ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অসময়ে ঝড়-বৃষ্টি ক্ষয়ক্ষতি

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ২০:৪৯, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২

অসময়ে ঝড়-বৃষ্টি ক্ষয়ক্ষতি

অসময়ে ঝড়-বৃষ্টি ক্ষয়ক্ষতি

মৌসুমী বায়ু বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে আষাঢ় শ্রাবণ মাসে। তবে তার রেশ খানিকটা ভাদ্র মাসকেও অনুরণিত করে। কিন্তু এবার শিউলি, শেফালি ফুলের মালা গাঁথা মাসটি যেন বর্ষণের ধারায় ক্লান্ত, বিমর্ষ, অবসন্ন। বৃষ্টি আমাদের যাপিত জীবনের আবশ্যকীয় প্রাকৃতিক সম্ভার হলেও অতিবর্ষণ কখনও জনজীবনে শান্তির বার্তা বয়ে আনে না। আবার নদী স্রোতে এবং বৃষ্টির ধারায় সিক্ত বাংলার পলিমাটির উর্বরতাও আসে নদী আর বর্ষণের এক অনন্য ভেজা পরিবেশ থেকে। যা এদেশের ফসল উৎপাদনেরও নিয়ামক শক্তি। যান্ত্রিক সভ্যতার নিত্য-নতুন উদ্ভাবনে প্রকৃতির শান্ত, স্নিগ্ধ, রূপময় পরিবেশ তার সহজাত প্রভাব প্রতিপত্তি থেকে অনেকটাই দূরে।

কার্বন সিঃসরণের দুঃসহ দাপটে গ্রীন হাউস ইফেক্টকেও বাংলাদেশসহ সারাবিশ্ব মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। নৈসর্গ বিশেষজ্ঞরা বলছেন তারই বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা কমে যাওয়া থেকে অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, পাহাড়ী ঢল, নদ-নদীর পানি উপচে পড়া সবই যেন এক, অভিন্ন শৃঙ্খলে আটকে পড়া। তাই গ্রীষ্মকালে দাবদাহ আগের মতো প্রকৃতির সন্তানদের তাড়িয়ে বেড়ায় না। অসহ্য দাবানলে বন-বনাঞ্চল উজাড় হয়ে যাওয়া ছাড়াও অগ্ন্যুৎপাতের মতো ধ্বংসযজ্ঞ মোকাবেলা করতে হচ্ছে বিশ্ববাসীকে। বৃষ্টির জন্য বর্ষাকাল পর্যন্ত এখন আর অপেক্ষাও করতে হয় না। যখন-তখন কিংবা যে কোন ঋতুতে ঘনঘোর মেঘের গর্জনে অবিশ্রান্ত বর্ষণের ধারায় নানা অঞ্চল প্লাবিত হয়ে জনজীবন হয়ে ওঠে বিপর্যস্ত। আমরা এখন শরৎকালের স্নিগ্ধতার প্রলেপকে স্বাগত জানানোর বিপরীতে নদ-নদীর উপচে পড়া পানির ঢলই শুধু নয়, সাগরের উত্তাল জোয়ার ও উপকূলবাসীর বিড়ম্বনা নিয়ে উদ্বিগ্ন।

