ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২১ জুলাই ২০২৫, ৬ শ্রাবণ ১৪৩২

রাজধানী ঢাকা

শব্দ দূষণে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে এক কোটি মানুষ 

সোহেল রানা

প্রকাশিত: ১১:১৯, ২০ অক্টোবর ২০২৪; আপডেট: ১১:৪৩, ২০ অক্টোবর ২০২৪

শব্দ দূষণে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে এক কোটি মানুষ 

প্রতীকী ছবি। একেঁছেন শিল্পী আয়ুউব আল আমিন।

বিশ্বের সবচেয়ে কোলাহলপূর্ণ শহর ঢাকা, গড় শব্দের মাত্রা ১১৯ ডেসিবেল।

সারাদেশে বাড়ছে শব্দ দূষণ। তবে সবচেয়ে বেশি শব্দ দূষণে ভুক্তভোগী রাজধানীবাসী। গভীর রাতেও উচ্চ শব্দের আওয়াজ শোনা যায়। এতে  বিঘ্ন ঘটে ঘুমের। রাজধানীর বেশির ভাগ মানুষই শব্দ দূষণের শিকার। ঢাকা শহর হলো- বিশ্বের সবচেয়ে কোলাহলপূর্ণ শহরের একটি। যেখানে গড় শব্দের মাত্রা ১১৯ ডেসিবেল-এমনটাই জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাক কান ও গলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আবির্ভাব নাহা।

একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক চিকিৎসক মো: রফিকুল ইসলাম বলেন, ঢাকা শহরে প্রায় এক কোটি মানুষ শব্দ দূষণের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে আছে। অন্য এক গবেষণায় পাওয়া গেছে, প্রায় ৯১ শতাংশ মানুষ তাদের আশেপাশে শব্দ দূষণের সমস্যা অনুভব করেন। যা তাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলে।

অপ্রয়োজনীয় শব্দ মানুষের সহনশীলতার মাত্রা ছাড়িয়ে বিরক্তি ঘটানো এবং স্বাস্থ্যের ক্ষতিসাধন করাই হচ্ছে- শব্দ দূষণ। যানজট, গাড়ির হর্ন, কলকারখানা, রাজনৈতিক সমাবেশ, ধর্মীয় অনুষ্ঠান থেকে তীব্র শব্দ উৎপত্তি হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, আবাসিক এলাকায় নিরাপদ শব্দসীমা ৫৫ ডেসিবেল। বাণিজ্যিক ও যানজটপ্রবণ এলাকায় এই মাত্রা ৭০ ডেসিবেল। তবে বাস্তবতা হলো- হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো এলাকাতেও শব্দের দূষণে টিকে থাকা দায়। সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, শব্দ ৭৫ ডেসিবেল অতিক্রম করলে ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। ১২০ ডেসিবলের উপরে বেদনাদায়ক হয়। দেশের শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা অনুসারে, রাজধানীর মিশ্র (আবাসিক ও বাণিজ্যিক) এলাকায় দূষণের সর্বোচ্চ মাত্রা ৬০ ডেসিবল।ট্রাফিক বিভাগ বলছে, সড়কে বিশৃ্খলার কারণেই শব্দ দূষণ বেশি হচ্ছে। একই সড়কে চলছে বাস, জিপ, রিকশা, মোটরসাইকেল, সিএনজি চালিত অটোরিকশা। শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন পরিকল্পিত নগর পরিকল্পনা। 

ঢাকা শহরে বিভিন্ন পয়েন্টে যেসব পুলিশ ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করেন- এমন কয়েজন পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। তারা জানিয়েছেন, উচ্চ শব্দের কারণে তারা নানা ধরনের স্বাস্থ্যঝঁকিতে পড়ছেন। প্রতিনিয়ত অতি মাত্রার শব্দের মধ্যে থাকায় তাদরে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়।

রমনা ট্রাফিক জোনের সার্জেন্ট রাকিব বলেন, শব্দ দূষণে স্বাস্থ্য ঝুঁকি তো আছেই। কানে সমস্যা হচ্ছে, হার্ডে সমস্যা হচ্ছে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। আমাদের ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের ৪০ ঊর্ধ্ব অনেকেই কিডনি, ডায়াবেটিস, কানে কম শোনা রোগে ভুগেন। 

মগবাজার-বাংলামোটর, শাহবাগ, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট এলাকায় শব্দ দূষণ বেশি হয় কেন? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, রাজধানীর এইসব স্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। ওপরে ফ্লাইওভার। এখানে রিকশা, মোটর সাইকেলের প্রচুর গেদারিং। ফলে শব্দ প্রচুর ব্রাইভেশন হয়। যা অসহনীয় ও বিরক্তিকর।শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে সচেতনতামূলক ব্যানারটি পরিবেশ অধিদপ্তরের। রাজধানীর বাংলামোটর এলাকা থেকে ছবিটি তুলেছেন মামুন শেখ।ট্রাফিক পুলিশেল সার্জেন্ট ওয়াদুজ্জামান বলেন, শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে জরুরি পরিকল্পিত নগর পরিকল্পনা। দেখেন, গুরুত্বর্পণ কিছু কিছু সড়কে রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, মোটরগাড়ি একই সঙ্গে চলে। ফলে বাস, সিএনজি, মাইক্রোবাস, জিপ গাড়ির চলাচলে গতি কমে যায়। তখনই চালক অযাচিত হর্ন দেয়। আমি মনে করি, চালকদের সচেতন হওয়া জরুরি।

