ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

সাক্ষাৎকারে বেবিচক চেয়ারম্যান মফিদুর রহমান

দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেবে থার্ড টার্মিনাল

আজাদ সুলায়মান

প্রকাশিত: ০০:৪৭, ২ অক্টোবর ২০২৩

দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেবে  থার্ড টার্মিনাল

মফিদুর রহমান

স্বপ্নের থার্ড টার্মিনাল হবে সত্যিকার অর্থেই বিশ্বমানের। এটি হবে এমন একটি এয়ারপোর্ট-যেখানে কোনো বিদেশী নেমেই গোটা বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা  ইতিবাচক ধারণা পাবেন। প্রথম দেখাতেই এদেশের মানুষের সংস্কৃতি জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্য ধারণা পাবেন যাত্রীরা। যেটাকে বলা চলেফার্স্ট ইমপ্রেশান ইজ দ্য লাস্ট ইমপ্রেশান।একজন বিদেশী এখানে নামার পরই যখন দেখবেন, দুরন্ত গতির এস্কেলেটর, ডানে বামে আগে পিছে যাবার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সংকেত, কিংবা বোর্ডিং ব্রিজে দাঁড়িয়েই গোটা বিমানবন্দরের আউটলুক চোখে পড়বে-তখন তিনি গোটা দেশ  সম্পর্কে একটা ধারণা পেয়ে যাবেন। বর্তমান শাহজালাল বিমাবন্দরের মতো এমন ঘিঞ্জি মার্কা পরিবেশ দেখে যে বদনামের কথা শুনতে হয়, সেটা মুছে যাবে। বিমানবন্দর নিয়ে বর্তমানে  বিদেশীদের যে ধারণা তা পাল্টে যাবে থার্ড টার্মিনালে নামার পর।

বহুল প্রতীক্ষিত থার্ড টার্মিনাল উদ্বোধনের আগে এমনই তথ্য প্রকাশ করেছেন বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান। রবিবার দুপুরে নিজ কার্যালয়ে দৈনিক জনকণ্ঠকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি তথ্য প্রকাশ করেন। সময় তিনি করোনা মহামারির সময়েও কীভাবে এমন একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দ্রুতগতিতে সুনির্দিষ্ট সময়ে কাজ এগিয়ে নিয়ে গেছেন, টার্মিনাল চালু হলে গোটা দক্ষিণ এশিয়ার এভিয়েশনে কতটুকু ভূমিকা রাখবে, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের হাব তৈরি বাস্তবতার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে কতটুকু গতিশীল ভূমিকা রাখবে টার্মিনাল সে বিষয়ে বিস্তারিত ধারণা দিয়েছেন।

বিশেষ করে করোনা মহামারির মাঝেও দিবারাত্রি সার্বক্ষণিক কীভাবে বিশাল কর্মযজ্ঞ চালু রাখা হয়েছে সে বিষয়ে মফিদুর রহমান বলেন, এটা ছিল খুবই চ্যালেঞ্জিং। করোনা না থাকলেও আরও আগেই এই কাজ অনেক এগিয়ে যেত। তারপরেও সময়ের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অনেক প্রতিকূলতা মোকাবিলা করেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সার্বক্ষণিক দিক-নির্দেশনায় অনুপ্রেরণায় আজ পর্যায়ে আসা সম্ভব হয়েছে। আগামী অক্টোবর বর্তমান সরকারের উন্নয়নের আরেকটি মাইলফলক উন্মোচিত হতে যাচ্ছে থার্ড টার্মিনাল উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে। 

কীভাবে থার্ড টার্মিনাল দেশী-বিদেশীদের কাছে ব্যতিক্রম মনে হবে প্রশ্নের জবাবে এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান বলেন, সেভাবেই নির্মাণ করা হয়েছে বিমানবন্দর। প্রথমেই যদি টার্মিনালের ড্রয়িং ডিজাইন দেখেন, তারপর ভেতরের ইন্টিরিয়র দেখেন, বিশালাকৃতির এস্কেলেটর, বোর্র্ডিং ব্রিজ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তথ্য বিশেষ সেবা পেলে যে কারোর অনুভূতি বদলে যাবে। এখন বর্তমান টার্মিনালে নামার পর যাত্রীদের অনুভূতি কেমন হয়তাদের মনে একটা চিত্র ফুটে ওঠে ঢাকা এয়ারপোর্ট মানেই এখানে বিশালাকৃতির লাইন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা, (যদিও এখন আগের চেয়ে অনেকটাই উন্নতি হয়েছে) ট্রলি নিয়ে ঠেলাঠেলি, গাদাগাদি, যাত্রীসাধারণের ভিড় আর ব্যবস্থাপনার ঘাটতি। শুনতে খারাপ লাগলেও বাস্তবতা এটাই। থার্ড টার্মিনাল যাত্রীদের এই অনুভূতিটাই বদলে দেবে। কারণ এখানে থাকছে সুন্দর বোর্ডিং ব্রিজ, দ্রুততম সময়ে ইমিগ্রেশনে যাতায়াতের এস্কেলেটর, আর ষড়ঋতুর ছয়টি রঙের সমাহার।