এখানে উল্লেখ করা যায়, জ্যৈষ্ঠ মাস থেকে শুরু হওয়া সিলেটের আগাম বর্ষণ আর পাহাড়ী ঢল ছাড়াও মেঘালয়ের অবিশ্রান্ত বৃষ্টির ধারায় চা শিল্পের এই অনিন্দ্য সুন্দর নগরী যেভাবে বন্যার দুঃসহ কবলে পড়ে তা স্মরণকালের অনেক ইতিহাসকে অতিক্রমও করে যায়। সে সময় পানিতে ভেসে যাওয়া সুনামগঞ্জ থেকে সিলেটের অন্যান্য অঞ্চলের দুরবস্থার প্রেক্ষাপটে বলা হয়েছিল গত ১৮ বছরে মানুষ এমন বন্যা মোকাবেলা করেনি। কিন্তু পরবর্তীতে আরও দুর্ভোগের শিকার হয় সিলেট। আর এমন দুর্যোগের ধারা শেষ অবধি সমন্বিত হয় বর্ষাকালের অশ্রান্ত বৃষ্টির স্রোতে। শুধু তাই নয়, ধারণা করা হয়, গত অর্ধশত বছরেও সিলেটবাসী এমন অশ্রান্ত প্লাবন দেখেনি।
তেমনই আর এক ঋতু শরৎকাল। সেখানে শুধু সাদা মেঘের ভেলাই নয় রোদ আর বৃষ্টির ধারায় নৈসর্গের যে অভিনব দৃশ্য তাও কবি সাহিত্যিকদের নান্দনিক সত্তার অনুষঙ্গ হয়েছে। আবার সেই শরৎকালেই নতুন করে অবিশ্রাম ধারায় বৃষ্টিপাতই নয়, তার প্রতিক্রিয়ায় নদ-নদীর পানি বেড়ে যাওয়া ছাড়াও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়াও এক দুঃসহ পালাক্রম। জোয়ারের অশ্রান্ত দাপট বিভিন্ন অঞ্চলকে ভাসিয়ে দিচ্ছে। গত ১১ সেপ্টেম্বর রবিবার থেকে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে সারাদেশেই বৃষ্টিপাত হয়েছে। কোথাও কম আবার কোথাও বেশি বৃষ্টির রেকর্ড হয়েছে। বরিশালেও তেমন বৃষ্টির অবিরাম ধারায় ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাটসহ অনেক কিছুই পানিতে তলিয়ে যায়।

বরিশালে রবিবার থেকে মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত বৃষ্টির ধারা বর্ষিত হয়েছে ৪১৭.৩ মিলিমিটার। অথচ পুরো সেপ্টেম্বর জুড়েই এই অঞ্চলে বৃষ্টি হওয়ার কথা মাত্র ২৫৯ দশমিক ৪ মিলিমিটার। অর্থাৎ ২ দিনের কিছু বেশি সময়েই পুরো মাসের চাইতে কতখানি বৃষ্টি বাড়তি হয়েছে ভেবে দেখলে বিস্মিত হতে হয়। জানি না সেটাই প্রাকৃতিক দূষণের রুষ্টতা কিনা। সব কিছু নিয়ে এসব ভাবাটা বিবেচনায় রাখা যেন পরিস্থিতির দাবি। তবে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপ ক্রমশ স্থলভাগের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তারই পরিণতিতে আগেই উপকূলীয় অঞ্চলসমূহ বিধ্বস্ত হয়। তবে তা দুর্বল হতে হতে বৃষ্টি আরও ২ থেকে ৩ দিন বর্ষিতও হয়েছে। যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়ে নিম্ন আয়ের অতি সাধারণ জনগণ। যারা দৈনিক শ্রম মজুরিতে তাদের প্রাত্যহিক জীবন মান এগিয়ে নেয়।

প্রচণ্ড বৃষ্টিপাতে কাজ করতে না পারলে তাদের ঠিকমতো খাবারও জোটে না। বৃষ্টির কারণে বাইরে বের হওয়াও অসম্ভব হয়ে পড়ে। তার ওপর অতি সাদামাটা বাড়িঘরও পানিতে ডুবে যেতে সময় লাগে না। আবার প্রতিদিনের বাজার ব্যবস্থায় দ্রব্যমূল্যের যে বেহাল দশা বৃষ্টির পানিতে তা আরও ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। আর দক্ষিণ উপকূলের নদ-নদীতে অবিরাম জোয়ারের তা-বে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠী কোথায় গিয়ে নিজেদের সুরক্ষিত রাখবে ধারণাই করা যায় না। যেন মুহূর্তের প্রলয়ে সব তছনছ হওয়ার যোগাড়। সংশ্লিষ্ট নদীর পানি বিপদসীমার কয়েক (১৩ সে.মি.) সেন্টিমিটার উপরে বয়ে যাওয়া এক অবর্ণনীয় দুর্দশা। সংশ্লিষ্ট বাঁধ তো পানির অতলনীয় ধারায় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পড়ে যায়। বরিশাল উপকূল রক্ষা বাঁধের ৮২ কিলোমিটারে অন্তত ৪০টি স্থান ভাঙ্গনের কবলে চরম ঝুঁকিতে আছে।

