
ছবি: জনকণ্ঠ
জুলাই-আগস্ট ২০২৪ সালে ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং দীর্ঘ এক যুগের গুম-খুনের ঘটনায় ইতোমধ্যে পাঁচ শতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থায়। এর মধ্যে রংপুরের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যা, চাঙ্খারখারপুলের আনাসসহ ছয়জনকে হত্যার ঘটনা এবং আশুলিয়ায় ছয়জনকে পুড়িয়ে হত্যাসহ অন্তত চারটি মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হয়েছে।
প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম জানান, খুব শিগগিরই রামপুরায় ভবনের কার্নিশে ঝুলে থাকা তরুণকে গুলি, যাত্রাবাড়ি, মিরপুর এবং উত্তরায় নির্বিচারে চালানো গুলির ঘটনাগুলোর তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া যাবে। তার আশা, জুলাইয়ের শেষ দিকে অথবা আগস্টের প্রথম সপ্তাহেই শেখ হাসিনার মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হবে।
সরকারি চাকরিতে কোটার সংস্কার দাবিতে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন দ্রুত রূপ নেয় ফ্যাসিবাদবিরোধী গণআন্দোলনে। সরকারের কঠোর প্রতিরোধ নীতির অংশ হিসেবে মাঠে নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং ক্ষমতাসীন দলের সন্ত্রাসী বাহিনী। জুলাই ও আগস্ট মাসজুড়ে চলা এই দমন অভিযানে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে নির্বিচার গুলি, গ্রেফতার, নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড।
স্বাধীনতার পর এত বিস্তৃত ও সহিংসভাবে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন দমন করার নজির নেই—বলছেন বিশ্লেষকরা। প্রসিকিউশনের তথ্য অনুযায়ী, ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পরই জনগণের দাবিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এসব ঘটনার বিচার শুরু করে।
বর্তমানে দুটি ট্রাইব্যুনালে বিচারকাজ চলছে পূর্ণাঙ্গভাবে।
*ট্রাইব্যুনাল-১: দুটি মামলায় চার্জ গঠনের পর্যায়ে
*ট্রাইব্যুনাল-২: দুটি মামলার অভিযোগ আমলে নেওয়া হয়েছে, চারটি শুনানির পর্যায়ে রয়েছে
তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশনের হাতে থাকা অভিযোগগুলোর মধ্যে বড় একটি অংশ গুম-খুন সংক্রান্ত, যা ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত সময়কালব্যাপী সংঘটিত। বাকি অভিযোগগুলো মূলত ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের সময় নিহত বা আহতদের নিয়ে।
প্রসিকিউটর তামিম বলেন, “আমরা চাই না বিচারের নামে অবিচার হোক। ন্যায়বিচার করতে হলে আইনের প্রতিটি ধাপ ঠিকমতো অনুসরণ করতেই হবে। একটি ঘটনাকে বিচারের জন্য উপস্থাপন করতে হলে গোটা দেশের প্রেক্ষাপট ও ঘটনাগুলো তদন্ত শেষে উপস্থাপন করা উচিত।”
তিনি আরও বলেন, “বিচারকে গতিশীল করতে হলে শুধু তদন্ত সংস্থা বা আদালত নয়, আহত ও নিহতদের স্বজনদেরও এগিয়ে আসতে হবে। ৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের বিচারে যেমন ৪০-৫০ বছর আগের ঘটনার একমাত্র সাক্ষীর কথাই বিশ্বাস করতে হয়েছিল আদালতকে, এবার অনেক বেশি ভিডিও, অডিও এবং সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রমাণাদি রয়েছে। সেগুলোকে শক্তিশালী করতে প্রয়োজন প্রত্যক্ষদর্শী বা জীবিত সাক্ষ্য।”
এক প্রশ্নের জবাবে প্রসিকিউটর বলেন, “নির্বাচন সামনে, এ কারণে কি বিচার প্রক্রিয়া আটকে আছে? আমি বলব, এটাই ন্যায়বিচারের সবচেয়ে বড় বাধা। আমাদের কাজ হলো আইনি প্রক্রিয়ায় অপরাধ প্রমাণ করা—কে সরকারে থাকবে বা কে যাবে, এটা আমাদের বিবেচনার বিষয় নয়।”
তিনি বলেন, “আমরা ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন এবং ২০১০ সালের বিধিমালা অনুসরণ করেই বিচার পরিচালনা করব। আসামিকে আইন অনুযায়ী যতদিন সময় দেওয়ার দরকার, ততদিনই দেওয়া হবে। কেউ বেশি পাবে না, কমও না।”
প্রসিকিউটর তামিমের মতে, “যেভাবে ৭১ সালের বিচারের নানা বিতর্ক আজও রয়ে গেছে, ২০২৪ সালের বিচার যদি দলনিরপেক্ষভাবে এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে হয়, তবে ১০০ বছর পরও এই বিচারকে মানুষ ন্যায়বিচার হিসেবে দেখবে।”
তিনি বলেন, “এবার আমরা শুধু কথা বা স্মৃতির ওপর নির্ভর করছি না। এবার আমরা ডকুমেন্টারি এভিডেন্স, ভিডিও ফুটেজ, পত্রিকার রিপোর্ট, প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্যসহ অনেক প্রমাণ দাখিল করব, যা আন্তর্জাতিক মানে বিচার প্রক্রিয়াকে গ্রহণযোগ্য করবে।”
ছামিয়া