ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

প্রশাসন ক্যাডারের আধিপত্য, সুযোগ নেই শিক্ষকদের

শিক্ষায় আমলানির্ভরতা

আসিফ হাসান কাজল

প্রকাশিত: ০০:১৪, ১৯ মে ২০২৪

শিক্ষায় আমলানির্ভরতা

প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট

প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট। অর্থের অভাবে শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত দরিদ্র, মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা নিশ্চিত করতেই এই ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছে। এই ট্রাস্ট্রের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে আছেন স্মৃতি কর্মকার। তিনি একজন অতিরিক্ত সচিব। এরপরই পরিচালক হিসেবে আছেন মো. ফরহাদ সিদ্দিক। তিনিও অতিরিক্ত সচিব। ট্রাস্টের সমন্বিত কর্মসূচি হিসেবে একটি স্কিম রয়েছে।

সেটিরও পরিচালক একজন যুগ্ম সচিব। বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)- এই প্রতিষ্ঠানটির কাজ সারাদেশ থেকে পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া। এর জন্য আবেদন গ্রহণ, পরীক্ষার প্রশ্ন প্রণয়ন ও ফল প্রকাশ করতে হয় সংস্থাটির। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান পদে আছেন অতিরিক্ত সচিব মো. সাইফুল্লাহিল আজম। এর বাইরে দুজন সদস্য রয়েছেন যারা যুগ্মসচিব। এ প্রতিষ্ঠানের সচিব পদে রয়েছেন একজন উপসচিব।

বিগত সময়েও আমলারাই এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান পদে আসীন ছিলেন। অথচ এনটিআরসিএ আইনে বলা হয়েছে, সরকার কর্তৃক সচিব বা যুগ্ম সচিব পযমর্যাদা সম্পন্ন একজন কর্মকর্তা অথবা বিশ^বিদ্যালয় বা সরকারি কলেজের একজন প্রথিতযশা প্রবীণ অধ্যাপক চেয়ারম্যান নিযুক্ত হবেন। কিন্তু এই পদে কোন সময় শিক্ষকরা সুযোগ পাননি পদটি আমলাদের বাইরেও যায়নি। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠেছে, হাজার হাজার বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কাজটা কী?
শুধু প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট বা এনটিআরসিএ নয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রথম সারির একাধিক প্রতিষ্ঠান আমলাদের দখলে। এর ফলে শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষা ক্যাডারদের অবস্থান সংকুচিত হচ্ছে, যা অনেকটা বিলীন হওয়ার পথে। শিক্ষা ক্যাডাররা বলছেন, এসব প্রতিষ্ঠানের নিচের পদগুলোতে কিছু শিক্ষা ক্যাডার রয়েছেন।

তবে প্রধান পদে প্রশাসন ক্যাডারদেরই নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। ফলে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার সার্ভিসটি ক্রমেই খর্বকায় হয়ে পড়েছে। ক্যাডারদের মধ্যে আন্তঃবৈষম্যের সঙ্গে বাড়ছে হতাশা। অন্যদিকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন পুরোপুরিই আমলানির্ভর। সেখানে শিক্ষা ক্যাডারদের কোনো সুযোগই রাখা হয়নি।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক জনকণ্ঠকে বলেন, যথাযথ লোককে যথাযথ চেয়ারে বসানো উচিত। এমন একটি প্রবাদও রয়েছে। এবং এর উপযোগিতাও শতভাগ সত্য। শিক্ষা প্রশাসনে যত বেশি শিক্ষক যুক্ত করা যাবে শিক্ষায় অগ্রগতি তত বেশি হবে।

কারণ শিক্ষকরাই ক্লাস রুমের পরিবেশ ও প্রকৃত অবস্থা বোঝেন। কিন্তু নীতি-নির্ধারক পর্যায়ে আমলাদের আধিক্য ও সিদ্ধান্ত নানা সমালোচনার জন্ম দিচ্ছে। তিনি বলেন, সরকার চাইছে কারিগরি শিক্ষাকে অধিকতর জনপ্রিয় করতে। এর জন্য মন্ত্রণালয়ের পুনর্গঠন প্রয়োজন। কারণ মন্ত্রণালয়ে একজন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী রয়েছেন। কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগকে প্রতিমন্ত্রীর অধীনে দেওয়া গেলে বৃত্তিমূলক শিক্ষা বিস্তৃত হবে ও গতি বাড়বে বলে তিনি মনে করেন।
কয়েক বছর ধরেই শিক্ষার মান নিয়ে সামাজিকভাবে সমালোচনা হচ্ছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষকদের না থাকাটায় কি দায়ী- সেটিও এখন চিন্তার বিষয় হয়ে উঠেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মন্ত্রণালয়ের অধীনে দুটি বিভাগ রয়েছে। এর মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ ও কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগ।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের মধ্যে ২৩টি দপ্তর, অধিদপ্তর ও সংস্থা রয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষা বোর্ড আছে ৯টি। এর বাইরে একটি অবসর সুবিধা বোর্ড ও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। এসব বোর্ড এখনো শিক্ষা ক্যাডররাই পরিচালনা করেন। তবে শিক্ষকরা বই ছাপানোর কি বোঝেন- এমন নানা ধরনের অপ্রীতিকর প্রশ্নের উত্তর তাদের হরহামেশাই দিতে হচ্ছে। এ ছাড়াও এই বিভাগের যেসব প্রকল্প রয়েছে, সেখানেও আমলা ও শিক্ষা ক্যাডারের বাইরের অনেক কর্মকর্তা প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন।
এর মধ্যে একটি বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো ব্যানবেইস। শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত তথ্য নেওয়া প্রতিষ্ঠানটির কাজ। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ব্যানবেইজের মহাপরিচালকও একজন সরকারি আমলা। তিনি একজন অতিরিক্ত সচিব। কাঠামো অনুযায়ী এই দপ্তরে একজনই পরিচালক আছেন। তিনিও উপসচিব।
ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান জনকণ্ঠকে বলেন, আমলা ছাড়া দেশ চলবে না। আমাদের জন্য তাদের অবশ্যই লাগবে। তবে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে সর্বক্ষেত্রে আমলানির্ভরতা। যিনি কৃষিতে পড়েছেন তাকে যদি কারিগরি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পদে বসিয়ে দেওয়া হয়, সেক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষার উন্নতি কীভাবে প্রত্যাশা করা যাবে? উপযুক্ত মানুষকে উপযুক্ত জায়গায় বসাতে হবে।

