ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২১ জুলাই ২০২৫, ৫ শ্রাবণ ১৪৩২

নির্যাতনেই ঘটছে অস্বাভাবিক মৃত্যু ও আত্মহত্যা

আজাদ সুলায়মান

প্রকাশিত: ০০:১৩, ২১ জুলাই ২০২৫

নির্যাতনেই ঘটছে অস্বাভাবিক মৃত্যু ও আত্মহত্যা

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ভিআইপি বন্দিদের বাসা থেকে খাবার এনে দিচ্ছে কারাগারেরই একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। ব্ল্যাংক চেকের মাধ্যমে আর্থিক সুবিধা নিয়ে এ ধরনের অপরাধে সক্রিয় রয়েছে এই সিন্ডিকেট। এতে কারাভ্যন্তরের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। এ ছাড়া বন্দিদের খাবার কম দেওয়া, নির্যাতন করা, মাদক সরবরাহ ও বিশেষ গেট ভিআইপি বন্দিদের বাইরে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সম্প্রতি কারাগারে সাভারের যুবলীগ নেতা সুজনের আত্মহত্যার ঘটনায় ক্ষুব্ধ বেশ ক’জন কারাবন্দি এ ধরনের চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস করেন। অবশ্য এসব অভিযোগের তদন্তে নামে কারাকর্তৃপক্ষ।

বিশেষ করে সম্প্রতি ডেপুটি জেলার মাসুমের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী আনিসুল হক, শাহজাহান খান ও সালমান এফ রহমানের কক্ষে বাসা থেকে খাবার এনে  সরবরাহ করায় তোলপাড় শুরু হয়। যদিও এ ঘটনা তদন্ত করে কোনো ধরনের সত্যতা পায়নি বলে দাবি করেছেন, কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মোতাহার হোসেন। দৈনিক জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, এ ধরনের  অভিযোগ শোনা যায়। সম্প্রতি ভিআইপি কারাবন্দি তিন নেতার কক্ষে বাসা থেকে খাবার এনে দেওয়ার ঘটনা ডেপুটি জেলার মাসুমের বিরুদ্ধে লিখিত একটি অভিযোগ তদন্ত করা হয়। তাতে দেখা যায়, অভিযোগ সত্য নয়। 
জানা গেছে, গত ১৫ জুন রবিবার বেলা ১১টার দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সূর্যমুখী ভবনের একটি কক্ষে নিজের গলায় গামছা পেঁচিয়ে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন- হাজতি বন্দি, বিরুলিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. সাইদুর রহমান সুজন। কারাগারের এমন দুর্ভেদ্য নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাঝেও কিভাবে একজন বন্দি আত্মহত্যা করার সুযোগ পেলেন, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। কারা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ঘটনায় মূলত কারাগারে প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের ত্রুটি, গাফিলতি ও দুর্নীতি অনিয়মেরই চিত্র ফুটে ওঠে।

সুজনের পরিচিত বেশ ক’জন কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত পেয়ে জানিয়েছেন, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কেরানীগঞ্জে জেলারের দুর্নীতি এবং বন্দিদের সঙ্গে খারাপ আচরণের কারণে বন্দিরা অতিষ্ঠ। সুজনের আত্মহত্যা  এসব অভিযোগকেই প্রতিষ্ঠিত করে বলে দাবি করছেন বন্দিরা। তোলপাড় সৃষ্টিকারী এই ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, গত ১৩ জুন শুক্রবার রাত আনুমানিক ১১টায় ঢাকা জেলার মাসুমের নেতৃত্বে ক’জন কারারক্ষী কারা অভ্যন্তরের সূর্যমুখী সেলে তল্লাশি চালিয়ে সুয়রেজ লাইনের পাইপ থেকে দুইটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করে।

মোবাইল ফোন দুটি মালিক কে নির্ধারণ করতে না পারায়, চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান সুজনকে তার সেল থেকে বের করে সকল বন্দিদের সামনে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন এবং গালিগালাজ করেন। বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে নিতে না পেরে পরদিন শনিবার সকালে সূর্যমুখী সেলের অভ্যন্তরে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তার আত্মহত্যার ঘটনায় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আরেক বন্দি তৎক্ষণাৎ হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান। পরে উভয়ের মৃতদেহকে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্তব্যরত এক কারারক্ষী জানান, জেলার মাসুম এখানে বদলি হয়ে আসার পর থেকেই বিভিন্ন বন্দির কাছ থেকে বিশেষ করে কারাগারে আটক আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ- যারা বিভিন্ন মামলায় আটক আছেন, তাদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করে আসছেন। কেউ চাঁদা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে তল্লাশির নামে তাকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে। হাজতি বন্দি সাইদুর রহমান সুজন চাঁদা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। এই লজ্জা তিনি মেনে নিতে না পেরে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
অভিযোগ রয়েছে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কেরানীগঞ্জের জেলার মাসুম, ডেপুটি জেলার তানজিল, সুবেদার আতাউর, কারারক্ষী মনির, মিনারুল, রবিউল, কারা কর্মকর্তা আবু তালেব, জান্নাতুল ফরহাদের সমন্বয়ে গড়া ওঠা সিন্ডিকেটের দুর্নীতি এবং বন্দিদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে বন্দিদের একাংশ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে গত ১০ এপ্রিল বৃহস্পতিবার দুপুর। তারা এতটাই ক্ষব্ধ ছিলেন যে, জেলার মাসুম ও আরেকজন কর্মকর্তাকে লাঞ্ছিত  করেন। এতে প্রচ- ক্ষুব্ধ হয়ে মাসুমের নির্দেশে এক হাজার বন্দিকে শারীরিকভাবে মারপিট ও নির্যাতন করা হয়।

