ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

কোচিং-গাইড ব্যবসায়ীরা নতুন শিক্ষাক্রমের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত

ভিডিওর মাধ্যমে ছড়ানো হয়েছে গুজব

আসিফ হাসান কাজল

প্রকাশিত: ২৩:২৯, ৫ ডিসেম্বর ২০২৩

ভিডিওর মাধ্যমে ছড়ানো হয়েছে গুজব

ব্যাঙ লাফ, টিরিং টিরিং সাইকেল চালাই- কোনোটিই নতুন শিক্ষাক্রমের ভিডিও নয়

টিরিং টিরিং সাইকেল চালাই, ব্যাঙ লাফ দিতে দিতে আবৃত্তি, জংলি সাজে উদ্ভট ভাষায় অভিনয়। সম্প্রতি নতুন শিক্ষাক্রমের অংশ হিসেবে এসব ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। নানা কুরুচিপূর্ণ ক্যাপশনে ফেসবুক, ইউটিউব ও ম্যাসেঞ্জারে শেয়ার করা হচ্ছে। এসব ভিডিও দেখে অনেকে নেতিবাচক মন্তব্যও করছেন। তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে এসব ভিডিওর কোনটিই নতুন শিক্ষাক্রমের অংশ নয়। কিছু ভিডিও অনেক আগে রেকর্ড করা।

কিছু আবার প্রতিবেশী দেশ ভারতের অসম রাজ্যের স্কুলের। যা নতুন শিক্ষাক্রমের ভিডিও বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষাবিদরা জানান, প্রচারের অভাবে গুজব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। যা থামানো প্রয়োজন। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের কোচিং-গাইড ব্যবসার বাজার হাজার হাজার কোটি টাকার। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে তাদের ব্যবসা প- হবার অবস্থায়। এসব কারণে তারা এই অপপ্রচার বিভিন্ন কৌশলে শুরু করেছেন।

টিরিং টিরিং সাইকেল চালাই ॥ সম্প্রতি ফেসবুকে সবচেয়ে আলোচিত ভিডিও ‘টিরিং টিরিং সাইকেল চালাই’। অনুসন্ধানে জানা যায়, এটি বাংলাদেশের কোনো স্কুলের ভিডিও নয়। অসমের ধুবরি জেলার একটি শিক্ষক প্রশিক্ষণের ভিডিও এটি। ধুবরি মিউনিসিপাল হাই স্কুলের শিক্ষক মুকুট শর্মা বলেন, কবিতাটি অসমের বিভিন্ন স্কুলে পড়ানো হয়। এ কবিতাটি অসমে ‘ভঙ্গিমা গীতি’ হিসেবে পরিচিত। বিভিন্ন যানবাহন সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের পরিচিত করে তুলতে এটা প্রাইমারি পর্যায়ে শেখানো হয়। অথচ এই ভিডিওকে নতুন শিক্ষাক্রমের ভিডিও বলে অপর্প্রচার করা হচ্ছে।
ব্যাঙ লাফ দিতে দিতে আবৃত্তি ॥ হঠাৎ ব্যাঙ লাফের একটি ভিডিও গত কয়েকদিন ধরে ছড়িয়ে পড়েছে। তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এটিকে নতুন শিক্ষাক্রমের অংশ হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু আসলে এটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষার ভিডিওর একটি অংশ। যা অনেক আগে রেকর্ড করা। একটি মহল এই ভিডিওকেও নতুন শিক্ষাক্রমের ভিডিও বলে অপপ্রচার করছে।
হাঁসের ডাক দিতে দিতে হাঁটা ॥ ভাইরাল ভিডিওগুলোর মধ্যে হাঁসের ডাক দিতে দিতে হাঁটার ভিডিওটি বাংলাদেশের শিক্ষক প্রশিক্ষণের। নওগাঁর বদলগাছী উপজেলায় গতবছরের অক্টোবর-নভেম্বরে এ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এটি নতুন শিক্ষাক্রমের প্রশিক্ষণ নয়।