বেপরোয়া হর্ন ব্যবহারের কারণ হিসেবে অসচেতনতা, আইনের প্রতি শ্রদ্ধার অভাবকে দেখছেন চালক ও সাধারণ মানুষ। চালকদের মতে, হর্ন বাজালেও পথচারীরা শুনতে পায় না। তারা ইচ্ছা মতো রাস্তায় চলাচল করে। রিকশা ও বাইকচালকরাও সড়কে বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী। তখন বাধ্য হয়ে হয়েই চালকরা হর্ন দেয়। শিগগিরই সড়কের বিশৃঙ্খলা বন্ধ করতে হবে।

বেসরকারি চাকরিজীবী রণধীর বড়ুয়া নিয়মিত গাড়ি চালিয়ে অফিসে যাওয়া-আসা করেন। তিনি বলেন, যত্রতত্র হর্ন বাজার একটাই কারণ, আইনের প্রয়োগ নেই। রাতের বেলা আমি হর্ন দিই না। ইনডিকটর ব্যবহার করি। হর্ন রাস্তার বাঁকে ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক। বিআরটির আইনেই আছে। আইনের সঠিক ব্যবহার থাকলে- এমনটা হতো না। ডা. মো. রফিকুল ইসলাম।চিকিৎসকরা বলেছেন, শব্দ দূষণের কারণে দুশ্চিন্তা, উগ্রতা, উচ্চ রক্তচাপ, টিন্নিটাস, শ্রবণশক্তি হ্রাস, ঘুমের ব্যাঘাতসহ অন্যান্য ক্ষতিকর ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটতে পারে। এছাড়াও, অন্যান্য শারীরিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে স্মরণশক্তি হ্রাস, মানসিক অবসাদ ইত্যাদি হতে পারে। শব্দের সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্যাগুলির মধ্যে রয়েছে- স্ট্রেস সম্পর্কিত অসুস্থতা, উচ্চ রক্তচাপ, শ্রবণশক্তি হ্রাস, ঘুমের ব্যাঘাত এবং উৎদনশীলতা হারাতে পারে।

প্রতিদিন কী পরিমাণ রোগী এই সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে আসেন- এমন প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ের নাক-কান ও গলা বিভাগের  ডা: মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, নিদিষ্ট ভাবে কোন তথ্য উপাত্ত পাই নি। তবে দেশে শব্দ দূষণ থেকে উদ্ভূত রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। 

চিকিৎসকেরা আরও জানিয়েছেন, যাঁরা অতিরিক্ত শব্দ এলাকার মধ্যে বসবাস করেন, তাঁদের কানের নার্ভ ও রিসেপ্টর সেলগুলো নষ্ট হয়ে যায়। ফলে মানুষ ধীরে ধীরে শ্রবণশক্তি হারাতে থাকে। মানুষ সাধারণত ৩০ থেকে ৪০ ডেসিবল শব্দে কথা বলে। ৭০ ডেসিবল পর্যন্ত মানুষের কান গ্রহণ করতে পারে। ৮০-এর ওপরে গেলেই ক্ষতি শুরু হয়। প্রতিদিন ২ ঘণ্টা করে ৮৫ ডেসিবেল শব্দ যদি কোনো ব্যক্তির কানে প্রবেশ করে, তাহলে ধীরে ধীরে শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়ে যায়। ১২০ ডেসিবল শব্দ সঙ্গে সঙ্গে কান নষ্ট করে দিতে পারে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাক কান ও গলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আবির্ভাব নাহা বলেন, উচ্চ শব্দের এক্সপোজার টিনিটাসের কারণ হতে পারে, যা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানো, মেজাজ খিটখিটে করা এবং জীবনের মানকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। শব্দ এক্সপোজারের কারণে মনোযোগ হ্রাস পেতে পারে। যা পেশাগত দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হতে পারে। 

তিনি আরও জানিয়েছেন, শব্দ দূষণের কারণে শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক মধ্যে বিরক্তি আসে। যার কারণে মাথা ব্যথা হয়। যা মানসিক চাপের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এতে দিন দিন মানুষের অসুস্থতা বাড়ছে।সহকারী অধ্যাপক ডা. আবির্ভাব নাহা।পরিবেশ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, শব্দ দূষণের উৎসগুলো ইতিমধ্যে চিহ্নিত হয়েছে। যানবাহন, শিল্প কারখানা, নির্মাণ কাজ, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান হতেও শব্দ দূষণ তৈরি হয়। এগুলো সব দৃশ্যমান উৎস। একটি একটি উৎস ধরে দূষণ কমাতে হবে। কোটি কোটি টাকার প্রকল্প নির্ভরতায় না থেকে শব্দের উৎস বন্ধের জন্য নীতিগত পরিবর্তন এবং আইনের সঠিক প্রয়োগ অতি জরুরি।

বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেইঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরামের সভায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, পরিবেশ রক্ষায় নানা পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। তবে দূষণ নিয়ন্ত্রণে শুধু আইনের প্রয়োগ যথেষ্ট নয়। জনগণের অংশগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। বায়ু দূষণ ও শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের মনোযোগ রয়েছে। কিন্তু সচেতনতা ছাড়া সফল বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। আমরা চাই,মানুষ পরিবেশবান্ধব জীবনযাপন শুরু করুক। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি পদক্ষেপই গুরুত্বপূর্ণ।

 এসআর

×