ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২২ মে ২০২৫, ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

‘সকল পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত’ ॥ মানবিক করিডর নিয়ে আলোচনা হয়নি, হবেও না ॥ খলিলুর রহমান

এবার এইড চ্যানেলের প্রস্তাব 

মীর্জা মসিউজ্জামান

প্রকাশিত: ২৩:১৪, ২১ মে ২০২৫; আপডেট: ০০:০৭, ২২ মে ২০২৫

এবার এইড চ্যানেলের প্রস্তাব 

জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং রোহিঙ্গা সমস্যা বিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমান

মানবিক করিডর নয়, জাতিসংঘের প্রস্তাবে রয়েছে এইড চ্যানেল বা ত্রাণ ‘চ্যানেল’। মানবিক করিডর ছাপিয়ে এখন আলোচনায় এসেছে ত্রাণ চ্যানেল। বহুল আলোচিত ‘মানবিক করিডর’ নিয়ে অবস্থান স্পষ্ট করতে গিয়েই আলোচনায় উঠে এসেছে এই এইড চ্যানেল বা ত্রাণ চ্যানেলের প্রস্তাব।

অন্তর্বর্তী সরকারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘এইড চ্যানেল নিয়ে আলোচনা হতে পারে। তবে সকল পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে।’ 
রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্ন অবস্থানের কারণে সরকারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বিষয়টি খোলাসা করেছেন। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, করিডরের বিষয় অস্তিত্বহীন। এটা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি, হবেও না। তবে ত্রাণ ‘চ্যানেল’ দেওয়ার প্রস্তাব বিবেচনা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, ‘আরাকানে এইড ও অন্যান্য উপকরণ সাপ্লাই দেওয়া যাচ্ছে না, তাই জাতিসংঘ সেখানে তার বিভিন্ন সহযোগীদের মাধ্যমে রাখাইনে মানবিক সাহায্য পৌঁছে দিতে চায়। এখানে করিডরের প্রয়োজনীয়তা নেই। যেটা প্রয়োজন আছে সেটা হচ্ছে ত্রাণ-সাহায্য পৌঁছে দেওয়া।’ 
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ‘করিডর’ নিয়ে কারও সঙ্গে আলোচনা করেনি। কিন্তু বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ত্রাণ সরবরাহের একটি ‘চ্যানেল’ তৈরির জাতিসংঘের প্রস্তাব বাংলাদেশ বিবেচনা করছে।
বিশ্লেষকরা অবশ্য করিডরের ভালো-মন্দ উভয় দিকই তুলে ধরেছেন। তবে করিডর ইস্যুটি মানবিক হলেও নিরাপত্তা, অস্ত্র ও মাদক পাচারের মতো অপব্যবহারের ঝুঁকির বিষয়টিও সামনে উঠে এসেছে। তারা বলছেন, মানবিক করিডরের সফলতা নির্ভর করে অনেকগুলো ফ্যাক্টরের ওপর। যে অঞ্চলে মানবিক করিডর হবে সেখানকার বিবদমান পক্ষ একমত হলে করিডর পরিচালনা সহজ হয়। কিন্তু সবাই রাজি না হলে তা হয় কঠিন।
মানবিক করিডর বনাম এইড চ্যানেল ॥ সংঘাতে জড়িত পক্ষগুলোর সম্মতিতে নির্দিষ্ট এলাকা ও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিরাপদভাবে সহায়তা পৌঁছানোর পথই মানবিক করিডর। তবে কার্যকর করতে হলে সব পক্ষের সম্মতি ও সহযোগিতা আবশ্যক। অনেক সময় মানবিক করিডর রাজনৈতিক বা সামরিক স্বার্থে ব্যবহৃত হয়। অস্ত্র ও মাদক পাচার, ভূখ  দখল কিংবা কৌশলগত সুবিধা অর্জনের জন্য এটি অপব্যবহারের ঝুঁকিও বহন করে। 
তবে মিয়ানমার যদি বাংলাদেশকে অনুরোধ করে তাদের সাহায্য করার জন্য তাহলে মিয়ানমার এবং জাতিসংঘের  খাদ্য সহায়তা পৌঁছানোর জন্য বাংলাদেশ এইড চ্যানেলের মাধ্যমে সাহায্য করবে। তবে সে এইড চ্যানেল দেওয়ার ব্যাপারেও সরকার জনপ্রতিনিধিসহ সকলের সঙ্গে আলোচনা করার মাধ্যমেই সে সিদ্ধান্ত নেবে। তা অবশ্যই বাংলাদেশের কল্যাণের জন্য।
উল্লেখ্য, এইড চ্যানেল হলো ‘সমস্যাগ্রস্ত এক দেশে খাদ্যসামগ্রী পাঠানোর জন্য দেশের অভ্যন্তরে কোনো রাস্তা না থাকলে প্রতিবেশী দেশের সীমানা ব্যবহার করে সমস্যাগ্রস্ত দেশে ত্রাণসামগ্রী পাঠানোর রাস্তাকে বলা হয় এইড চ্যানেল।
মানবিক করিডরের ঝুঁকি কতটা ॥ অনেক ক্ষেত্রে এমন করিডরের রাজনৈতিক ও সামরিক অপব্যবহারের ঝুঁকি থাকে। আবার অস্ত্র পাচার এবং দখল করা এলাকায় জ্বালানি চোরাচালানের জন্যও এই করিডর ব্যবহৃত হওয়ার আশঙ্কা থাকে বলে মত দিয়েছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, এনআরসি বলছে এ ধরনের করিডরের সুরক্ষা ও প্রবেশাধিকার অনেকটা সীমিত থাকে।