একজন শিক্ষক তিনি সারাজীবন শিক্ষকতা পেশায় থেকে যে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন শেষ সময়ে একটি সংস্থার প্রধান হলে তার কিছু আউটপুট বের হবে। যা থেকে শিক্ষা ব্যবস্থা ও দেশ ও জাতি উপকৃত হবে।
শিক্ষার আরেকটি দপ্তরের নাম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট (আমাই)। ভাষার বিস্তৃতি ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করায় প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য। নিয়ম অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটিতে ভাষাবিদ, শিক্ষাবিদ থাকার কথা। দীর্ঘ সময় মহাপরিচালক পদে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে সর্বশেষ আমাই আইন সংশোধন করে মহাপরিচালক পদ পরিবর্তন করে একে পরিচালক করা হয়েছে।

এর ফলে বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষকরাও অনীহা দেখাচ্ছেন এই পদে আসতে। ভাষা সম্পর্কিত বিষয় হলেও বর্তমানে ইনস্টিটিউটের প্রধান পরিচালক (রুটিন দায়িত্ব) হিসেবে আছেন একজন যুগ্মসচিব। এ ছাড়াও একজন পরিচালক হিসেবে প্রশাসন ক্যাডারের উপসচিব কর্মরত আছেন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক জনকণ্ঠকে জানান, আইন করে মহাপরিচালক পদকে পরিচালক করার পেছনে আমলাদের দুরভিসন্ধি আছে।

একজন বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষক শুধু সিনিয়র সিটিজেন নন, সমাজে শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র। সম্মান না জানানোর জন্যই পদটিকে পরিচালক করে দেওয়া হয়েছে। আমাইয়ের একাধিক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে জানান, পরিচালক পদের কারণে এখন শিক্ষকরা প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব নিতে চাইছেন না। কারণ এর চেয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদ অনেক সম্মানিত। এরপরও অনেক শিক্ষক বলছেন, পদটিকে গ্রেড ১ করা হলে বিষয়টি তারা ভেবে দেখবেন।
অন্যদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও শিক্ষা বিভাগের অধীনে ৬টি দপ্তর বা সংস্থা রয়েছে। এর মধ্যে  কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর, মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর, জাতীয় কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ও গবেষণা একাডেমি (নেকটার) তিনটি প্রতিষ্ঠান প্রধানই প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা।

এর মধ্যে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরে মহাপরিচালক পদে আছেন মো. আজিজ তাহের খান (অতিরিক্ত সচিব)। ইকোনমিক ক্যাডারে বিসিএসে যোগদান করেন। এর আগে তিনি সদস্য-অর্থ (অতিরিক্ত সচিব) হিসেবে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) এ দায়িত্ব পালন করেছেন।

এই দপ্তরে পরিচালক (পিআইডব্লিউ) পদে আছেন একজন অতিরিক্ত সচিব, পরিচালক ভোকেশনাল পদে রয়েছেন একজন যুগ্ম সচিব।
মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা দেখভাল করে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর। এই দপ্তরের প্রধানও একজন অতিরিক্ত সচিব। দপ্তরটিতে দুইজন পরিচালক আছেন তাদের একজন শিক্ষা ক্যাডারের অন্যজন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা।

এ ছাড়াও একজন সহকারী সচিবকে সহকারী পরিচালক পদে বসানো হয়েছে। কারিগরি বিভাগের আওতায় আরও রয়েছে জাতীয় কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ও গবেষণা একাডেমি (নেকটার)। এই দপ্তরের প্রধানও একজন উপসচিব পদমর্যাদার। সংস্থাটির ওয়েবসাইটে অফিস প্রধানের যোগ্যতা এম এ পাস উল্লেখ করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোসলেহ উদ্দিন আহমদ জনকণ্ঠকে বলেন, প্রশাসন জনবল কাঠামোতে পদ ফাকা না হলেও কয়েকগুণ কর্মকর্তার পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। যে কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ফলে বিভাগের মধ্যে আরেক বিভাগ, দপ্তরের মধ্যে আরেক দপ্তর তৈরির উদাহরণ আমরা দেখছি।

কিন্তু এরপরও স্থানের সংকুলান না হওয়ায় চাকরির শেষ জীবনে পুরস্কারের মতো তাদের একটি সংস্থার প্রধান করা হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। এখানে শিক্ষা বিষয়টি যারা ভালো বোঝেনÑ তাদেরই যুক্ত করা উচিত। কিন্তু প্রশাসন ক্যাডাররা মনে করেন, যে কোনো সংস্থায় তারা যাওয়া মানে অন্যদের আর সুযোগ থাকবে না। কারণ তারাই শ্রেষ্ঠ।

×