ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফাহিম হাসান আকাশের বিরুদ্ধে অভিযোগ (প্রতীকী ছবি)
প্রবাসী ও ধনী ছেলেদের টার্গেট করে খুলনায় ভয়ংকর প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার জাল বিছিয়েছে একটি চক্র। চক্রটি গ্রাম থেকে শহরে আসা মেয়েদের টার্গেট করে প্রথমে অল্প ভাড়ায় ফ্ল্যাটে আশ্রয় দেয়। তারপর সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন কনটেন্ট তৈরি করে সবার মাঝে পরিচিত করে। সর্বশেষ কৌশলে বাধ্য করে দেহ ব্যবসায়। একই সঙ্গে ওই মেয়েদের দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করেও চলে প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাৎ।
এসব ছাড়াও চক্রটির বিরুদ্ধে শারীরিক নির্যাতন, মাদক ব্যবসা, এমনকি নারী পাচারের ভয়ংকর অপরাধেরও অভিযোগ রয়েছে। ভুক্তভোগী এক প্রবাসীর করা অভিযোগের ভিত্তিতে অনুসন্ধানে নামে দেশের একটি গণমাধ্যম। অনুসন্ধানেই বের হয়ে আসে খুলনার বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের টার্গেট করে দেহ ব্যবসা এবং মাদকের ভয়ংকর সিন্ডিকেটের তথ্য।
কাতার প্রবাসী বিলাল (২৬)। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সম্পর্ক হয় খুলনার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পরিচয় দেওয়া নুসরাত জাহান অর্নার সঙ্গে। নুসরাত ও তার মায়ের সঙ্গে নিয়মিত কথা হতো বিলালের। বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে ২১ লাখ টাকা নিয়েছে মা ও মেয়ে। প্রেমের ২ বছরের মাথায় ক্যানসার আক্রান্ত বাবার চিকিৎসা করাতে দেশে ফেরেন বিলাল। কিন্তু ফেরার মাত্র একদিন পরই আসল চেহারা দেখায় নুসরাত। তার সিন্ডিকেট দিয়ে নির্মম নির্যাতন চালায় বিলালের ওপর। দেওয়া হয় মামলা।
বিলাল বুঝতে পারেন প্রেমের নামে তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন। ২৬ দিন পর কারামুক্ত হন তিনি। এরপর ঘটনার বর্ণনা দিয়ে এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পাল্টা মামলা করেছেন বিলাল। মামলায় এসআই সুকান্ত, নুসরাত জাহান অর্নাসহ চক্রের ৫ সদস্যকে আসামি করা হয়। মামলাটি তদন্ত করছে পিবিআই কর্মকর্তা ইকবাল।
বিলাল অভিযোগ করে বলেন, সাড়ে পাঁচ বছরের প্রবাস জীবন শেষে দেশে এসে ক্যানসারে আক্রান্ত পিতার চিকিৎসা করাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু নুসরাত আর তার সিন্ডিকেট যে কত ভয়ংকর হতে পারে তা আমার ধারণার বাইরে ছিল। এসআই সুকান্ত নামে এক পুলিশের মাধ্যমে আমাকে ‘ক্যাসল সালামে’ ডেকে নেওয়া হয়। তারপর আমার মোবাইল কেড়ে নিয়ে আমাকে হাতকড়া পরিয়ে থানায় নিয়ে যায়। ওসির রুমে অন্তত ৭/৮ জন আমাকে নির্মম নির্যাতন করে। ইলেকট্রিক শক দেয়। আমাকে মারধরের ভিডিও আমার পরিবারের কাছে পাঠিয়ে ৩০ লাখ টাকা দাবি করে। কিন্তু বড় ভাই মাত্র দেড় লাখ টাকা দিতে পারেন। তবে টাকা কম দেওয়ায় আমাকে না ছেড়ে উল্টো আমার মোবাইলে কিছু অশ্লীল ভিডিও পাঠিয়ে পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা দেয়। রিমান্ডে নিয়ে আবারও নির্যাতন করে। রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানোর ২৬ দিনের মাথায় আমি জামিনে মুক্তি পাই।
শুধু বিলাল না, গণমাধ্যমের হাতে আসে এই চক্রটির হাতে প্রতারিত ও নির্যাতনের শিকার এমন আরও অন্তত ৬ ভুক্তভোগীর তথ্য। এদের মধ্যে ইরাক প্রবাসী, দুজন ছাত্র ও দুজন ব্যবসায়ী রয়েছেন।
এমনই এক ব্যক্তি ইরাক প্রবাসী শাকিল (ছদ্মনাম)।গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ২০২৩ সালে ইরাকে থাকাকালে আমার সম্পর্ক হয় তাসমি নামে এক মেয়ের সঙ্গে। প্রেমের অভিনয় করে পড়াশোনা ও ভরণপোষণ বাবদ আমার কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে ৮ থেকে ৯ লাখ টাকা নেয়। এক পর্যায়ে তাসমি ও তার চক্র সম্পর্কে জেনে টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিই আমি। কিন্তু দেশে আসার পর আমার ওপর তারা নির্যাতন চালায়। আমার বিরুদ্ধে মামলা দেয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এই চক্রের দেহ ব্যবসার অংশে নেতৃত্ব দেন সোনাডাঙ্গা থানা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফাহিম হাসান আকাশ। অনিক নামে একজনের গাড়িতে সাতক্ষীরা থেকে নিয়মিত ফেনসিডিল ও গাঁজার চালান আনতেন বলে অভিযোগ আছে। নগরীর মজিদ স্মরণী রোডের ধাবা রেস্টুরেন্টে চলে এসব ফেনসিডিল ও গাঁজার অবৈধ বেচাকেনা।
