ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ৭ মাঘ ১৪৩১

অনুমোদন পেতে যাচ্ছে নতুন ৩৩ কোম্পানি

বাড়ানো হবে আমদানি ॥ গ্যাস সংকট কাটাতে

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ২২:০১, ৫ ডিসেম্বর ২০২৪

বাড়ানো হবে আমদানি ॥ গ্যাস সংকট কাটাতে

.

দেশের গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন না বাড়ায় গ্যাসের সংকট কাটছেই না। শীত শুরুর সঙ্গে সঙ্গে দেশজুড়ে আবারও দেখা দিয়েছে গ্যাসের তীব্র সংকট। আবাসিকের পাশাপাশি শিল্প খাতও ধুঁকছে গ্যাস সংকটে। এমন পরিস্থিতিতে চাহিদা মেটাতে বাড়তি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির পরিকল্পনা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে এক্ষেত্রে আমদানি নীতির পরিবর্তন হচ্ছে। নতুন করে অনুমোদন পেতে চলেছে আরও অন্তত ৩৩টি কোম্পানি। সব ঠিকঠাক থাকলে ২০২৫ সালের শুরুতেই গ্যাস সংকট কমে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) বলছে, দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস খাত চলছে রেশনিং (এক খাতে সরবরাহ কমিয়ে অন্য খাতে দেওয়া) করে। দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়। কোনো কারণে সরবরাহ এর চেয়ে কমলেই বেড়ে যায় সংকট। দেশীয় এবং আমদানি উৎস থেকে বর্তমানে সারাদেশে দৈনিক সরবরাহ হচ্ছে ২৭১ কোটি ঘনফুট গ্যাস। এর মধ্যে দেশীয় গ্যাস উৎস থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে ২০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস। বাকিটা আমদানিকৃত এলএনজি থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় তবু সংকট থেকে যাচ্ছে প্রায় ১০০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের। ফলে শিল্প কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি আবাসিক খাতেও দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে গ্রাহকদের।
তবে এই সংকট থেকে উত্তরণে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। দেশীয় কূপ খননে জোর দেওয়ার পাশাপাশি আমদানি বাড়াতেও নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন পদক্ষেপ। আমদানিতে প্রতিযোগিতা বাড়াতে অর্থাৎ সর্বনিম্ন দর পেতে আরও ৩৩ কোম্পানির আবেদনের প্রেক্ষিতে আমদানির অনুমোদন দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে জানিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান জনকণ্ঠকে বলেন, যেহেতু দেশীয় কূপগুলোতে এখনো নতুন করে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না তাই প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে আমাদের আমদানিই করতে হবে। তবে আমরা চেষ্টা করছি এ ক্ষেত্রে যেন সর্বনিম্ন দামে পাওয়া যায়। আপনারা জানেন, স্পট মার্কেট বা খোলাবাজার থেকে এলএনজি ক্রয়ে বিগত সরকারের বদান্যতায় ভিটোল, গানভর, এক্সিলারেট এনার্জি, সামিটসহ গুটিকয়েক কোম্পানির হাতে আমদানির প্রক্রিয়া জিম্মি ছিল। আমরা সেই প্রক্রিয়া থেকে বের হয়ে এখন উন্মুক্ত দর প্রস্তাবের মাধ্যমে আমদানিকারকের পরিমাণ বাড়াতে চাইছি। ইতোমধ্যে এলএনজি সরবরাহের জন্য আরামকো, শেল, বিপির মতো জ্বালানি খাতের ৩৩টি জায়ান্ট কোম্পানি আবেদন করেছে। উন্মুক্ত দরপত্রের এটাই সবচেয়ে বড় সুবিধা। আমরা আরও উন্মুক্ত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরবরাহকারীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে আরও খরচ বাঁচাতে চাই।
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ বছরে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা (বা ৫০৪ মিলিয়ন ডলার) এর এলএনজি আমদানি করে। বেশিরভাগটাই প্রয়োজন হয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানির জন্য।
