
বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর
জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে হুমকির মুখে পড়া জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বিশ্বের বিজ্ঞানীগণ ওজোন স্তর সুরক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন। সূর্য থেকে আসা ক্ষতিকর অতি বেগুনি রশ্মিকে প্রতিহত করে পৃথিবীকে টিকিয়ে রেখেছে ঊর্ধ্বাকাশের ওজোন স্তর। আকাশে উদগীরিত মানব সৃষ্ট নানা রাসায়নিক যৌগ এই স্তরের পুরুত্ব ক্রমেই কমিয়ে পৃথিবীকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। পরিবর্তন হচ্ছে জলবায়ু। বাংলাদেশও এই হুমকির বাইরে নয়। ওজোন স্তর সুরক্ষায় আজ শনিবার বিশ্বজুড়ে পালন করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক ওজোন স্তর দিবস। ‘মন্ট্রিল প্রটোকল বাস্তবায়ন করি-ওজোন স্তর রক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করি’ প্রতিপাদ্যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আজ বাংলাদেশেও পালিত হতে যাচ্ছে দিবসটি। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন।
বিজ্ঞানীগণ গত প্রায় তিন যুগ ধরে লক্ষ্য করেছেন বায়ুমন্ডলে মানুষের সৃষ্ট যৌগ ও যুক্তযৌগগুলোর কারণে বিশেষ করে হাই ফ্লুরো কার্বন (এইচএফসি), ক্লোরোফ্লুুরো কার্বন (সিএফসি) এবং কার্বনের নানা যৌগের কারণে ওজোন স্তর ক্ষয়ে যাচ্ছে। ১৯৭০ সালের পর ওজোন স্তর চার শতাংশ ধ্বংস হয়েছে। সূর্য যে হারে আল্ট্রাভায়েলেট রে (অতি বেগুনি রশ্মি) প্রতিহত করতে পারত, তা পারছে না। যে কারণে কখনো সূর্যের প্রচন্ড তাপ অসহনীয় হয়ে সরসারি প্রভাব ফেলেছে জলবায়ুর প্রভাবে, বিশ্বে কোনো ঋতু ঠিক থাকছে না। জাতিসংঘের এক অধিবেশনে বায়ুমন্ডলের ওজোন স্তর ক্ষয়ের জন্য দায়ী দ্রব্যগুলো ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা এবং সীমিত করার লক্ষ্যে ভিয়েনা কনভেনশন অনুসরণ করতে বলা হয়। এর আগে ওজোন স্তর ধ্বংসকারী পদার্থের ওপর মন্ট্রিল প্রটোকল গৃহীত হয়। ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রতি বছর ১৬ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক ওজোন স্তর সুরক্ষা দিবস পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়।
বায়ুমন্ডলের কয়েকটি স্তরের মধ্যে একটি হলো ওজোন। বৈজ্ঞানিক নাম ওথ্রি (O3)। এই গ্যাস বা স্তর প্রধানত স্ট্রেসটোফেয়ারের নিচের অংশ, যা ভূপৃষ্ঠ থেকে ২০-৩০ কিলোমিটার ওপরে থাকে। স্তরের পুরুত্ব স্থান ও মৌসুম ভেদে কম-বেশি হয়। ওজোন স্তরের ঘনত্ব মাপা হয় বিজ্ঞানী ডবসন আবিস্কৃত স্পেকট্রোফটো মিটারের মাধ্যমে। বিজ্ঞানীর নামে পুরুত্ব মাপককে বলা হয় ডবসন ইউনিট (ডিইউ)। নিরক্ষীয় অঞ্চল, নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল, উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরুর ডিইউ একেক রকম।
নানা কারণে ওজোন স্তরের পুরুত্ব কমছে। অগ্নুৎপাত, বজ্রপাত তো আছেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আকাশে নানা যৌগ, যা মানব সৃষ্ট। এক সূত্র জানায়, গত দুই যুগে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও কার্বন যৌগগুলোর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ক্ষতি করেছে মিথেন গ্যাস। মিথেনের অস্তিত্ব নিয়ে গবেষণা চলছে। মিথেনের সঙ্গে ফসফিন এবং ডাই-ফসফিন গ্যাস মিশ্রিত থাকে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি সংস্থার খবর, মিথেন নিঃসরণকারী দেশের তালিকার শীর্ষে আছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। দুটি উপগ্রহের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে, মিথেন নিঃসরণের জন্য বেশি দায়ী নানা ধরনের বর্জ্য, প্রাকৃতিক গ্যাসের পাইপলাইনে ফাটল, কয়লা পোড়ানোর ধোঁয়া ইত্যাদি। যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল কার্বন প্রজেক্টের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, আকাশে যে হারে কার্বন নিঃসরিত হচ্ছে, তা কমিয়ে না আনলে আগামী পৃথিবী বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। বিশে^র বিজ্ঞানীগণ ওজোন স্তর, গ্রিনহাউস ইফেক্ট নিয়ে চিন্তিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নাসা) তাদের আকাশ যান (স্পেস শাটল) পরীক্ষায় ওজোন স্তরের বিষয়টি পরিমাপে এনেছেন। নাসা জানিয়েছে, বিশ্বের প্রতিটি দেশকে ওজোন স্তর সুরক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে।
এদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আকাশে সূর্যের চারধারে বিশেষ এক বলয় সৃষ্টি হচ্ছে, যা খালি চোখে দেখা সম্ভব নয়। তবে বিশেষ ক্যামেরায় এবং নেগেটিভ বস্তুতে যা দৃশ্যমান হয়, তা লাল একটি রিং। বিজ্ঞানীরা এই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করছেন। তারা ঊর্ধ্বাকাশে এই চিত্রকে ওজোন স্তরের পুরুত্ব কমে যাওয়ার কোনো চিহ্ন কি না- তা খতিয়ে দেখছেন।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বাণী ॥ প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় প্রতিবছর ১৬ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী পালিত হয় আন্তর্জাতিক ওজোন স্তর সুরক্ষা দিবস বা বিশ্ব ওজোন দিবস। ‘মন্ট্রিল প্রটোকল বাস্তবায়ন করি-ওজোন স্তর রক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করি’ প্রতিপাদ্যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আজ বাংলাদেশেও পালিত হতে যাচ্ছে দিবসটি। ওজোন স্তরের ক্ষয় ও এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী গণসচেতনতা তৈরিতেই প্রতি বছর দিবসটি পালন করা হয়।
দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেন, সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি থেকে জীববৈচিত্র্যকে সুরক্ষা দিতে বায়ুমন্ডলের ওজোন স্তরে ভূমিকা অনস্বীকার্য। শীতলীকরণ শিল্পে ব্যবহৃত ক্লোরোফ্লোরো কার্বন (সিএফসি) গ্যাসসহ মানবসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক বিভিন্ন কারণে ওজোন স্তর আজ হুমকির সম্মুখীন। ওজোন স্তরের ক্ষয়রোধে ১৯৮৫ ও ১৯৮৭ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক ভিয়েনা কনভেনশন ও মন্ট্রিল প্রটোকল গ্রহণ করা হয়। মন্ট্রিল প্রটোকল বাস্তবায়নের মাধ্যমে গত ৩৬ বছরে বিশ্বব্যাপী ওজোন স্তর ক্ষয়কারী দ্রব্যের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ক্ষেত্রেও মন্ট্রিল প্রটোকলের কিগালি সংশোধনী উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যেতে মন্ট্রিল প্রটোকলসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরি। এ প্রেক্ষিতে বিশ্ব ওজোন দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বিশ্ব ওজোন দিবস উদযাপন উপলক্ষে গৃহীত সব কর্মসূচির সাফল্য কামনা করছি।
পৃথক আরেক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বায়ুমন্ডলের ওজোন স্তর সূর্য থেকে নিঃসরিত ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি আটকে দিয়ে মানুষ প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে সুরক্ষা দেয়। তবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র, অ্যারোসল, ফোম তৈরিসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে ব্যবহৃত ক্লোরোফ্লোরোকার্বনসহ দ্রব্যসমূহের কারণের প্রতিনিয়ত এ অতি গুরুত্বপূর্ণ ওজোন স্তরে ক্ষয়সাধন ঘটছে। বায়ুমন্ডরের এ অতি গুরুত্বপূর্ণ স্তর সুরক্ষার জন্য ভিয়েনা কনভেনশনের আওতায় ১৯৮৭ সাল থেকে মন্ট্রিল প্রটোকল বাস্তবায়িত হচ্ছে। ফলে বিগত ৩৬ বছরে পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ওজোন স্তর ধীরে ধীরে পুনর্গঠিত হতে শুরু করেছে। এবং আশা করা যায় ওজোন স্তর ২০৬৬ সালের মধ্যে তার পূর্বাবস্থায় ফিরে আসবে। এছাড়া মন্ট্রিল প্রটোকলের কিগলি সংশোধনী বাস্তবায়নের মাধ্যমে হাইড্রোফ্লোরোকার্বন (এইচএফসি) ব্যবহার পর্যায়ক্রমে হ্রাস এবং শক্তি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি গ্রহণের মাধ্যমে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। বাণীতে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অত্যন্ত সংবেদনশীল ছিলেন। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির পর তিনি অন্যান্য গুরুদায়িত্ব পালনের পাশাপাশি দেশব্যাপী বনায়ন ও উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী সৃষ্টিতে মনোনিবেশ করেছিলেন। আমি আশা করি এবারের বিশ্ব ওজোন দিবস পালনের মাধ্যমে মন্ট্রিল প্রটোকল বাস্তবায়নে বাংলাদেশের সাফল্য তুলে ধরার পাশাপাশি ওজোন স্তর রক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
শুক্রবার এক বিজ্ঞপ্তিতে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয় জানায়, বিশ্ব ওজোন দিবস ২০২৩ উদযাপন উপলক্ষে পরিবেশ অধিদপ্তর আজ শনিবার সকালে একটি সমাবেশ ও শোভাযাত্রার আয়োজন করেছে। শোভাযাত্রাটি শাহবাগ জাতীয় জাদুঘর প্রাঙ্গণ থেকে শুরু হয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসে শেষ হবে। সমাবেশ ও শোভাযাত্রাটি উদ্বোধন করবেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন, উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার এবং সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ। শোভাযাত্রায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ও এর নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারী, পেশাজীবী সংগঠন, ওয়ালটন, এলিটসহ বিভিন্ন বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, বাংলাদেশ স্কাউট ও গার্লস গাইডের সদস্যসহ ৫০০ জন অংশগ্রহণ করবেন।
বিশ্ব ওজোন দিবসের ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়, ১৯৮৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর ক্ষয়ের জন্য দায়ী দ্রব্যগুলোর ব্যবহার নিষিদ্ধ বা সীমিত করার জন্য ভিয়েনা কনভেনশনের আওতায় ওজোন স্তর ধ্বংসকারী পদার্থের ওপর মন্ট্রিল প্রটোকল গৃহীত হয়। এই দিনের স্মরণে ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৬ সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক ওজোন স্তর সুরক্ষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।