যে এলাকায় সংঘাত হয় সেখানে নির্দিষ্ট মানবিক করিডরে নিরাপদে পৌঁছানোও ত্রাণকর্মী ও বেসামরিক নাগরিকদের জন্য অনেক সময় কঠিন হয়ে যায়। তাদের দাবি, মানবিক করিডরের সফলতা নির্ভর করে অনেকগুলো ফ্যাক্টরের ওপর। যে অঞ্চলে মানবিক করিডর হবে সেখানকার বিবদমান পক্ষ একমত হলে করিডর পরিচালনা সহজ হয়। কিন্তু সবাই রাজি না হলে তা হয় কঠিন।
রাজনীতিবিদদের অভিমত ॥ করিডরের ব্যাপারে বিএনপি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। দলটির মহাসচিব বলেছেন, ‘জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট এমন বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে সিদ্ধান্ত নিলে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে।’ জামায়াতে ইসলামীও একই মত পোষণ করে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে।

করিডর বিষয়ে সরকারের এমন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন, আলোচনা ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়ার সম্ভবনা থেকে যায়।
মানবিক করিডরের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামির নায়েবে আমির  সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোঃ তাহের বলেন, ‘চায়না এখানে সবচাইতে বেশি ভূমিকা পালন করতে পারে। কারণ মিয়ানমারের সঙ্গে চায়নার বড় ধরনের রিলেশনশিপ আছে। তারা আমাদের এই নিউ প্রোপোজাল সম্পর্কে তাদের গভর্নমেন্টকে বলবে এবং উদ্যোগ গ্রহণ করার ব্যাপারে তারা চেষ্টা করবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বলেছেন, আলোচনার মাধ্যমে মানবিক করিডর দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।
বিশ্লেষকদের মত ॥ এ বিষয়ে জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক ভূতত্ত্ববিদ এবং মানারাত ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুর রব জনকণ্ঠকে বলেন, ‘বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের মতো দেশগুলো এখানে কূটনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক রক্ষা করতে চায়।’
তিনি মনে করেন, ‘রাষ্ট্রীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি না দিয়ে, সচেতনতা তৈরির মাধ্যমে দেশপ্রেমকে সামনে রেখে কৌশলের মাধ্যমে করিডর ব্যবস্থায় অংশ নেওয়া সম্ভব। মানবিক করিডর দেওয়া কোনো সমস্যা বলে মনে হয় না।’ তবে দেশের রাজনৈতিক বিভাজনের কারণে আমাদের দুর্বলতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
তিনি আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র কিংবা চীনের কাউকেই বিমুখ করা যাবে না। সরকারকে অত্যন্ত হিসাব-নিকাশ করে, জনগণের সমর্থন নিয়ে এই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যাতে দুই পক্ষের স্বার্থ রক্ষা হয়। 
চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, ‘করিডরের পরিচালন ব্যবস্থা জাতিসংঘের হাতে থাকলেও চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের হাতেই থাকা উচিত, যাতে প্রয়োজনে দেশ নিজেই তা বন্ধ করতে পারে।’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) মোঃ বায়েজিদ সরোয়ার বলেন, ‘মানবিক করিডর বাস্তবায়িত হলে রোহিঙ্গা অনুপ্রেবেশ আপাতত কমতে পারে এবং আন্তর্জাতিক সহায়তা বাড়তে পারে। তবে এর স্থায়িত্ব ও সফলতা নির্ভর করবে এর ব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর।’
মানবিক করিডর শুধু একটি পলিটিক্যাল টুল নয়, বরং এটি হতে পারে কৌশলগত সহযোগিতার একটি পথ। যদি তা সঠিকভাবে পরিচালিত হয় এবং দেশের স্বার্থ সর্বাগ্রে রাখা হয়। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারতসহ সব পক্ষকে সামলে, সকল ঝুঁকি বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশকে রাষ্ট্রীয় দক্ষতায় সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যাতে মানবিক সহায়তা এবং জাতীয় নিরাপত্তা দুই-ই সুরক্ষিত থাকে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন  প্রসঙ্গেও এই করিডরের সম্ভাবনা রয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন। সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ  জনকণ্ঠকে বলেন, ‘যেই করিডর দিয়ে মানবিক সহায়তা যাবে, সেই পথেই রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর সুযোগ  তৈরি হতে পারে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম বলেন, সংঘাতময় অঞ্চলে বেসামরিক মানুষের জন্য খাদ্য, ওষুধ, আয়সহ সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য মানবিক করিডরের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। জাতিসংঘের রেজুলেশন ৪৬/১৮২ ও ৫৮/১১৪-এ মানবিক সহায়তার গাইডলাইন নির্ধারণ করা হয়েছে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ বলছেন, সরকার নীতিগত রাজি হয়ে ভালো করেছে। কারণ যেই করিডর দিয়ে সহায়তা যাবে সেই একই করিডর দিয়ে বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠিয়ে তাদের জন্য সেখানেই মানবিক সহায়তার কথা বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বলতে পারবে।

