
বিশ্ব নদী দিবস উপলক্ষে বগুড়ায় করতোয়া নদীতে কাগজের নৌকা ভাসানো কর্মসূচি পালন করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)
দখল, দূষণ ও বালু তোলায় ঢাকার ১৮ নদী হুমকির মুখে। নদী দূষণ ও দখলের সংস্কৃতি থেকে মানুষকে কোনোভাবেই নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা রাজধানী ঢাকার চারপাশের বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর। ২০০৯ সালে এই চারটি নদীকে দখল ও দূষণমুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। কিছুটা দখলমুক্ত হলেও দূষণমুক্ত করা যায়নি। পানির দুর্গন্ধে শীতকালে নদীর কাছে যাওয়া যায় না। অথচ নদীগুলো দূষণমুক্ত করার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। গত ১৪ বছরের নদীগুলো দূষণমুক্ত করা যায়নি বলে জানিয়েছেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী।
নদী রক্ষায় যারা কাজ করেন তাদের তিরস্কৃত হতে হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, সারাদেশের নদীগুলো রক্ষার জন্য যেসব কর্মকর্তা কাজ করেন তাদের তিরস্কৃত হতে হয় বেশি। সারাদেশের নদ-নদীর ওপর আক্রমণ করা হচ্ছে। যারা নদী নিয়ে কাজ করতে চান, তাদের ইলিশ গবেষণা থেকে বদলি করে চিংড়ি গবেষণায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। দখল, দূষণ ও বালু তোলায় দেশের নদীগুলো আজ হুমকির মুখে। ‘বিশ^ নদী দিবস’ উপলক্ষে রবিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘বাংলাদেশের নদ-নদীর সংজ্ঞা ও সংখ্যা’ শীর্ষক সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন। সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মার্গুব মোর্শেদ। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক উপ-পরিচালক মো. আখতারুজ্জামান তালুকদার।
মূল প্রবন্ধে মো. আখতারুজ্জামান তালুকদার বলেন, দেশে বর্তমানে নদী আছে এক হাজার আটটি, নদীপথ ২২ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ। ৩০০ কিমির ওপরে আছে দুইটা নদী। পদ্মা ও ইছামতী। ইছামতী নদীই আছে ১১টি। বিভিন্ন জায়গায় এই নামে পরিচিত। ২৮০ কিমির ওপরে আছে পাঁচটি নদী। ২০০-২৭৯ কিমি দৈর্ঘ্যরে আছে নয়টি নদী আছে। ১০০-১৯৯ কিমির মধ্যে আছে ৪২টি নদী। পাঁচটি নদী আছে ১০০ কিমির মধ্যে। দশ থেকে ৯৯ কিমি দৈর্ঘ্যরে আছে ৪৮০টি নদী। এক থেকে ৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে আছে ৩৭৬টি নদী। এক কিমির কম ৪১টি। আর দৈর্ঘ্য সম্পর্কে তথ্য নেই ৫৫টির। সারাদেশে জেলা, উপজেলা, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেশের নদীর সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
নদ-নদীর সংজ্ঞা হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘নদ বা নদী’ বলতে পাহাড়, পর্বত, হিমবাহ, হ্রদ, ঝরনা, ছড়া, অন্য কোনো জলাশয় বা অন্য কোনো জলধারা হতে প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন হয়ে যে জলধারা সারাবছর বা বছরের কোনো কোনো সময় দুই তীরের মধ্য দিয়ে প্রাকৃতিকভাবে প্রবাহিত হয়ে সমুদ্র, মহাসমুদ্র, হ্রদ, অন্য কোনো জলাশয় বা অন্য কোনো জলধারায় পতিত হয় তাকে বোঝায়; তবে শর্ত থাকে যে, উপর্যুক্ত সংজ্ঞায় যাই থাকুক না কেন ক্যাডেস্ট্রাল সার্ভে, রিভিশনাল সার্ভে ও বাংলাদেশ রিভিশনাল সার্ভে রেকর্ডে নদ বা নদী হিসাবে যা উল্লেখকৃত হয়েছে তা নদ বা নদী হিসাবে গণ্য হবে।’ দেশের দীর্ঘতম পদ্মা নদীর দৈর্ঘ্য ৩৪১ কিমি বলে জানান তিনি।
নদী দিবস পালন ॥ রবিবার বিশ্ব নদী দিবস উপলক্ষে নানা কর্মসূচি পালন করেছে বিভিন্ন সংগঠন। স্থানীয় বিভিন্ন সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে ‘ওয়াটার কিপার্স বাংলাদেশ’ ঢাকাসহ ১২টি স্থানে একযোগে বিশ্ব নদী দিবসের বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। কক্সবাজারে সদর, পেকুয়া, তালতলী, মহেশখালী, মোংলা, কুতুবদিয়া, কলাপাড়া, পাথরঘাটা, বরগুনা সদর, পাইকগাছা ও বরিশাল সদরে মানববন্ধন, স্মারকলিপি প্রদান, সাংস্কৃতিক পরিবেশনা ও র্যালিসহ বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়।
ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে ‘নদী একটি জীবন্ত সত্তা’ শীর্ষক সেমিনারের আয়োজন করা হয়। সেমিনারে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দ রেজওয়ানা হাসান; নোঙর ট্রাস্ট বাংলাদেশ’র চেয়ারম্যান সুমন শামস; রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ; নিরাপদ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ইবনুল সাঈদ রানা প্রমুখ।
সেমিনারে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশে নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা করে আইন পাস হলেও নদী দূষণ ও দখলের সংস্কৃতি থেকে মানুষকে নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না। সারাদেশে বহু নদ-নদী বর্তমানে বিলুপ্ত ও বাকি নদীগুলোও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। নদী রক্ষায় নিয়োজিত খোদ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যথেষ্ট দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। তাই নদীকে একটি জীবন্ত সত্তা হিসেবে এর অধিকার নিশ্চিত করার আহ্বান জানান বক্তারা।
অনুষ্ঠানের অতিথিদের মধ্যে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, নতুন প্রজন্মকে নদী সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। তারা যাতে নদীকে ভালোবাসে। আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে নদীকে রক্ষা করতে হবে। নদী রক্ষা না করলে যতই উন্নয়ন করি, তা টেকসই হবে না।
জানা যায়, নদী দখল দূষণের ব্যাপারে অবগতকরণ ও নদী সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সেপ্টেম্বরের চতুর্থ রবিবার বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব নদী দিবস। কানাডার নদীরক্ষা আন্দোলনকর্মী মার্ক অ্যাঞ্জেলোর মাধ্যমে এই দিবসটির ধারণা আসে এবং ২০০৫ সালে জাতিসংঘের দাপ্তরিক স্বীকৃতির মাধ্যমে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব নদী দিবস।