ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

সুশাসনের প্রধান উপাদান জবাবদিহি

ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম

প্রকাশিত: ২০:৩৩, ২৪ জানুয়ারি ২০২৩

সুশাসনের প্রধান উপাদান জবাবদিহি

ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম

১৯৯০-এর দশক থেকেই শাসন প্রত্যয়টি বিশ্বব্যাপী নতুন করে গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক দাতাসংস্থাগুলো উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়নের পথে বাধা হিসেবে সুশাসনের অভাবকে চিহ্নিত করে থাকে। শাসনের গুণগতমান যে সব সময় এক রকম হবে, তা নয়। সে কারণে প্রাচীন গ্রিসে আজ থেকে ২৬০০ বছর আগে দার্শনিক প্লেটো আদর্শ শাসকের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, আদর্শ শাসক হবেন একজন দার্শনিক রাজা, যার ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পরিবার থাকবে না।

কারণ, এগুলো থাকলে একজন শাসক জনগণকে যে ধরনের ওয়াদা করেন, সে অনুযায়ী কাজ করতে পারবেন না। তিনি ব্যক্তিগত লোভে আসক্ত হয়ে পড়বেন। প্লেটোর পর থেকে আধুনিক যুগের দার্শনিকগণও উত্তম শাসনের বিষয়ে ভেবেছেন। জন লকের ভাষায়, উত্তম রাষ্ট্র হবে সেই রাষ্ট্র, যে রাষ্ট্র জনগণের জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির নিরাপত্তা দেয়। কার্ল মার্কস মনে করেন, শ্রমজীবী মানুষের সরকারই উত্তম সরকার। 
বৃহত্তর অর্থে নাগরিকদের কল্যাণের উদ্দেশ্য ভালোভাবে শাসন পরিচালনার নামই সুশাসন। জনগণকে দেওয়া সরকারের প্রতিশ্রুতি ও তার বাস্তবায়নকেই সুশাসনের আওতায় ভাবা যায়। তবে একটি দেশের সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় সেই দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্তর এবং সামাজিক পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সুশাসনের অন্তঃসার হচ্ছে সুষ্ঠু, বাস্তবায়নযোগ্য নীতি এবং নীতি বাস্তবায়নের জন্য একটি পেশাদারি আমলাতন্ত্র এবং শাসনবিভাগ, যা এর কর্মকা-ের জন্য জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক হবে।

সুশাসনের জন্য আরও প্রয়োজন জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ভূমিকা রাখতে আগ্রহী একটি শক্তিশালী সুশীলসমাজ। সর্বোপরি, সুশাসন তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে, যদি সমাজের সকল সদস্য আইনের শাসন মেনে চলে। বিশ্বব্যাংক (১৯৯৪) ‘শাসন বিশ্বব্যাংকের অভিজ্ঞতা’ শীর্ষক এক রিপোর্টে সুশাসনকে সরকারি খাতের ব্যবস্থাপনা, জবাবদিহি, উন্নয়নের জন্য আইনিকাঠামো, স্বচ্ছতা ও তথ্য- এ চারটি কার্যক্রম দ্বারা ব্যাখ্যা করেছে। সুশাসন বলতে এমন এক অবস্থাকে বোঝায়, যেখানে শাসনের স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা আছে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং সম্পদ এবং তা সুষম বিতরণের ফলে দরিদ্রতম এবং দরিদ্র নাগরিকে মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন করার সুযোগ দিয়ে থাকে। বস্তুত বর্তমান সময়ে সুশাসনের বিষয়টি চিন্তাজগতে কেবল ভালোলাগা না লাগার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই।

বরং সুশাসনের বিষয়টি এমন এক কার্যকরী প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে যে, যখন সম্পূর্ণ অর্থে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন সমগ্র রাজনৈতিক ব্যবস্থা টেকসই উন্নয়ন ও পরিবর্তনের দিকে ধাবিত হয়। শাসন তখনই ভালো বা সুশাসন হয় যখন সামাজিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর উপকার বা মঙ্গল করে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি হচ্ছে সুশাসনের প্রধান উপাদান। এটি সরকারের স্বচ্ছতা ও আইনের শাসনের ওপর নির্ভর করে। জবাবদিহির মাধ্যমেই সুশাসন প্রতিষ্ঠা পায়। শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেই নয়, বরং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সুশীল সমাজের জবাবদিহিও আবশ্যক।

