
.
আলোচনা এবং চাপ প্রয়োগের দ্বৈত নীতিতে এগোচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চলমান বাণিজ্য আলোচনা এবং মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) সম্পাদনে তেমন অগ্রগতি হচ্ছে না। একই অবস্থা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও। টানা দুই দিনের বৈঠকে সুনির্দিষ্ট কোনো ফল আসেনি। তবে আজ (শুক্রবার) শেষ দিনে ইতিবাচক ফল আসবে বলে আশা করছেন বাংলাদেশের নেতারা। এরই মধ্যে সুযোগের সন্ধানে নেমেছেন যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকরা।
নতুন অর্ডার তো দিচ্ছেনই না, খালাসের অপেক্ষায় থাকা পণ্যের দামও কমাতে চাপ দিচ্ছেন তারা। স্বাভাবিক কারণেই দেশীয় রফতানিকারকরা ধর্ণা দিচ্ছেন সরকারের কাছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিশেষ প্যাকেজ সহায়তা চান তারা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস মিনিস্টার গোলাম মর্তুজা এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক ইস্যু নিয়ে আলোচনার প্রথম দিন শেষ হয়েছে। কাল, পরশুও আলোচনা চলবে। যুক্তি-তর্কে অধিকাংশ বিষয়ে দুই পক্ষ একমত হয়েছে। তবে এখনই শুল্ক ইস্যু নিয়ে মন্তব্য করা যাবে না।’ বৃহস্পতিবার ভোরে বাংলাদেশ সময় রাত ৩টায় এ স্ট্যাটাস দেন তিনি। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিতীয় দফা শুল্ক আলোচনার প্রথম দিন শেষ হয়েছে।
আলোচনায় বেশিরভাগ ইস্যুতেই উভয় পক্ষ একমত হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্য সম্পর্কের প্রায় সব ক’টি গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়ে এই বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। তিনি জানান, বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত ৯টায় উভয় পক্ষ ফের বৈঠকে বসবে। শুক্রবারও আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে।
অপর এক ফেসবুক পোস্টে বাণিজ্য উপদেষ্টার সঙ্গে কথা হয়েছে জানিয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান লিখেছেন, ‘প্রথম দিনের আলোচনার পরিধি ছিল ব্যাপক। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে কৃষি, বাণিজ্য, জ্বালানি, মেধাস্বত্বসহ সব সেক্টরের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিল। আমাদের প্রতিনিধি দল তাদের সমস্ত প্রশ্নের ব্যাখ্যা দিয়েছে ও তাদের বক্তব্য শুনেছে।’ আজ মার্কিন বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বাণিজ্য উপদেষ্টার বৈঠক হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন আমাদের আলোচনার পরিসমাপ্তি পর্যন্ত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে।’
বাংলাদেশের পক্ষে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন আলোচনায় বাংলাদেশ পক্ষের নেতৃত্ব দেন। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খালিলুর রহমান ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব ভার্চুয়ালি আলোচনায় যুক্ত হন। সকালেই ঢাকা থেকে ওয়াশিংটন পৌঁছে সরাসরি বৈঠকে অংশ নেন বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান ও অতিরিক্ত সচিব ড. নাজনীন কাওসার চৌধুরী। অন্যদিকে বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে কৃষি, জ্বালানি, বাণিজ্য ও কপিরাইট বিষয়ক সংস্থাগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যোগ দেন।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ (ইউএসটিআর) কর্মকর্তাদের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা আলোচনার প্রথম বৈঠকে একটি দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে আলোচনা হয় যা বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র আরোপিত ৩৫ শতাংশ শুল্ক থেকে অব্যাহতি দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে মিটিং শুরুর আগে ওয়াশিংটন থেকে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দীন বলেন, ‘সচেতনভাবেই সার্বিক ইস্যুটি আমাদের পর্যালোচনায় রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় শুধু শুল্ক ইস্যু নয়, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের বিষয়েও প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে দেশের জন্য যেটা বেস্ট হবে, সে বিষয়গুলো নিয়েই বৈঠকে আলোচনা হবে।’ তিনি বলেন, সার্বিকভাবে দেশের স্বার্থ রক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আলোচনার মাধ্যমে ভালো কিছু পাওয়া যাবে বলেই আশা প্রকাশ করেন তিনি।