জ্বালানি বিভাগ বলছে, বর্তমানে কাতার থেকে বার্ষিক ১.৮ থেকে ২.৫ মিলিয়ন টন এলএনজি আমদানির চুক্তি রয়েছে বাংলাদেশের। ২০১৭ সাল থেকে ১৫ বছর মেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতার থেকে এলএনজি আমদানি করে আসছে বাংলাদেশ। কাতারের রাশ লাফান লিক্যুফাইড ন্যাচারাল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে ওই চুক্তির আওতায় বার্ষিক ১.৮ থেকে ২.৫ মিলিয়ন টন এলএনজি পাওয়ার কথা বাংলাদেশের। সাইড লেটার চুক্তির মাধ্যমে ২০২২ সালে এর অতিরিক্ত হিসেবে বছরে আরও ১ মিলিয়ন টন এলএনজি আমদানির জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় এর আগে প্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু কাতার তাতে সাড়া দেয়নি।
গ্যাসের ঘাটতি মেটাতে হলে হয় উৎপাদন বাড়াতে হবে অথবা আমদানি বাড়াতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে আমদানি বাড়ানো কঠিন কারণ বাংলাদেশ এখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও ডলার সংকটে আছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে গ্যাসের প্রকৃত মজুত কত, নতুন গ্যাস কূপ খনন কবে সম্ভব হবে তা নিশ্চিত নয়। এই কাজে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাপেক্স এবং রাশিয়ার প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রম নিয়োজিত আছে। তাই আমদানির ক্ষেত্রে নতুন কোম্পানি যোগ হলে তুলনামূলক কম মূল্যে গ্যাস পাওয়া যাবে জানিয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, বর্তমান সরকার বিগত সরকারের আমলে হওয়া দুর্নীতির খেসারত দিচ্ছে। ইচ্ছে করলেই সেই গোলক ধাঁধা থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার তাদের নিজেদের আখের গোছাতে তাদের পছন্দমতো কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে উচ্চ মূল্যে এলএনজি আমদানি করত। এবার যেহেতু প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নতুন কোম্পানি আসছে সেহেতু আমদানি করা এলএনজির মূল্য কম হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে বলে আমি মনে করি।
এদিকে শীত শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই রাজধানীর আবাসিক খাতে গ্যাসের সরবরাহ কমে গেছে উল্লেখযোগ্য হারে। মোহাম্মদপুর, মিরপুর, ফার্মগেট, কলাবাগান, ধানমন্ডিসহ পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা গ্যাসের চাপ কম থাকার কারণে ঠিকমতো চুলায় রান্না করতে পারছেন না। তাই বিগত সরকারের মতো বর্তমান সরকারকেও এর জন্য দায়ী করে দোষারোপ করছেন তারা। এমনই একজন রাজধানীর মিরপুরের কাফরুল এলাকার বাসিন্দা জিএম মুজিবুর। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে বলেন, ‘শীত না আসতেই গ্যাসের এই বেহাল অবস্থা। সকাল ৯টা চুলায় আধা কেজি চালের ভাত রান্না করার জন্য বসানো হয়েছিল। বেলা ১১টা ৩০ এ বহু কষ্টে রান্না হয়েছে।’
একই রকম অভিযোগ করেন রাজধানীর শান্তিনগর এলাকার বাসিন্দা মনোরমা বেগমও। তিনি বলেন, এখনো শীত তেমন করে না পড়লে কি হবে গ্যাসের চুলায় আগুন কমে গেছে আরও আগেই। চুলায় আগুনের চাপ না থাকায় দিনের রুটিনও বদলে গেছে। সকালের রান্না দুপুরে করতে হয়। দুপুরের রান্না রাতে। সরকার আসে সরকার যায়। কিন্তু জনগণের দুর্ভোগ কি কমে?
