ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৪ জুন ২০২৫, ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

অতিরিক্ত তিন বছর শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা দেবে ডব্লিউটিও

’২৬ সালের ২৪ নভেম্বর এলডিসি থেকে উত্তরণ

এম শাহজাহান

প্রকাশিত: ০০:০২, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪

’২৬ সালের ২৪ নভেম্বর এলডিসি থেকে উত্তরণ

.

জাতিসংঘ ঘোষিত সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে স্বল্পোন্নত বা এলডিসি তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাচ্ছে বাংলাদেশ। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। সদ্য নিয়োগ পাওয়া বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশিরউদ্দীন বলেছেন, স্বল্পোন্নত বা এলডিসির তকমা থেকে ২০২৬ সালেই উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হবে বাংলাদেশ। আমাদের অর্থনৈতিক যাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হবে এটি এবং এ পরিবর্তন বিপুল পরিমাণ সুযোগ তৈরি করবে। তবে এ জন্য আমাদের ব্যবসায়িক সংগঠন ও মানবসম্পদের সক্ষমতা বাড়ানোর প্রয়োজন।
জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায় হওয়ার পর ব্যবসায়ী- উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশ এলডিসি থেকে উত্তরণ কমপক্ষে ১০ বছর পিছিয়ে দেওয়ার কথা বলে আসছিলেন। তাঁরা মনে করেন, এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। এ ছাড়া চলমান অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক সংকটের কারণে অর্থনীতি চাপের মুখে রয়েছে। এ অবস্থায় এলডিসি উত্তরণ পিছিয়ে দেওয়া হলে অর্থনৈতিক ঝুঁকি হ্রাস পাবে, যা উদ্যোক্তাদের জন্য স্বস্তি বয়ে আনবে বলে মনে করা হয়। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এলডিসি উত্তরণের পরও পরবর্তী তিন বছর ২০২৯ সাল পর্যন্ত  আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষ করে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা পাওয়া যাবে। ফলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাওয়া হলেও প্রস্তুতির যথেষ্ট সময় রয়েছে। শুধু তাই নয়, এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেলে বহির্বিশ্বে বিশেষ কিছু আর্থিক সুবিধা পাওয়ার পাশাপাশি দেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হবে। বিদেশী বিনিয়োগ ও ঋণ সহায়তা বেশি পাওয়া যাবে।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশিরউদ্দীন আরও জানান, স্বল্পোন্নত বা এলডিসি দেশের তালিকা থেকে ২০২৬ সালের নভেম্বরেই  উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হতে চলেছে বাংলাদেশ। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ লক্ষ্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। সরকার ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) ও বৃহৎ অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বে চুক্তি এবং ইপিএ এবং পিটিএ করার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
জানা গেছে, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের সর্বশেষ মূল্যায়নেও বাংলাদেশ বেশ ভালোভাবেই পাস করেছে। জাতিসংঘের ২০২৪ সালের ত্রিবার্ষিক মূল্যায়নে মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা- এই তিন সূচকেই বাংলাদেশ উত্তীর্ণ হয়েছে। এলডিসি থেকে উত্তরণ হয়েছে কিংবা হওয়ার পথে রয়েছে এমন দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশই টানা তিনটি মূল্যায়নে সব সূচকে পাস করেছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) ত্রিবার্ষিক প্রতিবেদনে এভাবেই বাংলাদেশের সম্ভাবনা তুলে ধরা হয়েছে। সিডিপি মনে করে, বাংলাদেশসহ যে ছয়টি দেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের পথে রয়েছে, তাদের সবার সামনেই চারটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। চ্যালেঞ্জগুলো হলো বৈশ্বিক সংকট, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ও বিদেশী সহযোগিতা বাড়ানো। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে গত ৪ থেকে ৮ মার্চ সিডিপির পর্যালোচনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। জাতিসংঘের ওয়েবসাইট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণের তারিখও ঠিক করা হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটবে।
