
৭ এপ্রিল ২০২৩ আমাদের মহান জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে
প্রকৃতপক্ষে বাঙালী জাতীয়তাবাদী হয়, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কর্মী হয়, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সাধারণ সৈনিক হয়, তাকে মনোনয়ন দেওয়া চলে। বিদেশী ডিগ্রি বা খেতাবধারী কেউ স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সমর্থক হলে বা রাষ্ট্রকে বিশ্বমহলে হাসির পাত্র বানালে বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করলে সে সাধু কথা বললেও তার রাজনীতি করার বা সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা থাকা উচিত নয়। প্রয়োজনে তার নাগরিকত্ব থাকবে কি-না তা-ও আইনের দ্বারা নির্ধারিত হতে পারে। আমাদের শাসনতন্ত্র/সংবিধান যেমন ৭(২) অনুচ্ছেদ মোতাবেক জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি এবং এর রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধান আমাদের পবিত্র কর্তব্য, তেমনি সংবিধানের সৃষ্টিকারী ‘জাতীয় সংসদের’ মর্যাদা রক্ষা করাও আমাদের মহাপবিত্র কর্তব্য। প্রার্থী বাছাইয়ের সময় এগুলো বিবেচনায় রাখলেই সার্থক হবে সংসদের প্রথম অধিবেশনের প্রথম বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া উক্তি- ‘এই সংসদের মর্যাদা যাতে রক্ষা পায়...(আমাদের)...ইতিহাসে যেন খুঁত না থাকে...যেন এমন একটি পর্লামেন্টারি প্রসিডিউর ফলো করতে পারি, যাতে দুনিয়া আমাদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।’
৭ এপ্রিল ২০২৩ আমাদের মহান জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনের প্রথম বৈঠকের সুবর্ণজয়ন্তী পূর্ণ হয়েছে। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ৩০০ জন এমপি নির্বাচিত হলে তাদের নিয়ে এক মাস পর ৭ এপ্রিল সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। তখন ছিল এখনকার মতো সংসদীয় গণতন্ত্র। এখন যেমন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদ নেতা, তখন তাঁর পিতা প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সংসদ নেতা। এর আগেও আমাদের সংসদ ছিল, যার নাম ছিল ‘গণপরিষদ’- যা কার্যকর ছিল আমাদের স্বাধীনতার সূচনালগ্ন থেকে।
একাত্তরের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পনেরো দিন পর ১০ এপ্রিল সত্তরের নির্বাচনে নির্বাচিত ৩০০ জন এমপিএ এবং ১৬৯ জন এমএনএ (মোট ৪৬৯ সদস্য) তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বর্তমান মুজিবনগরে জড়ো হয়ে ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ (Proclamation of Independence) নামক ‘প্রথম সংবিধান’ গ্রহণ করেন। এতে তাঁরা নিজেদের সমন্বয়ে ‘গণপরিষদ’ তথা সংসদ গঠন করেন, বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা ও প্রতিষ্ঠা করেন এবং তদ্বারা বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ (Declaration of Independence) নিশ্চিত করেন।
বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন ও ভারত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে পরের দিন ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি হিসেবে ‘প্রভিশনাল কনস্টিটিউশন অব বাংলাদেশ অর্ডার’ (বাংলাদেশের অস্থায়ী সংবিধান আদেশ বা পিসিবি অর্ডার) জারি করেন। আদেশ জারি করা রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক ক্ষমতা এবং এরকম কোনো অর্ডার আইনের সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত। এ ‘আদেশ’ তথা ‘দ্বিতীয় সংবিধানের’ মাধ্যমে তিনি সংসদীয় ব্যবস্থা চালু করেন। তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের আস্থাভাজন হিসেবে প্রধানমন্ত্রী হন, একটি পূর্ণাঙ্গ সংবিধান প্রণয়নের জন্য কমিটি গঠন করেন এবং সংবিধানে জনগণের কি কি অভিপ্রায় অন্তর্ভুক্ত থাকবে, সে বিষয়ে বিশদ নির্দেশনা দেন।
