্চিত্রে। চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি নাটক ও চলচ্চিত্রের আবহ সংগীতে সুরারোপ করেন। এইচএমভি ও মেগাফোন কোম্পানির সাথেও কাজ করেন। গড়ে তোলেন একটি অর্কেস্ট্রা দল। তাঁর রচিত নাটকÑঠিকাদার, দু:খীর ইমান, ছেঁড়াতার, বাংলার মাটি, লক্ষ্মীপ্রিয়ার সংসার, মায়ের দাবি, এই যুগ, ঝড়ের মিলন, পথিক, মণিকাঞ্চন, মায়া-কাজল, চোরাবালি, সর্বহারা। এগুলোর মধ্যে পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে রচিত দু:খীর ইমান ও ছেঁড়াতার ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

উদীচী গাইবান্ধার সভাপতি অধ্যাপক জহুরুল কাইয়ুম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত এই গুণী শিল্পীর জন্মভিটা গাইবান্ধার নলডাঙ্গার জমিদারবাড়িটি আজ জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। তাঁর স্মৃতি সংরক্ষণে এখনও পর্যন্ত কোনো উল্লেখযোগ্য সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগ চোখে পড়েনি। এমতাবস্থায়, তাঁর পৈতৃক বসতবাড়িতে একটি স্মৃতি সংগ্রহশালা স্থাপন করা অত্যন্ত জরুরি। এই সংগ্রহশালায় তাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্র, পান্ডুলিপি, দুর্লভ ছবি এবং তাঁর কর্মজীবনের বিভিন্ন স্মারক সংরক্ষণ করা যেতে পারে।

স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মী ও বিশিষ্টজনরা মনে করেন, তুলসী লাহিড়ীর মতো একজন কিংবদন্তী শিল্পীর স্মৃতি সংরক্ষণ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত এই বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করে নলডাঙ্গায় তুলসী লাহিড়ীর বসতবাড়িতে একটি স্মৃতি সংগ্রহশালা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেবেন, এটাই প্রত্যাশা তাঁদের।

আঁখি

×