আবার দক্ষিণের মৎস্য সম্পদের এক বিরাট অংশজুড়ে থাকে হরেক রকম দেশীয় মাছের ঘের। চিংড়ি, ট্যাংরা, পাঙ্গাস, শৈল এমনকি রুই-কাতলাও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা ঘেরেই চাষাবাদ করেন। সামান্য পানিতে শত শত বিঘার ঘের তলিয়ে যাওয়ার দুর্ভোগও সংশ্লিষ্ট মৎস্যজীবীদের সামলাতে হয়। বাংলাদেশের সুন্দরবন হরেক রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগকে মোকাবেলা করে টিকে থাকা ও টিকিয়ে রাখার যে ঐতিহাসিক ও জাতীয় দায়িত্ব পালন করে যায়- প্রবল বৃষ্টি সেখানেও হানা দিচ্ছে। বনের বন্যপ্রাণী থেকে শুরু করে হরেক প্রজাতির প্রাণিকূলও চরম হুমকির আবর্তে। এসব পানিতে দুর্গত এলাকায় মাঠের ফসলি ক্ষেতের যে সমূহ ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে সেটাও উপেক্ষা করার মতো নয়।
এদিকে টানা বৃষ্টিতে যমুনা নদীর পানি বাড়ার অসহনীয় অবস্থা উঠে এসেছে। টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় সিরাজগঞ্জসহ সংশ্লিষ্ট নিম্নঞ্চল পানির স্রোতে নাকাল অবস্থায়। অসময়ে পানি বেড়ে যাওয়ায় অনেক খাল-বিলও তলিয়ে গেছে। যমুনা নদীর চর ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় ফসলি ভূমি পানিতে তলিয়ে যাবার চরম দৃশ্য সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে। কয়েকদিন ধরে যমুনার পানি বাড়লেও মাঝখানে একদিন তা কিছুটা কমার চিত্র স্বস্তিদায়ক ছিল। কিন্তু পরবর্তী বৃষ্টির অবিরাম ধারায় যমুনা নদীর পানি বেড়ে যাওয়া ছাড়াও চার পাশের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়াও পরিস্থিতির নির্মম সঙ্কট। অসময়ের এই টানা বৃষ্টিপাতে মৌসুমী কিছু ফসল পানিতে ডুবে যায়।