রয়েছে অত্যাধুনিক -গেট। বিশেষ ডিজাইনের ১৬টি বেল্টে আসার আগেই লাগেজ চলে আসবে। যাত্রী না থাকলেও লাগেজগুলো একটা সুনির্দিষ্ট সময়ে বেল্ট থেকে পাশের ওয়েটিং জোনে চলে যাবে। সেখান থেকে যাত্রী সেটা সংগ্রহ করে নেবেন অত্যাধুনিক ট্রলিতে। থাকছে ইমিগ্রেশনে সুবিন্যস্ত সারির বেষ্টনী- যা ভেদ করে আগের যাত্রীকে টপকে পিছনের যাত্রী সামনে যেতে পারবে না। দেওয়ালে দেওয়ালে থাকছে দেশের ষড়্ঋতুর ছয়টি রঙের নয়নাভিরাম দৃশ্য। বিমানবন্দর থেকে বের হয়েই চোখে পড়বে বিশালাকৃতির জাতীয় ফুল শাপলা। জলে ভাসা পদ্মে ঢেউয়ের অপরূপ দৃশ্য। এমন চিত্র দেখলেই গোটা দেশ সম্পর্কে মনে একটা ইতিবাচক ধারণা জন্মাবে। এই গেল দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর চিত্র।

গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং নিয়ে গোটা জাতির কৌতূহলী প্রশ্ন কারা পাচ্ছে- কারা আসছে। বিষয়ে সর্বশেষ অগ্রগতি বা সিদ্ধান্ত কি এমন প্রশ্ন করা হলে এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান বলেন, এটাই গোটা বিশ্বজুড়ে বিমানবন্দরগুলোর মূল চ্যালেঞ্জ। আমাদের বর্তমান এয়ারপোর্টের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং নিয়ে কম কথা শুনতে হচ্ছে না। সেটা মাথায় রেখেই সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে দায়িত্বটা জাপানই পালন করুক। কারণ গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে জাপানের বিশেষ দক্ষতা, সুনাম ভাবমূর্তি রয়েছে। এখন জাপান তার দায়িত্ব আরও যতœ দক্ষতার সঙ্গে করতে গেলে কার সহযোগিতা নেওয়া দরকার, বিমানকে নেবে না কি আরও বড় কোনো বিদেশী হ্যান্ডলারকে নেবে এটা একান্তই তাদের ব্যাপার। তবে হ্যাঁ আমাদেরও নৈতিক দায়িত্ব চেতনাবোধ থেকে দেখলে চাইব জাপানের সঙ্গে বিমানও সহযোগী হয় সেটা আমাদের জন্যই ভালো। আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে এই নিশ্চয়তা দিতে পারি থার্ড টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং হবে বিশ্বের অন্যান্য বড় বড় এয়ারপোর্টের মতোই নির্ভরযোগ্য নিরাপদ। এমনটি হবার সম্ভাবনা নেই, প্লেন এসে দাঁড়িয়ে রইল, টু ট্রাক্টর নেই, চাবি নিয়ে চলে গেছে অমুক, বেল্ট চালু হচ্ছে না সঠিক সময়ে। থার্ড টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং দেখলে আর কারোর কোনো অভিযোগ করার সুযোগ থাকবে না। বরং বলতে গেলে পৃথিবীতে আমাদের এই বিমানবন্দরই সেরা।

এই বিমানবন্দরের ভেতরে যাত্রীদের জন্য আর কি কি থাকছে, জানতে চাইলে বেবিচক চেয়ারম্যান বলেন, সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দরে একজন যাত্রী যখন ফ্লাইট মিস করেন, কিংবা / ঘণ্টার ট্রানজিটে থাকেন, তখন তিনি ইচ্ছে করলে এয়ারপোর্টেই কাটিয়ে দিতে পারেন। সেজন্য রয়েছে বিশ্রামাগার, সাময়িক বিনোদন, স্পা, লাউঞ্জ, বার, রেস্টুরেন্ট অন্যান্য বিনোদন সামগ্রী। থার্ড টার্মিনালেও থাকছে এসবই। ইচ্ছে করলে একজন যাত্রী এয়ারপোর্টে ওই সময় কাটিয়ে দিতে পারবেন। তেমন সুবিধাদি রয়েছে এখানে। এখানে থাকবে পৃথিবীর সেরা সব ব্র্যান্ডের  আউটলেট, লাউঞ্জ বিশ্রামাগার। আবার তিনি চাইলে পাশের উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা তারকা হোটেলেও চলে যেতে পারবেন কয়েক মিনিটে। সেভাবেই সাজানো হয়েছে। এত বিশাল এয়ারপোর্টে এসে একজন যাত্রীর কয়েক ঘণ্টার সময় কাটানো বা বিনোদনের জন্য যা যা দরকার তার সবই থাকবে।