এ কমিটি নিরলস পরিশ্রম করে ৪ নবেম্বর সংসদে শাসনতন্ত্রের/সংবিধানের খসড়া উপস্থাপন করে। তার ওপর সদস্যদের বিতর্ক ও বিশদ আলোচনার পর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ এটি কার্যকর হয়। এরপর জাতীয় নির্বাচন আর এরপর ৭ এপ্রিল সংসদের প্রথম অধিবেশনের প্রথম বৈঠকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংসদের স্পিকারের (মুহম্মদুল্লাহর) উদ্দেশে বলেন, ‘যখন শাসনতন্ত্র তৈরি করা হয় তখন আপনি স্পিকার ছিলেন এবং জনাব বয়তুল্লাহ ডেপুটি স্পিকার ছিলেন। আপনারা সুষ্ঠুভাবে গণপরিষদের কার্য পরিচালনা করেছেন। আমাদের দেশের কাছে একটা সংবিধান দিতে পেরেছি, সেজন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ না দিয়ে পারছি না।’
একই ভাষণে সংসদের মর্যাদা রক্ষার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এই সংসদের মর্যাদা যাতে রক্ষা পায়, সেদিকে আপনি খেয়াল রাখবেন। কারণ আমরা যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছি, সে ইতিহাসে যেন খুঁত না থাকে। দুনিয়ার পার্লামেন্টারি কনভেনশনে যেসব নীতিমালা আছে, সেগুলো আমরা মেনে চলতে চাই। সঙ্গে সঙ্গে যেন এমন একটি পর্লামেন্টারি প্রসিডিউর ফলো করতে পারি, যাতে দুনিয়া আমাদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।’ অসাধারণ প্রত্যয় ও মনোবলের পরিচয় ছিল এ বক্তব্যে।
বিশ্বের সকল আইনসভার মধ্যে পুরনো ব্রিটিশ পর্লামেন্ট যেমন সংসদীয় পদ্ধতির গণতন্ত্রের সূচনা করে, তেমনি বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত পার্লামেন্টও বাংলাদেশে সংসদীয় পদ্ধতির গণতন্ত্রের সূচনা করে। সংসদ বা আইনসভা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন-প্রণয়ন কর্তৃপক্ষ। এ সংসদ জনপ্রতিনিধিগণের তথা এমপিগণের সমন্বয়, আইনপ্রণেতাগণের সমন্বয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট যেমন অস্টিনের ‘রাজার আদেশই আইন’ তত্ত্বের সীমানা পেরিয়ে হয়ে ওঠে আইন তৈরির মহান কর্তৃপক্ষ, তেমনি আমাদের সংসদও আইন তৈরির মহান কর্তৃপক্ষ। এ কর্তৃপক্ষের মর্যাদা রক্ষা বিষয়েই বঙ্গবন্ধু সেদিন বেদবাক্যের মতো দিক নির্দেশনা দেন- ‘এই সংসদের মর্যাদা যাতে রক্ষা পায়, সেদিকে আপনি খেয়াল রাখবেন...।’ আমরা গত পঞ্চাশ বছরে বঙ্গবন্ধুর উল্লিখিত ও প্রত্যাশিত মর্যাদা রক্ষা করতে পেরেছি কি-না, তা এক কঠিন প্রশ্ন।
গেল পঞ্চাশ বছরে সংসদে প্রায় বারো শতাধিক আইন প্রণীত হয়েছে যুগের প্রয়োজনে। তন্মধ্যে বঙ্গবন্ধু ‘পিসিবি অর্ডার’ নামক ২য় সংবিধান তথা সর্বোচ্চ আইন জারি করেন। এরপর তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বকালের ৩ বছর ৭ মাস ৩ দিনে বহু আইন তৈরি বা অনুমোদন করে আমাদের মহান সংসদ। ১৯৭২ সালে ১৫৭টি রাষ্ট্রপতির অর্ডার এবং ১টি অর্ডিন্যান্স জারি হয়, ১৯৭৩ সালে ৩৪টি আইন পাস হয়, ৩৩টি অর্ডার ও ৩৭টি অর্ডিন্যান্স জারি হয়, ১৯৭৪ সালে ৭৬টি আইন পাস হয়, ২৭টি অর্ডিন্যান্স জারি হয় এবং ১৯৭৫ সালে ৪৪টি আইন পাস হয়, ৪৩টি অর্ডিন্যান্স জারি হয়।
উল্লিখিত সময়ে মোট ৪৬২টি আইন তৈরি হয় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ও বুদ্ধিমত্তায়, যা ছিল সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত ও যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি রাষ্ট্রের জন্য এক অবাক করার মতো অভূতপূর্ব ঘটনা (সূত্র : সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য : ৭ এপ্রিল ২০২৩)। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, (বাঙালী) জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের প্রধান চার মূলনীতি হিসেবে সংবিধানের ৮(১) অনুচ্ছেদে স্বীকৃতি প্রদান। পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অনুচ্ছেদ ৭(২)-এ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক সকল আইন বা আইনাংশ বাতিল করার বিধান এবং অনুচ্ছেদ ২৬-এ ১৮টি মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক সকল ‘প্রচলিত আইন’ (যা বাহাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের পূর্ব পর্যন্ত চালু ছিল) বা নতুন আইনকে বাতিল করার বিধান।
অনুচ্ছেদ ১৫ক-তে অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানকে মৌলিক চাহিদা হিসেবে এবং ২৩-এ বাঙালি সংস্কৃতি ও ২৩ক-তে অবাঙালি সংস্কৃতি চর্চার অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান করাও এক ঐতিহাসিক আইনগত অগ্রগতি। সুখের বিষয় হলো, বঙ্গবন্ধুর আমলে প্রণীত আইনগুলোর কোনোটিই একাত্তরের পরাজিত শক্তি বা চেতনার পক্ষে ছিল না। সবই ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাপ্রসূত, বাঙালি জাতীয়তাবাদসম্মত, বঙ্গবন্ধুর আদর্শভিত্তিক ও মানবকল্যাণকর।