এই ভিডিওকেও নতুন শিক্ষাক্রমের প্রশিক্ষণের ভিডিও হিসেবে একটি শ্রেণি ফেসবুক-ইউটিউবে ছড়িয়ে দিয়েছে। জানতে চাইলে বদলগাছী উপজেলা রিসোর্স সেন্টারের ইনস্ট্রাক্টর মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘এটা গণিত অলিম্পিয়াড প্রশিক্ষণের একটি অংশ। এ প্রশিক্ষণ আমি পাইনি বা  দেইওনি। শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ দেন। প্রশিক্ষণের যে ম্যানুয়াল, সেখানে এ অংশটুকু আছে।
জংলি সাজে উদ্ভট ভাষায় অভিনয় ॥ শরীর-মাথায় দেবদারু পাতা জড়ানো। হাতে কাঠের লাঠি। হাফ-প্যান্ট পরে জংলি সাজে নৃত্য করছেন কয়েকজন ব্যক্তি। তারা ঠিক কী ভাষায় কথা বলছেন, তাও বোঝা দায়। ভাইরাল একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে এমন দৃশ্য। এটিকেও নতুন শিক্ষাক্রমের প্রশিক্ষণ বলে চালিয়ে দিচ্ছেন অনেকে। তবে এটিও বাংলাদেশের শিক্ষক প্রশিক্ষণের কোনো ভিডিও নয় বলে জানিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। নতুন শিক্ষাক্রমেও এমন কোনো পাঠ্য নেই। ভিডিওটি প্রতিবেশী দেশ ভারতের অসম রাজ্যের।
শিক্ষক-ছাত্রীদের নাচ ॥ ‘মধু মালতি ডাকে আয়’ গানের সঙ্গে একজন সহকারী শিক্ষক ও কয়েকজন ছাত্রীর নৃত্যের ভিডিও নতুন শিক্ষাক্রমে শেখানো হচ্ছে বলে ভাইরাল হয়েছে। রাজধানীর একটি স্কুল ও কলেজের ভিডিও এটি। গত আগস্টে ভিডিওটা ধারণ করা হয়। স্কুলের একটি অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা পারফর্ম করবে এজন্যই নৃত্য অনুশীলন করানো হচ্ছিল। সেখানে কয়েকজন শিক্ষিকাও ছিলেন। এটি নিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) কর্মকর্তারাও খোঁজখবরও নিয়েছেন। এটিও নতুন শিক্ষাক্রমের অংশ নয়।
শুধু এসব ভিডিও নয়। অনেকে আবার নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের ঘরের কাজ শেখানো ও রান্নাবান্নার বিষয়কে বিদ্রুপ করছেন। অভিভাবকের ধারণা ঘর গোছানো কেন তার সন্তানকে শিখতে হবে? কেন রান্নাবান্না করতে হবে? এ প্রসঙ্গে এনসিটিবি সদস্য অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, ২০৪১ সালে বাংলাদেশ এই জায়গায় থাকবে না। তখন উন্নত দেশ হবে। সে সময় এখনকার মতো কাজের লোকও পাওয়া যাবে না। নিজের কাজ নিজেকেই করতে হবে। লাইফ স্কিলের অংশ হিসেবে এসব শেখানো হচ্ছে।
কেন এসব ভিডিও ছড়ানো হচ্ছে ॥ দেশে কোচিং-নোটগাইডের ব্যবসার বাজার কয়েক হাজার কোটি টাকা। বছরে নোট গাইড ব্যবসার বাজার তিন হাজার কোটি টাকার। কোচিং ব্যবসা হয় আরও বেশি। চালু হওয়া নতুন শিক্ষাক্রমের কারণে শিক্ষার্থীরা আর নোট গাইড নির্ভর হবে না। বন্ধ হবে বিষয়ভিত্তিক কোচিং। এতে মুখ থুবড়ে পড়বে কোচিং নোটগাইড ব্যবসা। এ কারণেই কখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আবার বিভিন্নভাবে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ভুল বুঝিয়ে এই শিক্ষাক্রমের বিরুদ্ধে অসন্তোষ তৈরি করতে চায়।
এ প্রসঙ্গে, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, সৃজনশীল শিক্ষাক্রমের সময় এসব ব্যবসায়ীরা নোট গাইড বাজারে ছেড়েছিল। তখন সেটা সফল হয়েছিল। এবার নতুন শিক্ষাক্রমের বিষয়ে বাজারে নোট-গাইড নিয়ে আসা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা কিনেছেও। কিন্তু ষান্মাষিক পরীক্ষার পর দেখা গেল এই গাইড আর কোনো কাজে আসেনি।

