ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

নীতিমালা থাকলেও প্রয়োগ নেই

ঠেকানো যাচ্ছে না ॥ কোচিং সেন্টারে যৌন হয়রানি

আসিফ হাসান কাজল

প্রকাশিত: ২৩:৪৬, ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

ঠেকানো যাচ্ছে না ॥ কোচিং সেন্টারে যৌন হয়রানি

শ্রেণিকক্ষে পাঠদান হয় না

শ্রেণিকক্ষে পাঠদান হয় না। ভালো ফলের জন্য শিক্ষার্থীদের প্রভাবিত করেন শিক্ষকরা। অভিভাবকরা সন্তানকে নিয়ে শামিল হন ভালো ফলের প্রতিযোগিতায়। নানা প্রলোভনে সন্তানদের কোচিংয়ে পাঠাচ্ছেন অভিভাবকরা। আর ওইসব কোচিং সেন্টারেই যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে কোমলমতি ছাত্রীরা। অথচ এক যুগ আগে ‘কোচিং বাণিজ্য বন্ধের নীতিমালা’ জারি করেছে সরকার।

সেখানে কোনো স্কুলের শিক্ষক কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত থাকলে তাকে চাকরি থেকে বহিষ্কার করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু  নীতিমালা থাকলেও বাস্তবে তা প্রয়োগের কোনো নজির নেই। ফলে কোচিং সেন্টার বন্ধ এবং এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী হয়রানিও ঠেকানো যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোচিং সেন্টার মনিটরিং কমিটি বিগত কয়েক বছরে একটি বৈঠকও করেনি। দেখা যাচ্ছে, পরিচালনা পর্ষদ ও প্রতিষ্ঠান প্রধানকে নিয়মিত মাসোহারা দিয়ে স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের বাসায় ডেকে নিয়ে কোচিং করাচ্ছেন। কোচিং সেন্টার বন্ধের কাগুজে নীতিমালা দিয়ে কোনো কাজ হচ্ছে না।

উল্টো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতা এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) দেখেও না দেখার ভান করায় ব্যাঙের ছাতার মতো কোচিং সেন্টার বাড়ছে। এসব কোচিং সেন্টার চালাচ্ছেন প্রসিদ্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাই। এসব বন্ধে আইন করা দরকার বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা।
এ বিষয়ে অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউল কবির দুলু জনকণ্ঠকে বলেন, মন্ত্রণালয় এক অর্থে কোচিং ব্যবসাকে উৎসাহিত করছে। কারণ প্রতি বছর দুইবার করে তারা পাবলিক পরীক্ষার সময় কোচিং বন্ধ এবং খোলার তারিখ ঘোষণা করছে। এভাবে একটি শিক্ষাব্যবস্থা চলতে পারে না। তিনি আরও বলেন, কোচিংয়ে যে পরিমাণ যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটে, তার এক শতাংশও সামনে আসে না।

অধিকাংশ পরিবার সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে চেপে যায়। এ বিষয়ে সরকারকে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। জানা যায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকদের কোচিং ব্যবসা নিষিদ্ধ করে ২০১২ সালে ‘কোচিং বাণিজ্য বন্ধের নীতিমালা’ জারি করে সরকার। ওই নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে পারেন না।

তবে প্রতিষ্ঠানপ্রধানের অনুমতি নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের সর্বাধিক ১০ শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারেন। তবে ওই শিক্ষার্থীদের নাম, রোল ও শ্রেণি সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানপ্রধানকে জানাতে হবে। নীতিমালা না মানলে তিন ধরনের শাস্তির কথা বলা হয়েছে। ‘প্রথমত, এমপিওভুক্ত হলে এমপিও স্থগিত, বাতিল, বেতন কমিয়ে দেওয়া কিংবা বরখাস্ত করা হবে। দ্বিতীয়ত, এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের এমপিওবিহীন শিক্ষক হলে প্রতিষ্ঠান থেকে দেওয়া বেতন স্থগিত কিংবা চাকরি থেকে বরখাস্তের মতো ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তৃতীয়ত, প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত না হলে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা, বেতন স্থগিতের মতো ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া হলে সরকার ওইসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেবে।’ অথচ কোচিংয়ে জড়িত কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে এমন শাস্তি হয়েছে, তার কোনো নজির নেই।