২০২১ সালে সিডিপি যখন এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশের নাম চূড়ান্তভাবে সুপারিশ করে, তখন বলা হয়েছিল যে ২০২৪ সালেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করা হবে। গত ফেব্রুয়ারিতে সেই মূল্যায়ন হয়। এর আগে ২০১৮ ও ২০২১ সালেও সব কটি সূচকে বাংলাদেশ উত্তীর্ণ হয়েছিল। পর পর দুটি ত্রিবার্ষিক মূল্যায়নে নির্দিষ্ট মান অর্জন করলেই এলডিসি থেকে বের হওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত সুপারিশ করে সিডিপি। তবে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, সিডিপির মূল্যায়নে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ হলেও দেশের অর্থনীতিতে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে।
জানা গেছে, এলডিসি থেকে বের হলে সবচেয়ে সমস্যায় পড়বে রপ্তানি খাত। কারণ, এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) আওতায় শুল্কমুক্ত বাণিজ্যসুবিধা পায়। ইউরোপীয় ইউনিয়নেও আঞ্চলিক বা দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে (যেমন ভারত, চীন) এ ধরনের শুল্ক সুবিধা মিলছে। বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী ২০২৬ সালে এসব সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে। যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়নে জিএসপির আওতায় শুল্ক সুবিধা ২০২৯ সাল পর্যন্ত থাকবে। এলডিসি তালিকা থেকে বের হলে বাংলাদেশের পাওয়া কিছু বাণিজ্য ও অন্যান্য সুবিধা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর নিয়মিত হারে শুল্ক বসবে। ডব্লিউটিওর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাড়তি শুল্কের কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি বছরে ৫৩৭ কোটি ডলার বা সাড়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকা কমতে পারে। আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা তুলে ধরে সম্প্রতি
ঢাকা চেম্বার আয়োজিত এক বাণিজ্য সম্মেলনে ব্যবসায়ীদের একাংশ ২০২৬ সালে এলডিসি তালিকা থেকে বের হওয়া পিছিয়ে দেওয়া যায় কি না, সেই প্রশ্ন তুলেছিলেন।
ওই দিন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সভাপতি জাভেদ আখতার বলেছিলেন, ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ হওয়ার দরকার আছে কি না, সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলো নেওয়া যাবে কি না, এখনই তা ভেবে দেখা দরকার। অন্য ব্যবসায়ীরাও এ বিষয়ে একই ভাষায় কথা বলছিলেন।এলডিসি থেকে উত্তরণ নিয়ে ওই দিন সেখ বশিরউদ্দীনের জবাব ছিল, এটা করতে হবে। ২০২৬ না ২০৩০, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে, কিন্তু এটা করতেই হবে। যথাযথ নীতি তৈরি করতে পারলে এটা সম্ভব।
এর আগে ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ আরেকটি সেমিনারে বলেছিলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণ ১০ বছর পিছিয়ে দেওয়া দরকার। বর্তমান প্রেক্ষাপটে অর্থায়নের সুযোগ ও জিএসপি প্লাসের প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ এবং সেই বিনিয়োগের জোগান দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই দেশের ব্যাংক খাত।
এদিকে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ত্রয়োদশ মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে নেওয়া সিদ্ধান্তের ফলে ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় আসার পর বাংলাদেশ আরও তিন বছর শুল্ক সুবিধা পাবে।
ডব্লিউটিও সম্মেলনের খসড়া ঘোষণায় বলা হয়েছে-স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ২০২৯ সাল পর্যন্ত উন্নয়নশীল ও উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোয় রপ্তানি পণ্যের জন্য স্বল্প বা শূন্য শুল্ক সুবিধা ভোগ করবে।
ঘোষণাপত্রে বলা হয়, ডব্লিউটিওর বিরোধ নিষ্পত্তি সমঝোতার ২৪ অনুচ্ছেদ অনুসারে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার বিষয়ে জাতিসংঘের ঘোষণার দিন থেকে সেসব দেশ পরবর্তী তিন বছর এ সুবিধা পাবে।
এ ছাড়াও, সেসব দেশ ডব্লিউটিওর কারিগরি সহায়তা ও প্রশিক্ষণ পরিকল্পনার আওতায় তিন বছর পর্যন্ত কারিগরি সহায়তা পাবে। ঘোষণায় আরও বলা হয়, এই পরিকল্পনার আওতায় বিদ্যমান স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অংশগ্রহণকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।

জোবায়ের আহমেদ

×