কমেছে শিল্প উৎপাদনও ॥ গ্যাস সংকটে দেশের বড় শিল্প কারখানাগুলোতে কমেছে উৎপাদন। বেশি ক্ষতির মুখে পড়ছে তৈরি পোশাক শিল্প। এই খাতে গড়ে উৎপাদন কমেছে শতকরা ২০-৩০ ভাগ। আবার যারা ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্ট ব্যবহার করছেন তাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। বাজার থেকে চড়া দামে জ্বালানি তেল কিনতে হচ্ছে তাদের। উৎপাদন কমে যাওয়া ও ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় রপ্তানি আয়ে ভাটা পড়বে বলে আশঙ্কা তাদের।
এসব বিষয় নিয়ে বিকেএমইএ এর সহ-সভাপতি ফজলে শামীম এহসান জনকণ্ঠকে বলেন, গ্যাস সংকটের কারণে আমার কারখানায় উৎপাদন ৫০ ভাগের নিচে নেমে এসেছে। কারণ গ্যাস না থাকার কারণে ডায়িং ফ্যাক্টরিগুলো সময়মতো এবং চাহিদামতো ফেব্রিক সরবরাহ করতে পারছে না। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই এখন তার ক্যাপাসিটির ৫০ ভাগের বেশি উৎপাদন করতে পারছে না।
এ বিজিএমইএর সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, গ্যাসের সঙ্গে ডলার সংকট এবং ইউরোপের বাজারে তৈরি পোশাকের চাহিদা কমে যাওয়ায় আমরা সংকটে আছি। যেসব কারখানা পুরোপুরি গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল তাদের উৎপাদন কমে গেছে। আর যাদের ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্ট আছে তাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। বাজার থেকে উচ্চ মূল্যে জ্বালানি তেল কিনে তাদের উৎপাদন অব্যাহত রাখতে হচ্ছে। আর সব মিলিয়ে উৎপাদন কমে যাচ্ছে।
জানা যায়, বর্তমানে দেশটি থেকে মাসে ৫টি করে এলএনজি কার্গো আসছে, যার ইউনিটপ্রতি গ্যাসের দাম পড়ছে ১৫ মার্কিন ডলার। কিন্তু খোলাবাজারে এই দাম ৬০ ডলারের বেশি। এদিকে ফার্নেস অয়েল এবং ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়া বিদ্যুৎ উৎপাদনে বা সার কারখানায় গ্যাসের যে ব্যবহার হতো তাও কমানো যাচ্ছে না। বিশ্ববাজারে সারের দাম চড়া, আমদানিতে বাড়তি খরচ লাগছে। তাই দেশি সার কারখানা চালু রাখতে হচ্ছে। জানা যায়, দেশের গ্যাসের মোট চাহিদার ৩৮০ মিলিয়ন ঘনফুটের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনেই ব্যবহৃত হয় ২২৫ মিলিয়ন ঘনফুট। সার কারখানায় লাগে ৩২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। কিন্তু এর বিপরীতে সরবরাহ করা যাচ্ছে বিদ্যুতে মাত্র ১০৬ মিলিয়ন এবং সারে ১৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। আবাসিকে ঠিক কত পরিমাণ গ্যাসের সংকট হচ্ছে এ বিষয়ে ঠিক করে বলতে পারছে না পেট্রোবাংলাও।
তবে গ্যাস সংকটের স্থায়ী সমাধান একমাত্র দেশীয় কূপ খননকাজে গতি বাড়ানো বলে মন্তব্য করছেন বিশেষজ্ঞরা। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম জনকণ্ঠকে বলেন, এখন কাতারের এলএনজির দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও চীন নিয়ে যাচ্ছে। সামনে কাতার থেকে এলএনজি পাওয়াটা বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কাতার আমাদের কাছের দেশ হওয়ায় এলএনজি আমদানিতে খরচ কম হতো। কাতার ও ওমান থেকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে এলএনজি আনা হয় প্রায় চার মিলিয়ন টন। বাকিটা স্পট মার্কেট (খোলাবাজার) থেকে কেনা হয়। আমাদের বছরে আরও দুই মিলিয়ন টন এলএনজির দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি বাড়াতে হবে। কাতার যদি এখন অতিরিক্ত এলএনজি দিতে না চায়, তা হলে আমরা অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে এলএনজি চুক্তির বিষয়ে কথা বলতে পারি। বর্তমান সংকট থেকে শিক্ষা নিয়ে এসবের বাইরে আমদানির দিকে না তাকিয়ে পেট্রোবাংলাকে দেশীয় গ্যাস উৎপাদানের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

 

 

×