এসকল ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর অগ্রগতি দেখে ভীত হয় পাক-মার্কিন শক্তি এবং দেশীয় অপশক্তি।
সপরিবারে তাঁকে হত্যা করা হয় পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট। অতঃপর একুশ বছরের নির্বাসন পোহাতে হয় আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বলয়কে। ছিয়ানব্বই সালে নৌকার হাল ধরে যথার্থ কারণে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। তারপর আরও তিনবার। তাঁর চার আমলে সংসদের আইন তৈরির ক্ষেত্রেও বঙ্গবন্ধুর আমলের চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। আইনগুলোর নাম শুনলেই বোঝা যায় এগুলো সময়ের নিরিখে ভীষণ জরুরি, মানবহিতৈষী ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনসম্মত।
স্বল্প কয়েকটির নাম উল্লেখ করা আবশ্যক, যেমন- ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০১ সালের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০০৯ সালের তথ্য অধিকার আইন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় রংপুর আইন, পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প (ভূমি অধিগ্রহণ) আইন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন ও মোবাইল কোর্ট আইন, ২০১০ সালের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, পরিবেশ আদালত আইন, পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১১ সালের উদ্ভিদ সংগনিরোধ আইন, ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তি (পুনর্বাসন) আইন, ২০১২ সালের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৩ সালের শিশু আইন, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন, ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১৪ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড আইন, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা আইন, ২০১৫ সালের ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আইন, বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট আইন, ২০১৬ সালের বাংলাদেশ চা শ্রমিক কল্যাণ তহবিল আইন, ২০১৭ সালের স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখল আইন, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন আইন, ২০১৮ সালের বাংলাদেশ কলেজ আব ফিজিশিয়ানস্ অ্যান্ড সার্জনস্ আইন, বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট আইন, খ্রিস্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট আইন, বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, সরকারি চাকরি আইন, মানসিক স্বাস্থ্য আইন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৯ সালের বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ (স্বার্থরক্ষা) আইন, ২০২০ সালের আদালত কর্তৃক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার আইন, ২০২১ সালের সিভিল কোর্টস (সংশোধন) আইন, ২০২২ সালের জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন ইত্যাদি।
এগুলোর সবই জনগণের নাগরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মানবাধিকার সংরক্ষণকল্পে প্রণীত আইন। এসকল আইন প্রণয়ন করে জাতীয় সংসদ সাধুবাদ পেয়েছে, মহৎ হয়েছে।
পক্ষান্তরে আওয়ামীবিরোধী শক্তি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন জাতীয় সংসদ বহু মানবাধিকারপরিপন্থি আইন তৈরি করে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে। সেনাশাসক জিয়ার ইশারায় প্রেসিডেন্ট মোশতাক ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর যে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করে, তাতে সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার বিচার বন্ধ করা হয়। এ অর্ডিন্যান্সকে জাতীয় সংসদ তখনকার রাষ্ট্রপতি জিয়ার ইচ্ছায় ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী আইন দ্বারা বৈধতা প্রদান করা হয়। এ সংশোধনী আইনের মাধ্যমে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনকে তথা ‘লাঠিতন্ত্রকে’ বৈধতা দিয়ে গণতন্ত্রকে বিদায় দেওয়া হয়।