রোপা আমন, মাষকলাই আর সবজির ক্ষেত বৃষ্টির পানিতে নিমজ্জিত। ফসলের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্তৃপক্ষ উদ্বিগ্ন। ইতোমধ্যে ক্ষয়ক্ষতির সামগ্রিক মূল্য নির্ধারণও প্রাসঙ্গিক বিষয়ের আওতায়। সিরাজগঞ্জের চার পাশেই সামান্য পানিতে বসতভিটাসহ রাস্তাঘাটও পানিতে ডুবে যায়। সংশ্লিষ্ট অধিবাসীদের দুর্ভোগের অন্ত থাকে না। নদী তীরবর্তী জনজীবনের এটাই প্রতিদিনের চিত্র। হয় নদীমাতৃক বাংলার রূপ শৌর্য অবগাহন করা নয় তো বা বৃষ্টির অবিরাম ধারা আর নদীর উপচে পড়া পানির স্রোতে নিজেদের ভাসিয়ে নেয়া যেন চিরকালের এক অবধারিত দ্বৈত সত্তা। তেমন যাপিত জীবনের অস্তিত্বের তাড়নায় মিলেমিশে একাকার হয়ে এগিয়ে যাওয়া যেন এক প্রকার নিয়ম বিধি।
আর লাগাতার বৃষ্টিতে বৃহত্তর ঢাকা নগরী কোথায় গিয়ে অবস্থান করে তা যেন এক নয় ছয়ের বিসদৃশ। উন্নয়নের দুরন্ত অভিগামিতায় অবকাঠামোর দৃষ্টিনন্দন অভিযোজনে রাজধানীর যে ক্রমবর্ধমান এগিয়ে চলা তার সম্মুখ-সমরের প্রতিক্রিয়া যেন নগরবাসীর নিত্য লড়াই। মেট্রোরেলের আধুনিক প্রযুক্তির নতুন ব্যবস্থাপনায় যে সাজ-সাজ রব সেখানে বিপরীত প্রভাবগুলো যে কি মাত্রায় নগরবাসীকে নাজেহাল করে রাখে সত্যিই বর্ণনার অতীত। রাস্তার মাঝখানে খানা, খন্দ, গর্ত খোঁড়াখুঁড়ি ছাড়াও চার পাশে উন্নয়নের সামগ্রিক উপকরণের ছড়াছড়ি মনে হয়, রাস্তা নয় নির্মাণাধীন কোন ভবনের চতুর্দিক। তাও আবার এলোপাতাড়ি ব্যবস্থাপনায় দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য।

আর সামান্য বৃষ্টিতে জমাটবদ্ধ পানি ছাড়াও উন্নয়ন কর্মযোগে ব্যবহৃত পানিও তার সঙ্গে মিলেমিশে একাত্ম হয়। লাগাতার বৃষ্টি ও অসহনীয় যানজটে যাত্রীদের বেহাল দশা কল্পনার অতীত। ১ ঘণ্টা রাস্তা অতিক্রম করতে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা সময় ব্যয় হচ্ছে। মানুষের জীবনের মূল্যবান সময়টুকুর অপচয় হওয়ার চিত্র সবাইকে অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। ১১ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টির বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় সারা সপ্তাহ ধরে যেন রাস্তাঘাটের অচলাবস্থায় বৃহৎ ও ক্ষুদ্র যানের চরম বিপত্তির সীমা পরিসীমা নেই। ১৮ সেপ্টেম্বর থেকেও নি¤œচাপের কারণে বৃষ্টির ধারা বর্ষণের চিত্র দৃশ্যমান হচ্ছে। তেমন বর্ষণসিক্ত পরিবেশ ২/৩ দিন ছাড়া না কমার বিষয়টিও সবার জানা। কিছু কিছু অঞ্চলে ভারি বৃষ্টিপাতও হচ্ছে। বিশেষ করে উপকূলীয় জায়গায়। নতুন করে প্লাবন সৃষ্টি হওয়াকে কতটুকু আটকানো যাবে বলা মুশকিল।

বরিশাল, সিলেট, বরগুনাসহ ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ ছাড়াও দেশের অন্যান্য জায়গায়ও বৃষ্টিপাতের রেকর্ড করা হচ্ছে। এ বৃষ্টিতে শুধু উপকূলীয় জেলাসমূহসহ দেশের নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন যে দুর্ভোগ তাও কোনভাবেই স্বস্তিদায়ক নয়। আর সংশ্লিষ্ট যাত্রীদের যে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় সেটাও যেন প্রচ- বৈরী আবহাওয়ার নির্মম যাতনা। জানি না সারা বাংলাদেশ এমন সব বিপর্যয় থেকে কবে বেরিয়ে আসবে। তবু আমরা একটি সুন্দর, আধুনিক, সমৃদ্ধিশালী দেশের প্রত্যাশায় অপেক্ষমাণ থাকতে চাই।

লেখক : সাংবাদিক

×