ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৮ ভাদ্র ১৪৩১

দেশে ফিরে সুশীল সমাজ ও শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে ড. ইউনূস

তরুণরাই এই দেশ নতুন করে গড়ে তুলবে

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ০০:২৪, ৯ আগস্ট ২০২৪

তরুণরাই এই দেশ নতুন করে গড়ে তুলবে

তরুণরাই এই দেশ নতুন করে গড়ে তুলবে

শান্তিতে নোবেলবিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশে ফিরেই বলেছেন, ‘আজ আমাদের গৌরবের দিন। যে বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশ আজ নতুন বিজয় দিবস সৃষ্টি করল, সেটাকে সামনে রেখে এবং আরও মজবুত করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। যারা এটাকে  সম্ভব করেছে, যে তরুণ সমাজ, তাদের প্রতি আমি আমার সমস্ত প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। তারা আমার পাশে আছে।

এরা এই দেশকে রক্ষা করেছে, এ দেশকে পুনর্জন্ম দিয়েছে। এ পুনর্জন্মে যে বাংলাদেশ পেলাম, সে বাংলাদেশ যেন দ্রুতগতিতে এগিয়ে যেতে পারে সেটাই আমাদের শপথ। সেটি আমরা রক্ষা করতে চাই, এগিয়ে যেতে চাই। 
এ সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে প্রথম নিহত রংপুরের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের কথা স্মরণ করে আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠেন ড. ইউনূস।

তিনি বলেন, ‘আবু সাঈদের কথা মনে পড়ছে। যে আবু সাঈদের ছবি বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের মনে গেঁথে আছে। এটা কেউ ভুলতে পারবে না। কী অবিশ্বাস্য একটা সাহসী যুবক বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এবং তার পর থেকে আর কোনো যুবক, কোনো যুবতী আর হার মানেনি। সামনে এগিয়ে গেছে এবং বলেছে, যত গুলি মারো, মারতে পারো, আমরা আছি।’
আর এই দৃঢ় প্রত্যয়ের কারণেই সারাদেশে আন্দোলন ছড়িয়ে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যার কারণে বাংলাদেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীনতা অর্জন করল।

এই স্বাধীনতাটা আমাদের রক্ষা করতেই হবে। শুধু রক্ষাই নয়, এর সুফল প্রতিটি মানুষের ঘরে পৌঁছে দিতে হবে; তা না হলে এ স্বাধীনতার কোনো দাম নেই। এ স্বাধীনতাটা পৌঁছানোই হলো আমাদের শপথ এবং দৃঢ় প্রতিজ্ঞা।’
বৃহস্পতিবার দুপুরে দেশে ফিরে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও ছাত্রদের উদ্দেশে বলেন, এই দেশ তোমাদের, এটাকে তোমরা মনের মতো করে গড়ে তুলবে। তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘আজকের তরুণ সমাজকে এটা বোঝানো দরকার যে, এই দেশ তোমাদের। এটাকে তোমরা তোমাদের মনের মতো করে গড়ে তুলবে।