দুর্নীতি কমাতে ও রাজনৈতিক উন্নয়নে জবাবদিহি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অন্যদিকে, আইন ও নীতিমান্য করে যখন কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন করা হয়, তখন তাকে স্বচ্ছতা বলে। সিদ্ধান্ত বা পরিকল্পনা প্রণয়নে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হলে সহজেই সঠিক তথ্য পাওয়া যায়। স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা পেলে সরকারি অর্থ ব্যয়ে দুর্নীতি অনেকাংশে কমে যায়। পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে প্রত্যেক নাগরিকের অংশগ্রহণ সুশাসনের অন্যতম একটি উপাদান। সুশাসনের মূল ভিত্তি নারী এবং পুরুষ উভয়রেই সমান অংশ গ্রহণ। বিশ্বব্যাংক মনে করে, সকলের অংশগ্রহণের মাধ্যমেই কার্যকরী উন্নয়ন সম্ভব। অংশগ্রহণের উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণকে অধিক ক্ষমতাশীল করা। রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে ভোটদান।
সুশাসনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে আইনের শাসন। এটি একটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ও বৈধ উপকরণ। মানবাধিকার নিশ্চিত করণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আইনের শাসন। প্রশাসনের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে আইনের শাসন থাকা দরকার। আইনের মাধ্যমেই স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা ও আধিপত্য রোধ করা যায়। আইন হতে হবে অবশ্যই নিরপেক্ষ। রাষ্ট্রের সংবিধান হচ্ছে একটি রাষ্ট্রের আইনের প্রধানতম উৎস। পক্ষপাতহীন অবস্থা বা নিরপেক্ষতাই পারে সুশাসন নিশ্চিত করতে।

সুশাসন ততক্ষণ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা পাবে না, যতক্ষণ না প্রশাসন নিরপেক্ষভাবে ভূমিকা পালন করে। নিরপেক্ষতা পেতে হলে মেধার ভিত্তিতে সরকারি চাকরি দিতে হবে। অন্যদিকে, দায়িত্বশীলতা না থাকলে কখনোই কোনো কাজ সুন্দরভাবে সম্পন্ন করা যায় না। সরকারি, বেসরকারি এবং ব্যক্তিগত প্রত্যেকটি কাজের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল হতে হবে। একমাত্র দায়িত্বশীলতাই পারে সঠিক সময়ে কাজ সম্পন্ন করতে। সুশাসন আনয়নের জন্য জনপ্রশাসনের উৎকর্ষ সাধন করতে হবে। এই উৎকর্ষ সাধন করার জন্য জনপ্রশাসনকে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও গতানুগতিক ধারা থেকে বের করতে হবে।

জনপ্রশাসনের উৎকর্ষ সাধন বলতে বোঝায় জনপ্রশাসনে দক্ষতা আনয়ন, প্রযুক্তি ব্যবহারকরণ ও কার্যকর কৌশল গ্রহণ করা। সুশাসনের আরেকটি উপাদান হচ্ছে বিকেন্দ্রীকরণ। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমেই সকল বিভাগ সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে। এটি প্রশাসনের কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা কমিয়ে দেয় এবং প্রশাসনকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়। 
তাই একটি রাষ্ট্রের সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারের প্রতিটি বিভাগে বিকেন্দ্রীকরণ অপরিহার্য। ইউনেস্কো সুশাসনের উপাদানের কথা বলতে গিয়ে বিশ্বব্যাংকের উপাদানগুলোর পাশাপাশি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অংশগ্রহণের কথাও বলেছে।

সাধারণভাবে সুশাসন বলতে এমন এক আদর্শ শাসনব্যবস্থাকে বোঝায়, যা একটি দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ঘটায়। অন্যভাবে, সুশাসন বলতে এমন এক ধরনের শাসনব্যবস্থাকে বোঝায় যা জবাবদিহি, স্বচ্ছতা, প্রশাসনিক দক্ষতা, আইনের অনুশাসন, মানবাধিকার ইত্যাদি বিষয়কে গুরুত্ব দেয়। সুশাসন আইনের শাসনেরই আরেক নাম। সুশাসন হলো যৌক্তিক এবং দক্ষভাবে শাসন পরিচালনা। সুশাসন অবশ্যই আইনের শাসনের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এটি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক জবাবদিহি নিশ্চিত করে। জবাবদিহি, স্বচ্ছতা, আইনের শাসন, মানবাধিকার, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ, সরকারের দক্ষতা ও সাড়া প্রদানের ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে সুশাসন প্রক্রিয়া।

বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের শাসনামলে উন্নয়ন হয়েছে যথেষ্ট- তা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। কিন্তু উন্নয়য়েনে অগ্রযাত্রার পথে বড় বাধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সুশাসন আর জবাবদিহির প্রকট অভাব। সরকার উন্নত দেশের যে স্বপ্ন দেখছে, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে দরকার সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা।


লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও পরিচালক-বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কো. লি.

×