তিনি বলছেন, করিডর জাতিসংঘ করলেও এতে যুক্তরাষ্ট্র, চীন বা ভারত কিংবা এমন আরও কোনো শক্তি যুক্ত আছে কি-না সেটা জানতে হবে এবং তারা কিসের ভিত্তিতে যুক্ত হবে সেটাও সরকারকে পরিষ্কার করতে হবে। মনে রাখতে হবে এটা করতে গিয়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে যেন নতুন সংকট  তৈরি না হয়।
মিয়ানমার বিষয়ক গবেষক আলতাফ পারভেজ বলছেন, মানবিক করিডরের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এমন সিদ্ধান্ত হচ্ছে অথচ দেশের মানুষ, রাজনীতিক ও প্রশাসনের কেউ কিছু জানে না বলেই তারা তথ্য পাচ্ছেন। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই মানবিক করিডর হয়ে আছে বলেই ১৩ লাখ রোহিঙ্গা এখানে আসতে পেরেছে। 
মূলত করিডর নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে। যদিও এটিকে পরবর্তীতে ‘স্লিপ অব টাং’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই সময় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘এতটুকু আপনাদের বলতে পারি, নীতিগতভাবে আমরা এতে সম্মত। কারণ, এটি একটি হিউম্যানিট্যারিয়ান প্যাসেজ (ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর জন্য করিডর) হবে। কিন্তু আমাদের কিছু শর্তাবলি রয়েছে, সেই বিস্তারিততে যাচ্ছি না। সেই শর্তাবলি যদি পালিত হয়, আমরা অবশ্যই জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সহযোগিতা করব।’
করিডর নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি হবেও না ॥ মিয়ানমারকে করিডর দেওয়া নিয়ে  জাতিসংঘের বরাতে যে গুজব উঠেছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যে বানোয়াট। আমি দ্যর্থহীনভাবে বলে দিচ্ছি, করিডর নিয়ে আমাদের সঙ্গে কারও কোনো কথা হয়নি, ভবিষ্যতে  কারও সঙ্গে কথা হবেও না বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার  জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাও রোহিঙ্গা বিষয়ক বিশেষ দূত ড. খলিলুর রহমান। তবে তিনি জানিয়েছেন মিয়ানমার চাইলে এইড চ্যানেল নিয়ে আলোচনা হতে পারে। 
বুধবার বিকেলে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। রোহিঙ্গা বিষয়ক বিশেষ দূত বলেন, করিডরের বিষয়টা বুঝতে হবে। এটা হচ্ছে একটা ইমারজেন্সি সময়ে দুর্যোগপূর্ণ জায়গা থেকে মানুষকে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা। আমরা এখানে কাউকে সরাচ্ছি না। যেহেতু আরাকানে সাহায্য সহযোগিতা অন্যান্য  সাপ্লাই রুট দিয়ে সম্ভব হচ্ছে না, জাতিসংঘ আমাদের এইটুকুই বললো যে, কাছেই যেহেতু বর্ডার, তাদের সাহায্য করতে, যাতে ত্রাণগুলো ওপারে নিয়ে যেতে পারে।
জাতিসংঘ রাখাইনে তার নিজস্ব সহযোগী সংস্থার মাধ্যমে ত্রাণ পৌঁছাবে। আপনারা জাতিসংঘকে জিজ্ঞেস করেন, প্রমাণ পাবেন। আমরা করিডর নিয়ে কারও সঙ্গে কোনো ধরনের কথা বলি নাই এবং বলব না। আরাকানের যে অবস্থা তাতে করিডরের কোনো প্রয়োজন নাই।        
তিনি বলেন, যে প্রয়োজনীয়তা আছে সেটা হচ্ছে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার। যখন মিয়ানমারে ভূমিকম্প হলো আমরা কিন্তু তাদের আবেদনের অপেক্ষা করি নাই। আমরা ত্রাণ পাঠিয়ে দিয়েছি। এটা একটা মানবিক অবস্থান। আমাদের ধারণা এই কাজটি করতে পারলে সেখানকার পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হবে এবং আমরা সেই অবস্থায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা করতে পারব।