তোমরা যেহেতু স্বাধীন করতে পেরেছ, তোমরা এটাকে তোমাদের মনের মতো করে গড়ে তুলতেও পারবে। তোমাদের দেখে সারা দুনিয়া শিখবে যে কীভাবে একটা দেশকে তরুণ সমাজ গ্রহণ করতে পারে এবং পাল্টে ফেলতে পারে।
তিনি বলেন, ‘আমি বারেবারে উপদেশ দিই, পুরনোদের বাদ দাও। পুরনোদের চিন্তা দিয়ে কিছু হবে না। শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো দুনিয়ার কথা বলছি। তোমাদের মধ্যে যে শক্তি আছে, সৃজনশীলতা আছে, সেটাকে কাজে লাগাতে হবে। শুধু বই খাতাতে লেখার জিনিস না, সেটা প্রকাশ করার জিনিস।’
তিনি বলেন, ‘যারা এটাকে সম্ভব করেছে- তরুণ সমাজতাদের প্রতি আমি আমার সমস্ত প্রশংসা এবং কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। তারা আমার পাশে আছে। তারা এ দেশকে রক্ষা করেছে, এ দেশকে পুনর্জন্ম দিয়েছে এবং এ পুনর্জন্মে যে বাংলাদেশকে পেলাম সে বাংলাদেশ যেন দ্রুতগতিতে এগিয়ে যেতে পারে, সেটাই আমাদের শপথ। সেটা আমরা রক্ষা করতে চাই।’
গত কয়েকদিনে দেশের মধ্যে যে সহিংসতা হয়েছে সেগুলোকে ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করেছেন গাড়িতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, আমাদের অগ্রগতির জন্য এটিকে (সহিংসতা) রোধ করতে হবে। বিশৃঙ্খলা, সহিংসতা এবং ষড়যন্ত্র হলো অগ্রগতির বাধা। প্রতিটি মানুষ আমাদের ভাই এবং বোন। তাদের বোঝাতে হবে।
তিনি বলেন, ‘মানুষ যেন জানে, যে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অর্থ হলো তার নিজের পরিবর্তন, ব্যক্তির পরিবর্তন নয়, সুযোগের পরিবর্তন, তার ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যতের পরিবর্তন।’
ড. ইউনূস বলেন, আজকে আমাদের দায়িত্ব হলো, যেটা তারা অর্জন করে নিয়ে এসেছে সেটা এখন তাদের দিয়ে করিয়ে দেওয়া। সরকার বলতে একটা জিনিস আছে, কিন্তু মানুষের কোনো আস্থা নেই। মানুষ মনে করে, সরকার হচ্ছে একটা দমন পীড়নের যন্ত্র। এটা একটা ভয়ের জিনিস, যাকে সামাল দিয়ে চলতে হবে। এটা সরকার হতে পারে না। সরকারকে দেখে মানুষের বুক ফুলে উঠবে। মনে করতে হবে সরকার আমাকে রক্ষা করবে, সহযোগিতা করবে, আমার সরকার আমার পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু সরকার কারও জন্য পাশে দাঁড়ায় না কোনো সময়।
তিনি বলেন, এখন যে সরকার হবে, সে সরকার মানুষকে রক্ষা করবে, আস্থাভাজন হবে। তোড়জোড় করে তাকে ভালো বলাতে হবে না। সে নিজে নিজে বিশ্বাস করবে যে সরকার ভালো, সরকারি লোক দেখলে বলবে যে এ আমার লোক, আমাকে রক্ষা করার লোক। সেই আস্থাটা আমাদের ফিরিয়ে আনতে হবে মানুষের মধ্যে। তা হলে মানুষও যোগ দেবে এর মধ্যে।
তিনি বলেন, সারা বাংলাদেশ একটা পরিবার। এই পরিবার আমরা একসঙ্গে চলতে চাই। আমাদের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব যা কিছু আছে, সরিয়ে ফেলতে চাই। যারা বিপথে গেছে, তাদের পথে আনতে চাই। যাতে করে একসঙ্গে আমরা কাজ করতে পারি।
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কথা জানিয়ে তিনি বলেন, এর মধ্যে আসার পথে শুনলাম, এখানে আইনশৃঙ্খলার ব্যাঘাত হচ্ছে। মানুষ মানুষকে আক্রমণ করছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে, সম্পদ জ্বালিয়ে নষ্ট করছে, পুড়িয়ে দিচ্ছে, অফিস-আদালতে আক্রমণ করছে, সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ করছে, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আহমাদিয়া সবার ওপর আক্রমণ করছে। এগুলো ষড়যন্ত্রের অংশ। 
ড. ইউনূস বলেন, আমাদের কাজ হলো সবাইকে রক্ষা করা। প্রতিটি মানুষকে রক্ষা করা। প্রতিটি মানুষ আমাদের ভাই, আমাদের বোন, তাদের রক্ষা করা এবং আমাদের একটা শৃঙ্খলায় ফিরে আসা উচিত। এগুলো হলো অগ্রগতির সবচেয়ে বড় শত্রু। আমাদের যে যাত্রা শুরু হলো, সে যাত্রার শত্রু। কাজেই এই শত্রুকে যাতে রোধ করা যায়, তাদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে হোক, তাদের আইনশৃঙ্খলার হাতে দিয়ে হোক।  এটা মনে রাখতে হবে, তাদের মেরে ফেলা ঠিক না। আইনশৃঙ্খলা নিজের হাতে নেওয়া ঠিক না।

আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এমন হতে হবে যে তাদের হাতে সোপর্দ করে, এতে আমরা নিশ্চিত থাকব যে, এর একটা বিহিত হবে। এমন হলো  যে আমরা দিয়ে দিলাম, তারা টাকা নিয়ে ছেড়ে দিল, এটা যেন না হয়।
তিনি বলেন, আপনারা আমার ওপর আস্থা রেখে আমাকে আহ্বান জানিয়েছেন, ছাত্ররা আহ্বান জানিয়েছে। সেটাতে আমি সাড়া দিয়েছি।

দেশবাসীর কাছে আমার আবেদন, আপনারা যদি আমার ওপর বিশ্বাস রাখেন, ভরসা রাখেন, তা হলে নিশ্চিত করেন যে দেশে কোনো জায়গায় কারও ওপর কোনো হামলা হবে না। এটা আমাদের প্রথম দায়িত্ব। এটা যদি আমি করতে না পারি, আমার কথা যদি না শোনেন আপনারা, তা হলে আমার কোনো প্রয়োজন এখানে নেই। আমাকে বিদায় দেন, আমি আমার কাজে থাকি। সেটা নিয়েই আমি ব্যস্ত থাকি। আর যদি আমাকে প্রয়োজন মনে করেন, তা হলে এটা দেখাতে হবে যে আমার কথা আপনারা শোনেন।

আমার কথা না শুনলে মনে করব আমার কোনো প্রয়োজন নেই।
তিনি বলেন, ‘আমার প্রথম কথা হলো, আপনারা এই বিশৃঙ্খলা থেকে দেশকে রক্ষা করেন। আপনারা সহিংসতা থেকে দেশকে রক্ষা করেন। যাতে আমরা আমাদের ছাত্রদের দেখানো পথে এগিয়ে যেতে পারি।’
ড. ইউনূস বলেন, বাংলাদেশ একটু খুব সুন্দর দেশ হতে পারে। এটা খুবই সম্ভাবনাময় দেশ। এই সম্ভাবনাকে আমরা নষ্ট করে দিচ্ছি। এখন আবার সেই বীজতলা তৈরি করতে হবে। আবার আমাদের জেগে উঠতে হবে। ছাত্ররা এই বীজতলা তৈরি করবে। তাদের হাত দিয়েই হবে এবং তাদের দিকেই আমরা তাকাব।
তিনি বলেন, এখানে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা আছেন, সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী, নৌ বাহিনীর প্রধানরা যারা আছেন, তাদের প্রতিও অনুরোধ, আমরা একটা পরিবার। এই পরিবারের মধ্যে যেন কোনো গোলোযোগ না হয়। আমরা যেন একযোগে, একসঙ্গে চলতে পারি এবং তড়িৎগতিতে একটি সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার পথে এগিয়ে যেতে পারি। আপনাদের সবার কাছে আমার আবেদন, আমাদের সেই সুযোগ দিন।

×