তাদের ২৪ ঘণ্টা  কারা অভ্যন্তরের বিশেষ রুমে আটকে রেখে শেষ পর্যন্ত শাস্তিমূলক বদলি করা  হয়  কাশিমপুর কারাগারে। তারপরে বড় কেলেঙ্কারি ঘটে যায় গত কোরবানি ঈদের আগে। কারাবন্দিদের অভিযোগ, জেলার মাসুম সিন্ডিকেট গত কোরবানি ঈদের সময় দুটো ইউনিট থেকে কোরবানির জন্য ভিআইপি বন্দিদের কাছ থেকে সাধারণ কয়েদিদের জামা ও কোরবানির জন্য ৮৫  লাখ  ও মহিলা কারাগার থেকে ৩৫ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়। মাদক পাচারের অভিযোগে চাকরিচ্যুত কারারক্ষী রবিউল ও তার স্ত্রী জেসমিনকে স্কুলের সহকারী হিসেবে বহাল রেখে তাদের দিয়ে কোরবানির সময় চাঁদার টাকা তোলা হয়।

এটি প্রকাশ্যে ঘটলেও  অভিযোগ আমলে নেয়নি কারাপ্রশাসন। তবে ভিআইপি বন্দিদের কক্ষে বাসা থেকে আনা খাবার পৌঁছে দেওয়ার অভিযোগ তদন্ত করার জন্য কাশিমপুর কারাগারের জেলসুপার মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুনকে সভাপতি ও কিশোরগঞ্জ জেলা কারাগারের জেলার সর্বোত্তম দেওয়ানকে সদস্য করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় ৪ ফেব্রুয়ারি। কমিটিকে ৫ কর্মদিবসে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে কারাপ্রশাসন জানিয়েছে, এটা ছিল তদন্তের নামে আইওয়াশ। মূল অভিযুক্ত জেলার মাসুমের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের কোনো প্রমাণ মিলেনি বলে তদন্তÍ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এতে কারাগারের সাধারণ বন্দি ও কারা প্রশাসনের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। 
কারা মহাপরিদর্শক  ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, বন্দি সাইদুর রহমান সুজন ডিটেনশনে সূর্যমুখী ভবনের একটি কক্ষে ছিলেন। সকালে বন্দি সুজন নাশতাও করেছেন। ওই কক্ষে তিনজন বন্দি, একজন সম্ভবত আদালতে গিয়েছেন, অপরজন ঘুমিয়ে ছিলেন, এ সুযোগে সুজন নিজের গামছা পেঁচিয়ে জানালার সঙ্গে গলায় ফাঁস দেন। পরে তাকে কারা হাসপাতাল থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে মারা যান।
আইজি প্রিজন্স জানান, তার বিরুদ্ধে অনেক মামলা আছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনেরও মামলা আছে। তবু কারা অভ্যন্তরে আত্মহত্যার ঘটনা কীভাবে হলো, এ বিষয়ে একটি কমিটি করে তদন্ত করে দেখা হবে। সুজনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলাসহ মোট ১৫টি মামলা রয়েছে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন ও স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেলে সুজনও আত্মগোপনে চলে যান। তবে জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে রাজধানীর উত্তরার একটি ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ।

এরপর থেকে তিনি কারাবন্দি ছিলেন। জানতে চাইলে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার  সৈয়দ মো. মোতাহার হোসেন দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, বাসা থেকে খাবার এনে ভিআইপি বন্দিদের রুমে সরবরাহ করার কোন সুযোগ নেই। ক’জন আওয়ামী লীগ নেতার কক্ষে বিশেষ উপায়ে খাবার সরবরাহের লিখিত অভিযোগ আমরা তদন্ত করেছি। তাতে অভিযোগের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। আর বন্দিদের খাবার  ন্যায্য প্রাপ্য থেকে কম দেওয়ার অভিযোগও ঠিক নয়। আমরা এ অভিযোগও খতিয়ে দেখেছি। প্রয়োজনে আরও বিস্তারিত তদন্ত করতে দেখতে রাজি। 
কারা অভ্যন্তরে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, সুজন নানাবিধ রোগশোকে ভুগছিলেন। তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। বিভিন্ন ধরনের ওষুধ খেতেন। বলতে গেলে সুজন ডিপ্রেশনে ছিলেন। সে জন্যই আত্মহত্যা করে বসেন। এটাও তদন্ত করে দেখেছি। আসলে প্রতিটি অভিযোগই বেশ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। আমরা কোনো কিছুই ইগনর করছি না।
ঈদের সময় সাধারণ বন্দিদের জামা কিনে দেওয়া ও কোরবানির জন্য  মাসুম সিন্ডিকেট কর্তৃক কোটি টাকাার ওপরে চাঁদা তোলার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মোহাম্মদ মোতাহার হোসেন বলেন, আমার কাছে ্এ ধরনের কোনো অভিযোগ কেউ করেনি। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, এসব অভিযোগের লিখিত যদি কেউ দেয়, সেটাও তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্যানেল হু

×