যতদিন আরাকান অস্থিতিশীল থাকবে আমরা প্রত্যাবাসনের কথা বলতেই পারব না। আর তাহলে তো  প্রত্যাবাসন কৌশল নিয়েও কথা বলতে পারব না। অনেকেই বলছেন করিডর নিয়ে আলাপ করছেন, আমাদের জানান নাই। অস্তিত্ব¡বিহীন জিনিস নিয়ে কী করে আলাপ করব, যার অস্তিত নাই সেই বিষয়ে আলাপ কী করে হয়।
এক  প্রশ্নের জবাবে ড. খলিলুর রহমান বলেন, আমাদের ওপর কারও চাপ নেই। যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ যারাই আছেন অংশীজন, আমরা সবার সঙ্গে কথা বলছি। তাড়াহুড়ার কোনো কথা নেই। হিসাব আমাদের সোজা, সেটা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের ফেরত যেতে হবে এবং ফেরত গিয়ে আবার যেন ফেরত না চলে আসে। টেকসই প্রত্যাবাসন হতে হবে। তিনি বলেন, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা করিডর শব্দটা উচ্চারণ করেছিলেন, বলেই কিন্তু বলেছেন ‘পাথওয়ে’। সেটা স্লিপ অব টাং ছিল। পরবর্তীতে সেটার ব্যাখ্যাও তিনিই দিয়েছেন। কথাবার্তা অনেক সময় স্লিপ হতে পারে।
ত্রাণ রাখাইনে নিয়ে যাওয়ার পরে ব্যবস্থাপনা কীভাবে হবে, এই  প্রশ্নের জবাবে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেন, পুরো কন্ট্রোল থাকবে জাতিসংঘের, ওপারে নিয়ে যাওয়ার পরে সেখানকার নিরাপত্তা, সবকিছু তাদের দায়িত্ব। আমাদের দায়িত্ব সীমান্ত পর্যন্ত, সেখানে মাদকপাচার হচ্ছে কিনা, অন্য কিছু হচ্ছে কিনা, সেটা আমরা দেখব। দ্পুক্ষ সম্মত হলে, কনফ্লিট কমলেই শুধু আমরা যাব।
ত্রাণ সরবরাহের সুযোগ দেওয়া হলে সেটা কোন রুটে হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুই পক্ষ, সব পক্ষ যদি রাজি হয়, তাহলে আমরা সবার সঙ্গে বসে সেটা ঠিক করব। এটা কেবলমাত্র সরকারের নয়, সব অংশীজনের সঙ্গে বসে আমরা সেটা ঠিক করব। এখনো সেই পর্যায়ে আমরা যাইনি।