রেস্টুরেন্টের সাবেক এক কর্মচারী বলেন, এলাকার কাউন্সিলর রাজুল ইসলাম রাজুর ডান হাত হিসেবে পরিচিত হওয়ায় রেস্টুরেন্টটি মূলত ফাহিমের নিয়ন্ত্রণে ছিল। যা ইচ্ছা তাই করত। এখানেই মাদক সেবনসহ সব ধরনের অপকর্ম করত সে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বিশেষ করে যারা গরিব এবং সুন্দরী তাদের টার্গেট করেন ফাহিমের কথিত স্ত্রী নুসরাত তাসমি। তাসমির বিরুদ্ধে ইরাক প্রবাসী ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, ধনীর ছেলেদের টার্গেট করে কৌশলে ফাঁসিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার একাধিক প্রমাণ মিলেছে।
গ্রুপের অপর সদস্য নুসরাত জাহান অর্না। কাতার প্রবাসী ব্যবসায়ী, কলেজ শিক্ষার্থী, মোটরসাইকেল শোরুম মালিক এবং এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অর্নার এসব কাজে তার মূল হাতিয়ার মা সালমা বেগম। এ ছাড়া সুমাইয়া সুলতানা রিমা নামে গ্রুপের অপর সদস্যের নামে বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে।
জানা যায়, ভয়ংকর এই চক্রের গড মাদার হিসেবে রয়েছে ফাতেমা আফরোজ। খুলনা অনলাইন শপিং নামে এক ফেসবুক পেজের এডমিন তিনি। মিল শ্রমিক বাবার দরিদ্র সংসারের মেয়ে ফাতেমা আফরোজ এখন একাধিক ফ্ল্যাট ও গাড়ির মালিক। খুলনা সিটি মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক, শেখ সোহেলের বন্ধু হিসেবে পরিচিত কাজী ফয়েজ এবং একজন সাংবাদিক নেতার বন্ধু হিসেবে পরিচিত এই ফাতেমা আফরোজ।
দীর্ঘদিন ব্ল্যাকমেইল হওয়া এক নারী শিক্ষার্থী বলেন, আমার মতো গ্রাম থেকে আসা অনেকেই এই চক্রের মাধ্যমে প্রতারিত হয়েছে। নর্দান এবং নর্থওয়েস্টার্ন এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এবং বর্তমান কিছু শিক্ষার্থী সোনাডাঙ্গা দ্বিতীয় ফেজ আবাসিক এলাকায় একাধিক বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে এসব অবৈধ কার্যক্রম চালায়। আমি এদের বিচার চেয়ে কোথাও বিচার পাইনি। পরে আত্মহত্যা করার জন্য আমি ছাদ থেকে লাফ দিই। কিন্তু প্রাণে বেঁচে যাই। সেখান থেকে আমি খুলনার বাইরে। এখনো খুলনায় যেতে পারছি না।
অভিযোগের বিষয়ে ফাহিম হাসান আকাশ বলেন, কাতার প্রবাসী যে ছেলে সব জায়গায় অভিযোগ করেছে তার সাথে অর্ণা নামে এক মেয়ের সম্পর্ক ছিল। অর্ণা আমাদের ছোট বোন। অর্ণার সাথে কোনো ছেলেকে কথা বলতে দেখলে বা জানলে ওই কাতার প্রবাসী তাকে নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিত। এভাবে অর্ণার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। আমরা শুনেছি যে, ওই ছেলে কাতার থেকে ফিরেছে এবং পুলিশ তাকে এসব অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছে। তখন আমিসহ অন্তত ৫০-৬০ জন সদর থানায় তাকে দেখতে যাই। কিন্তু আর কোনোদিন তার সাথে আমার দেখা বা কথা হয়নি।
তিনি বলেন, আমার স্ত্রী তাসমি ওই ছেলেটার কাছ থেকে কোনো টাকা নেয়নি। আমার স্ত্রী বরং ওকে বিভিন্ন সময়ে টাকা পাঠিয়েছে যার তথ্য আমার কাছে আছে।
অভিযোগের বিষয়ে চক্রের অন্যতম সদস্য নুসরাত তাসমি বলেন, সাইমুম নামে আমার কোনো স্বামী নেই। দুই বছর আগে আমাদের একটা সম্পর্ক ছিল। এখন তার লাইফ নিয়ে সে ভালো আছে, আমার লাইফ নিয়ে আমি ভালো আছি। আমাদের বিষয় সেটেল্ড হয়ে গেছে, এই বিষয় নিয়ে আমি আর কোনো কথা বলতে চাই না। অপরদিকে ফাতেমা আফরোজের মোবাইল ও হোয়াটসঅ্যাপে একাধিকবার কল দিলেও কলটি রিসিভ হয়নি। পরে অভিযোগের বিষয়ে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দেওয়া হলেও তার কোনো রিপ্লাই পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) মো. মনিরুজ্জামান মিঠু বলেন, ‘আমি সদ্য যোগদান করেছি। এখন পর্যন্ত এ ধরনের অভিযোগ পাইনি। অপরাধের সঙ্গে পুলিশ সদস্য বা যেই জড়িত থাকুক তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সোর্সঃ কালবেলা
এবি