শিক্ষার্থীরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এতে তাদের কপালে চিন্তার ভাজ পড়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমের বিপক্ষে মানববন্ধন, বিভিন্নভাবে অভিভাবকদের জড়ো করার মতো নানা প্রকল্প নিয়েছে তারা। কিন্তু সব প্রকল্প অসফল হয়েছে। শেষমেষ অসফল হয়ে এখন মিথ্যাচার ছড়ানো শুরু করেছে। এসব ভিডিওগুলো তারই অংশ। যারা এমন মিথ্যাচার করছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কী না এ প্রশ্নে তিনি আরও বলেন, আমার এই কাজগুলো যারা করছেন তাদেরকে শনাক্ত করেছি। অবশ্যই আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
অনেক শিক্ষাবিদের মতে, অনেক ইউটিউবার আছেন যারা ট্রেন্ডিং বিষয়ে খোঁজখবর রাখেন। বর্তমানে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে কোনো ভিডিও ছাড়া হলে তা দর্শক বেশি দেখেন। সে কারণে অনেকে গুজব ছড়িয়ে দিতে, বুঝে বা না বুঝে ভিডিও ভাইরাল করতে শিক্ষাক্রম নিয়ে ভিডিও করছেন।
প্রচার প্রয়োজন বলছেন শিক্ষাবিদরা ॥ আগামীর বাংলাদেশের জন্য এই শিক্ষাক্রমের গুরুত্ব অনেক বেশি বলে মনে করেন মাউশির সাবেক মহাপরিচালক ও পিএসসির সদস্য অধ্যাপক সৈয়দ গোলাম ফারুক। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, আগামীর উন্নত বাংলাদেশের জন্য এই কারিকুলামের বিকল্প নেই। এই কারিকুলামের কোনো ভুল-ত্রুটি থাকতেই পারে। সেটি বিবেচনায় নিয়ে সংশোধন করা উচিত।

তিনি বলেন, নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে শিক্ষার্থী-অভিভাবক ও শিক্ষকদের মধ্যে একটি মাইন্ড সেটের পরিবর্তন হতে হবে। অনেকে এটিকে মেনে নিতে চাইছেন না। আবার স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী অভিভাবকদের ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। এই কারিকুলামের বিষয়ে আগে থেকেই প্রচুর প্রচারণার প্রয়োজন ছিল, যেটা করা হয়নি। আবার যাদের কথা বলা উচিত তারাও মুখ বন্ধ করে আছেন। বিষয়টি খুব স্পর্শকাতর। তিনি সবাইকে এ বিষয়ে কথা বলার আহ্বান জানান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এম তারিক আহসান জনকণ্ঠকে বলেন, নতুন শিক্ষাক্রম জাতির ভবিষ্যৎ গঠনের রূপরেখা। অথচ এটিকে নিয়ে মিথ্যাচার, গুজব চলছেই। আমরা এখনো বলছি এটি পরীক্ষামূলক সংস্করণ। কেউ যদি মনে করে এই শিক্ষাক্রমের কোনো ত্রুটি রয়েছে, তা সাদরে গ্রহণ করবে এনসিটিবি। কিন্তু আমরা দেখছি এই ধরনের প্রপাগা-া ছড়িয়ে অভিভাবকদের মধ্যে অনাস্থা তৈরির অপচেষ্টা চলছে। তা হতাশার। নতুন শিক্ষাক্রমের বিষয়ে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, গণমাধ্যম ও শিক্ষাবিদদের দায়িত্ব রয়েছে।

×