বিষয়টা এমন যে বাচ্চা না হতেই কিভাবে দুধখাবে সে চিন্তা! করিডর ইস্যুতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে কোনো মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে কিনা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর সঙ্গে কোনো মতপার্থক্য নেই। গত কয়েকদিন আগেও সেনাপ্রধানের সঙ্গে আমার বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। এ নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই। একই তালে এগুচ্ছে। এ নিয়ে কোনো ফাঁকফোকর নেই বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, একটি জাতি নিয়ে জাতিসংঘের এমন সম্মেলন আয়োজন বিরল উদাহরণ। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সচিবালয়ে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। দ্বিতীয় যে বিষয় আমরা দেখছি, এই সমস্যার সমাধান কী? আমরা প্রথম থেকেই ভেবেছি এই সমস্যার সমাধান রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তন করা। এটিই সমাধান। এই বিষয়ে আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে নিরলসভাবে কাজ করেছি। আমি আনন্দিত যে এই বিষয়ে আমরা আন্তর্জাতিক একটা ঐকমত্যে পৌঁছেছি। 
তিনি আরও বলেন, প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া কী হবে, সেটা দেখতে গিয়ে যে বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছি সেটা হচ্ছে মিয়ানামার সরকারের দখলে ৯০ ভাগ রাখাইন নেই। এটার দখল নিয়ে নিয়েছে আরাকান আর্মি। আরকান আর্মি এবং মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব। সেই আলোচনা আমরা একই সমান্তরালে চালু করেছি।
তিনি বলেন, আমাদের আরাকান আর্মি সুস্পষ্টভাবে বলেছে, রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়া তাদের একটি  প্রিন্সিপ্যাল পজিশন, একই কথা আমদের মিয়ানমার সরকার উল্লেখ করেছে। আরাকান আর্মি বলেছে, পরিস্থিতি অনুকূলে হলে তারা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেবে। আরাকানে যুদ্ধাবস্থা এখনো নিরসন হয়নি।
তিনি বলেন, জাতিসংঘের পক্ষ থেকে আরাকান আর্মিকে জানানো হয়েছে যে এই সহায়তা  প্রাপ্তির বিষয়ে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না। কাউকে এর থেকে বঞ্চিত করা যাবে না, এটা কোনো যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করা যাবে না। আমাদের মধ্যে শঙ্কা হচ্ছে আরাকানে যে নতুন প্রশাসনিক, রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তাজনিত পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে আমরা তাতে রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহণের কোনো চিহ্ন দেখছি না। 
খলিলুর রহমান বলেন,  করিডর হচ্ছে জরুরি সময়ে দুর্যোগপূর্ণ জায়গা থেকে মানুষকে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা। আমরা এখানে কাউকে সরাচ্ছি না। আমরা যেটা করছি, সেটা হলো যেহেতু রাখাইনে কোনো সাহায্য-সহযোগিতা বা এইড যাচ্ছে না, জাতিসংঘ আমাদের এটুকুই বলেছে যে, আপনাদের সীমান্তের ওপারে এইড নিয়ে যেতে সাহায্য করবেন বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, আরাকানের যে অবস্থা তাতে সেখানে করিডরের কোনো প্রয়োজন নেই।  করিডর তৈরি করে সেখানে লোকজন আসা-যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। 
অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান বলেছেন, বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশের জাতীয়তা তার নেই। সম্প্রতি খলিলুর রহমানের নাগরিকত্ব নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ আলোচনা-সমালোচনা হয়। 
তিনি আরও বলেন, আমি আমার পরিবারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে থেকেছি। কিন্তু আমার আমেরিকান পাসপোর্ট নেই। বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশের জাতীয়তা আমার নেই। যুক্তরাষ্ট্রে থাকার কারণে যদি আমাকে বলা হয় বিদেশি নাগরিক, তাহলে কাল তো তারেক রহমানকেও বলবে। আমি আবেদন করব একটু বুঝে কথা বলবেন। যদি আমাকে ঢিল নিক্ষেপ করেন, সেই ঢিল কিন্তু অন্যের ওপর গিয়েও পড়তে পারে। 
খলিলুর রহমান আরও বলেন, আমি যেটা নই, আমাকে সেটা বানাবেন না প্লিজ। পারলে প্রমাণ করেন, আদালতে গিয়ে  প্রমাণ করেন। আমার একটা অধিকার আছে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে। সেই অধিকার যদি আপনারা রক্ষা না করেন, সেটি যে কারও ওপর প্রযোজ্য হতে পারে।

×