জানা যায়, বাংলাদেশের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে চিঠি দেওয়ার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র থেকে চুক্তির কিছু ডকুমেন্টও পাঠানো হয়েছে, যা আগামী ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। সেখানে সামরিক সরঞ্জাম, এলএনজি, গম, কৃষিপণ্য, তুলা, উড়োজাহাজসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানি সহজীকরণের কথা বলেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর বাইরে প্রস্তাবিত চুক্তির এনেক্সার ডকুমেন্ট দিয়েছে দেশটি। শুক্রবার পর্যন্ত তিনদিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তরের (ইউএসটিআর) কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের আলোচনা চলবে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, ইউএসটিআর কর্মকর্তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে শুল্ক ছাড় দেওয়ার ব্যাপারে নমনীয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আর শুল্ক ছাড় দেওয়া হলেও যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানির কারণে বেসরকারি খাতের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই। সরকারিভাবেও যুক্তরাষ্ট্র থেকে বোয়িংয়ের উড়োজাহাজ কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। পাশাপাশি গত এপ্রিল থেকেই দেশটি থেকে এলএনজি, গম ও তুলা আমদানি বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার।
এদিকে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে দেওয়া মার্কিন সরকারের চিঠির প্রেক্ষিতে ‘শক্ত’ হয়ে গেছেন দেশটির আমদানিকারকরা। নতুন অর্ডার তো দিচ্ছেনই না, উল্টো বিদ্যমান অর্ডারের দাম কমাতে চাপ দিচ্ছেন তারা। বাড়তি শুল্ক আরোপের ফলে পণ্য খালাসে যে বাড়তি ব্যয় হবে তার ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট হারে শেয়ার করার জন্য রপ্তানিকারদের চাপ দিচ্ছেন তারা। রপ্তানিকারকরা জানান, নতুন শুল্ক নিয়ে তৈরি হওয়া অনিশ্চয়তা তাদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে যেসব পণ্যের অর্ডার দেওয়া হয়ে গেছে কিন্তু এখনো পাঠানো হয়নি, সেগুলোর খরচ ভাগাভাগি নিয়ে ক্রেতারা নতুন করে আলোচনা শুরু করায় এই উদ্বেগ আরও বেড়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের কাছে বিশেষ সহায়তা প্যাকেজ চান রপ্তানিকারকরা।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস বায়িং হাউস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি কাজী ইফতেখার হোসেন এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশের পণ্যে ভিয়েতনামের চেয়ে ১৫ শতাংশ বেশি ট্যারিফ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করতে হয়, তা হলে এর ১০ শতাংশের মতো ভার সরবরাহকারীর ওপর সেখানকার ক্রেতারা দিতে চাইবে, এটা স্বাভাবিক। তিনি বলেন, এভাবে যদি বাড়তি ব্যয় ভাগাভাগি করতে হয়, তা হলে চূড়ান্তভাবে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরাই লোকসানে পড়বে এবং দীর্ঘমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি বাজার ধরে রাখতে পারবে না।
তার মতে, চলতি মাসের ১০ তারিখের পর চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য শিপমেন্ট করা হলে ওই পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বন্দরে পৌঁছাতে আগস্ট পার হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে নতুন আরোপ করা ৩৫ শতাংশ হারে শুল্ক দিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার। ২০২৪ সালে দেশটিতে রপ্তানি হয়েছে প্রায় ৮.৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। এ কারণেই রপ্তানিকারকদের উদ্বেগ বেশি।
প্যানেল মজি