কোচিং বাণিজ্যসংক্রান্ত নির্দেশনা শিক্ষকরা না মানার বিষয়ে মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, কোনো শিক্ষার্থী শিক্ষকের নিজের প্রতিষ্ঠানের না অন্য প্রতিষ্ঠানের তা নির্ণয় করা খুবই কঠিন। সারাদেশে এটি দেখা, জনবলসাপেক্ষ ব্যাপার, যা মাউশির নেই। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের এ বিষয়ে দায়িত্ব দেওয়া রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমে কোচিং করার, টিউশন পড়ার তেমন প্রয়োজন হচ্ছে না। আমাদের বিশ্বাস, দিনে দিনে কোচিংয়ের প্রবণতা কমে আসবে।
তবে অভিভাবকরা বলছেন, আগে শিক্ষার্থীরা সাধারণত ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে প্রাইভেট পড়ত বা কোচিং করত। শিক্ষার্থীরা নিজেদের স্বাচ্ছন্দ্য অনুযায়ী কোচিং সেন্টার বা যার যার পছন্দের জায়গায় পড়ত। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমে নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের হাতেই বেশিরভাগ নম্বর থাকায় শিক্ষার্থীদের কমপক্ষে চার-পাঁচটি বিষয়ে প্রাইভেট পড়তে হচ্ছে। অনেক শিক্ষক আবার প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করছেন।
এ বিষয়ে রাজধানীর একাধিক শিক্ষকও বলছেন, ঘটনা মিথ্যা নয়। অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষকরা এমন নোংরামি করছেন। তবে তা হাতেগোনা। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন ঘটনা আরও বেশি ঘটছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজধানীর সরকারি মাধ্যমিকের এক সহকারী শিক্ষক জনকণ্ঠকে বলেন, নতুন কারিকুলাম অনেক অভিভাবক বুঝতে পারছেন না। এই সুযোগে অনেক শিক্ষক নানাভাবে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের ভুল বুঝিয়ে কোচিং-টিউশনির ফাঁদে ফেলছেন।
সম্প্রতি ভিকারুননিসা নূন স্কুলের আজিমপুর শাখার গণিত শিক্ষক মুরাদ হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলেছে তার কোচিং সেন্টারের ছাত্রীরা। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর আদালতের নির্দেশে তিনি দুদিনের রিমান্ডে আছেন। এরপরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি কোচিং বন্ধে একটি নোটিস প্রকাশ করেছে। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের কোনো শিক্ষক যেন কোচিংয়ের সঙ্গে জড়িত না থাকে, সে বিষয়ে কড়া সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে।

মঙ্গলবার কলেজটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী স্বাক্ষরিত নোটিসে বলা হয়েছে, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সকল শিক্ষককে সব ধরনের কোচিং বন্ধ রাখতে নির্দেশ দেওয়া হলো। কোনো শিক্ষক কোচিং করাচ্ছেন- এমন প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে সরকারি বিধি মোতাবেক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অন্যদিকে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ বাদেও আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের মূল ক্যাম্পাস, শাখা ক্যাম্পাসগুলোর আশপাশে হাঁটলে কোচিং সেন্টারের বহু সাইনবোর্ড চোখে পড়ে, যেগুলো ওইসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক চালান। কিন্তু এরপরও ওসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এমন কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।
জানতে চাইলে কেকা রায় চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, অনেক চাপ এলেও শিক্ষকদের আর কোচিংয়ে পড়ানোর সুযোগ দেওয়া হবে না। যদি দিতেও হয়, তবে তা হবে শুধুই অনলাইনে। কারণ করোনার সময় অনলাইনে কোচিং করার বিষয়ে শিক্ষার্থীরাও অভ্যস্ত।

২০১১ সালে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের বাংলার শিক্ষক পরিমল জয়ধর কোচিং করানোর সময় এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করেন। ন্যক্কারজনক ওই ঘটনায় ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক ভিকারুননিসা নূন স্কুলের বসুন্ধরা শাখার ওই শিক্ষককে যাবজ্জীবন কারাদ-ের পাশাপাশি ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেন।

গত বছর ভিকারুননিসার বসুন্ধরা শাখার নবম শ্রেণির দিবা শাখার এক ছাত্রীকে ওই শাখার ইংরেজি শিক্ষক আবু সুফিয়ান যৌন হয়রানি করায় বরখাস্ত হয়েছে। এ ছাড়াও সম্প্রতি আরেকটি ঘটনা ঘটে চট্টগ্রামে। নগরের চান্দগাঁওয়ের একটি কোচিং সেন্টারে শিক্ষকের ধর্ষণের ফলে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে এক ছাত্রী। বিষয়টি পরিবারের লোকজন জেনে ফেলায় লজ্জায় ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালায় মেয়েটি।

গত বছর রাজধানীর মালিবাগে মৌচাক মার্কেট এলাকায় এক ছাত্রীকে কোচিং সেন্টারে যৌন হয়রানির অভিযোগে শিক্ষক কাজী জামিল উদ্দীনকে (৪৩) গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ৯৯৯ ফোন পেয়ে সেখানে গিয়ে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।
এমন ঘটনার বিষয়ে শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা জানান, ইদানীং টাকার বিনিময়ে রাজধানী ও রাজধানীর বাইরে খ-কালীন শিক্ষক নিয়োগ বেড়েছে। যার ফলে অনেকে টাকার বিনিময়ে নামের আগে শিক্ষক পদবি সংযুক্ত করছেন। তারা আসলে প্রকৃত শিক্ষক নন। শিক্ষক পদবি লাগিয়ে কোচিং ব্যবসা করে টাকা কামানোই তাদের নেশা। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে আরও সতর্ক হতে হবে।

×