এখানে কারা কীভাবে লাউঞ্জ দোকানপাট পাবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা অনেক দামি প্রশ্ন করেছেন। প্রায়ই তদ্বির আসে, কেউ লাউঞ্জ চায়, কেউ দোকান চায়। তদ্বিরও রয়েছে অনেক। কিন্তু না তারা সবাই হতাশ হবেন এই জেনে যে, এটাকে বর্তমান টার্মিনাল -এর মতো বঙ্গবাজার বানাতে দেব না। আমি দৃৃঢ়কণ্ঠে নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি কেউ যদি এমন স্বপ্ন  দেখেন, কিংবা আশা করেন, অমুকের তদ্বির নিয়ে গেলাম আর একটা দোকান পেয়ে গেলাম, তাহলে সরি। তা হবে না। এখানে কোন লাউঞ্জ কোথায় রাখা হবে, কতটুকু জায়গায় থাকবে, কোন ব্র্যান্ড কোথায় আউটলেট পাবে তা ঠিক করার জন্য একটা নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। জাপানি কোম্পানি নিপ্পন কই  পরামর্শক হিসেবে কাজ করছে। তাদের দেওয়া প্রতিবেদনেই থাকবে গোটা বিমানবন্দরে লাউঞ্জ, ডিউটি ফ্রি শপ, রেস্টুরেন্ট অন্যান্য আউটলেটের অবস্থান। তারাই সব ঠিক করে দেবে।

থার্ড টার্মিনালকে কেন্দ্র করে আরেকটি কথা বেশ জোরেশোরেই উচ্চারিত হচ্ছে হাব নিয়ে। সে সম্ভাবনা কতটুকু প্রশ্ন করা হলে মফিদুর রহমান বলেন, আমরাও বলতে চাই বাংলাদেশের এভিয়েশন একদিন হাবে পরিণত হবে এমন স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজ তাঁরই কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও  এদেশে হাব গঠনের পরিকল্পনা নিয়েই একের পর এক পদক্ষেপ হাতে নিয়েছেন। তারই ধারাবাহিকতায় আজ থার্ড টার্মিনালের মতো মেগা প্রকল্প এখন শেষ হবার পথে। আগামী অক্টোবর শুভ উদ্বোধনের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আসছে। এদেশের এভিয়েশন এখন এমন এক জায়গায় যাচ্ছে যা হাব গঠনের সম্ভাবনাকেই উজ্জ্বল করেছে। তার বড় কারণ আমাদের ভৌগোলিক অবস্থান। ঢাকায় এখন বর্তমান টার্মিনালে দৈনিক সর্বোচ্চ দেড়েক ফ্লাইটের হ্যান্ডলিং হচ্ছে।

এখানেই যদি আরেকটু ক্যাপাসিটি বাড়ানো যেত তাহলে বর্তমান রানওয়েকেই আরও কমপক্ষে ৩০ ভাগ বেশি ইউটিলাইজ করা যেত। হাব করার সবচেয়ে বড় সুযোগ হচ্ছে আমাদের ভৌগোলিক অবস্থান। বাংলাদেশ থেকে মাত্র দুই ঘণ্টায় গোটা দক্ষিণ এশিয়া প্রদক্ষিণ করা, চার ঘণ্টায় এশিয়া প্যাসিফিক দেশগুলোতে যাওয়া যায়, ছয় ঘণ্টায় মধ্যপ্রাচ্যসহ আফ্রিকায় যাওয়া যায়, আট ঘণ্টায় ইউরোপ পৌঁছা যায়। আপানারা জানেন গোটা ইউরোপের হাব পয়েন্ট হিসেবে ধরা হয় সুইজারল্যান্ডকে। তেমনই বাংলাদেশও হাবের উপযোগী। এমন একটি উপযোগী অবস্থানে থাকলে পৃথিবীর যে কোনো দেশ থেকেই এদেশে ট্রানজিট নিয়ে তার গন্তব্যে যেতে পারে। সে সুযোগ থেকেই বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন হাব করার। আজ তাঁরই কন্যা সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য ঢাকায় থার্ড টার্মিনাল, কক্সবাজারের সমুদ্রগর্ভে রানওয়েসহ অত্যাধুনিক এয়ারপোর্ট, সিলেটেও আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট নির্মাণ করছেন। আমার বিশ্বাস কক্সবাজারে থার্ড টার্মিনালের চেয়েও আরও অত্যাধুনিক মানের এয়ারপোর্ট করার সুযোগ আমাদের রয়েছে। 

হাব গঠন করতে হলে বিদেশী এয়ারলাইন্সগুলোর ফ্রিকোয়েন্সি আরও বাড়াতে হবে, ওপেন স্কাইয়ের সুযোগ দিতে হবে। সেটা কিভাবে করবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রথম ধাক্কাতেই সব করা কি সম্ভব হবে? ধাপে ধাপে সুযোগ বাড়াতে হবে, ক্যাপাসিটি বাড়াতে হবে, কার্গো টার্মিনালকে পুরোপুরি চালু করতে হবে, দেশী-বিদেশী এয়ারলাইন্সগুলোকে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে এগিয়ে আসতে হবে, তবেই সেটা বাস্তবায়নের দিকে যাবে। আমাদের সেটা মাথায় রেখেই অগ্রসর হতে হচ্ছে। তবে আপনারা আরও চমক পাবেন আগামী অক্টোবর উদ্বোধনী দিনে।

×