অনুরূপভাবে ১৯৮৬ সালের ১১ নবেম্বর সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী আইন পাসের মাধ্যমে জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনকে তথা ‘লাঠিতন্ত্রকে’ পুনঃবৈধতা দিয়ে গণতন্ত্রকে পুনঃবিদায় করা হয়। মূলত এ সংশোধনী আইনগুলো ছিল মানবাধিকার পরিপন্থি, যেগুলো তৈরি করার জন্য জাতীয় সংসদকে ব্যবহার করে কলুষিত করা হয়।
জাতীয় সংসদের আরেকটি দুঃখজনক অধ্যায় হলো-স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির অনুপ্রবেশ। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে যারা দানবের মতো ঘোষণা দিয়েছিল যে, তারাই হত্যাকারী, সেই পাকপন্থি অপশক্তির ধারকরা বন্দুকের গুলির ভয় দেখিয়ে জনগণের ভোট ছিনিয়ে নিয়ে তথাকথিত নির্বাচিত হয়ে যখন জোর করে সংসদে বসে, তখন পিশাচরূপী সদস্যদের ভারে মহান সংসদের মর্যাদা ও পবিত্রতা কি রক্ষিত হয়? যখন একাত্তরের ২৬ মার্চ ক্ষমতালিপ্সু সুযোগসন্ধানী ও পাকিস্তানি সোয়াত জাহাজের অস্ত্রখালাসী কোনো মেজর বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাকে অস্বীকার করে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বক্তব্য প্রচার করে এবং এক পর্যায়ে রাষ্ট্রক্ষমতা লুণ্ঠন করে মহান সংসদে প্রবেশ করে ভাষণ দেয়, তখন কি জাতীয় সংসদের মর্যাদা ও পবিত্রতা বজায় থাকে? যখন একাত্তরের ‘আন্তর্জাতিক অপরাধীরা’ (‘গণহত্যাকারী, যুদ্ধাপরাধী, শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধী বা মানবতাবিরোধী অপরাধীরা’) সংসদে বসে আর ক্রুর হাসি দেয়, তখন মনে হয় ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তকে, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমকে, অগুণিত আহত-পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার দগদগে ক্ষতকে তারা আবারও ঔদ্ধত্য দেখায়। তাই জননেত্রী শেখ হাসিনাসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিকশিত বাঙালি মাত্রেরই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন যে, কোনোক্রমেই যেন স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি কিংবা প্রকাশ্য বা ছদ্মবেশধারী দোসররা পবিত্র সংসদে অনুপ্রবেশ না করতে পারে।
পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশই একমাত্র রাষ্ট্র যেখানে স্বাধীনতাবিরোধী ও জাতির জনক হত্যাকারী শক্তি রাজনীতি করার, ভোটে দাঁড়াবার ও এমপি-মন্ত্রী হবার সুযোগ পেয়েছে। সংসদকে কলুষিত ও অপবিত্র করেছে। তাই দ্বাদশ সাধারণ নির্বাচনের আগেই সজাগ দৃষ্টি রেখে মনোনয়ন দেওয়া দরকার। সবসময় বিখ্যাত ব্যক্তিকে প্রার্থী না করলেও চলে। যদি অখ্যাত কোনো ব্যক্তিও প্রকৃতপক্ষে বাঙালী জাতীয়তাবাদী হয়, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কর্মী হয়, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সাধারণ সৈনিক হয়, তাকে মনোনয়ন দেওয়া চলে।
বিদেশী ডিগ্রি বা খেতাবধারী কেউ স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সমর্থক হলে বা রাষ্ট্রকে বিশ্বমহলে হাসির পাত্র বানালে বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করলে সে সাধু কথা বললেও তার রাজনীতি করার বা সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা থাকা উচিত নয়। প্রয়োজনে তার নাগরিকত্ব থাকবে কি-না তা-ও আইনের দ্বারা নির্ধারিত হতে পারে। আমাদের শাসনতন্ত্র/সংবিধান যেমন ৭(২) অনুচ্ছেদ মোতাবেক জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি এবং এর রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধান আমাদের পবিত্র কর্তব্য, তেমনি সংবিধানের সৃষ্টিকারী ‘জাতীয় সংসদের’ মর্যাদা রক্ষা করাও আমাদের মহাপবিত্র কর্তব্য।
প্রার্থী বাছাইয়ের সময় এগুলো বিবেচনায় রাখলেই সার্থক হবে সংসদের প্রথম অধিবেশনের প্রথম বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া উক্তিÑ ‘এই সংসদের মর্যাদা যাতে রক্ষা পায়...(আমাদের)...ইতিহাসে যেন খুঁত না থাকে...যেন এমন একটি পর্লামেন্টারি প্রসিডিউর ফলো করতে পারি, যাতে দুনিয়া আমাদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।’
লেখক : সাবেক ডিন, আইন অনুষদ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া এবং কেন্দ্রীয় আইন বিষয়ক সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বাংলাদেশ