ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

নোয়াখালী-১

মর্যাদার প্রশ্ন আওয়ামী লীগে বিএনপি চায় পুনরুদ্ধার

​​​​​​​গিয়াসউদ্দিন ফরহাদ, নোয়াখালী

প্রকাশিত: ২২:৫৬, ২৬ মার্চ ২০২৩

মর্যাদার প্রশ্ন আওয়ামী লীগে বিএনপি চায় পুনরুদ্ধার

.

নোয়াখালী জেলার প্রাচীন নাম ছিল ভুলুয়া। নোয়াখালী সদর থানার আদি নাম সুধারাম। ইতিহাসবিদদের মতে, একবার ত্রিপুরার পাহাড় থেকে প্রবাহিত ডাকাতিয়া নদীর পানিতে ভুলুয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চল ভয়াবহভাবে প্লাবিত হয় ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে ১৬৬০ সালে একটি বিশাল খাল খনন করা হয়, তাতে পানির প্রবাহকে ডাকাতিয়া নদী হতে রামগঞ্জ, সোনাইমুড়ি চৌমুহনী হয়ে মেঘনা এবং ফেনীর নদীর দিকে প্রবাহিত হয়। এই বিশাল নতুন খালকে নোয়াখালীর আঞ্চলিকনোয়া (নতুন) খাল বলা হতো, এর ফলে অঞ্চলটি একসময়ে লোকের মুখে মুখে পরিবর্তিত হয়ে নোয়াখালী হিসেবে পরিচিত লাভ করতে শুরু করে।

দেশের এই ঐতিহ্যবাহী জেলাটি রাজনৈতিকভাবে বরাবরই সচেতন। স্বাধীনতার পূর্ব থেকে পর্যন্ত অনেক ডাকসাইটে রাজনৈতিক নেতা জেলার বিভিন্ন আসনে বিজয়ী হয়ে দেশ পরিচালনায় অন্যতম দায়িত্ব পালন করেছেন এবং যাচ্ছেন। এর মধ্যে নোয়াখালী- (চাটখিল-সোনাইমুড়ি) নির্বাচনী আসনটিতে ভোটার সংখ্যা তিন লাখেরও বেশি।

এক সময়ে আসনটি বিএনপির ঘাঁটি বলে পরিচিত ছিল। তবে সময়ের ব্যবধানে আসনটিতে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ শক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জমে উঠেছে নোয়াখালী- আসনের নির্বাচনী রাজনীতি। বড় সব রাজনৈতিক দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা ইতোমধ্যে নানা কৌশলে নির্বাচনী তৎপরতা শুরু করেছে। আওয়ামী লীগ চাইছে গত দুটি সংসদ নির্বাচনের মতো আগামী নির্বাচনেও বিজয়ী হলে তাদের মর্যাদা ধরে রাখতে। অন্যদিকে বিএনপি চাইতে আসনটি পুনরুদ্ধার করতে। আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে যোগ্য প্রার্থী বাছাইয়ের ওপরই জয়-পরাজয় নির্ভর করবে বলে স্থানীয় রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিরা মনে করছেন।

নোয়াখালী- আসনের ১৬টি ইউনিয়ন দুটি পৌরসভা এলাকার ভোটারদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতেও চলে এসেছে মনোনয়ন প্রার্থীদের নানা কার্যক্রম। চাটখিল উপজেলার একটি পৌরসভা নয়টি ইউনিয়ন এবং সোনাইমুড়ী উপজেলার একটি পৌরসভা সাতটি ইউনিয়ন নিয়ে নোয়াখালী- আসন গঠিত। এখানে ভোটার সংখ্যা সাড়ে তিন লাখের বেশি। পুরুষ ভোটার লাখ ৭৫ হাজার। নারী ভোটার লাখ ৭২ হাজার ৬৫১।

১৯৯১ থেকে এই আসনে পাঁচবার টানা বিএনপির প্রার্থী জয় পেয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পান আওয়ামী লীগের এইচ এম ইব্রাহীম। পরে ২০১৮ সালের নির্বাচনেও নৌকা মার্কা নিয়ে বিজয়ী হয়ে সংসদ সদস্য হন তিনি। ভোটের হিসাব বলছে, বরাবরই আসনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয় আওয়ামী লীগ-বিএনপিতে। তবে নির্বাচন সামনে রেখে আসনটিতে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল-বিভেদ এখন লুকোচুরির কিছু নয়। বিএনপিতেও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে দলটির সাংগঠনিক অবস্থা অনেকটাই নাজুক। তবুও অস্তিত্বের প্রশ্নে দলটির নেতারা ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনী মাঠে কাজ করার কথা ভোটারদের জানান দিচ্ছে।

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে সরেজমিনে আসনটির বিভিন্ন এলাকা ঘুরে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের নির্বাচনী মাঠে জোর প্রস্তুতি বা তেমন তোড়জোড় চোখে পড়েনি। তবে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুই দলেরই নির্বাচনের ভালো প্রস্তুতি আছে। অতীতেবিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত চাটখিল-সোনাইমুড়ীতে দলের সাংগঠনিক অবস্থা বর্তমানে নাজুক।

এলাকার অনেকেই বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার এম মাহবুব উদ্দিন খোকন সংসদ সদস্য থাকার সময় এখানে তেমন কোনো উন্নয়ন কাজ হয়নি। বিদ্যুৎ রাস্তাঘাটের অবস্থা ছিল খুবই নাজুক। তবে সাবেক এমপি খোকন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, নির্বাচিত হয়ে তিনি এলাকায় বিভিন্ন কাজ করেছেন। বিএনপির ঘাঁটি হওয়ায় আসনের লোকজনের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতাও রয়েছে। আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু নিরপেক্ষ হলে বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি।

মনোনয়নপ্রত্যাশী বিএনপির সাবেক এমপি কেন্দ্রীয় সদস্য অ্যাডভোকেট সালাহ উদ্দিন কামরান বলেন, এমপি থাকার সময় তিনি অনেক উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন, চাটখিলকে পৌরসভায় উন্নীত করেছেন। সংগঠনে তার অবদানের কথা বিবেচনায় নিয়ে তাকেই  দল মনোনয়ন দেবে বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন তিনি।

জানা যায়, এখানে বর্তমান সংসদ সদস্য এইচ এম ইব্রাহীমের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইবেন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী জাহাঙ্গীর আলম, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট বশির আহমেদ, চাটখিল উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির, সোনাইমুড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান খন্দকার রুহুল আমিন এবং ব্যবসায়ী নিজাম উদ্দিন জিটু।

আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা সাবেক এমপি মাহমুদুর রহমান বেলায়েত সম্মিলিত সাংস্কৃতি জোটের গোলাম কুদ্দুছও আসনের। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী-সমর্থকদের একাংশ প্রার্থী হিসেবে তাদেরও চান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা, ডাকসুর সাবেক ভারপ্রাপ্ত ভিপি, সিনেট মেম্বার সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের গোলাম কুদ্দুছ বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনেও তিনি আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। কিন্তু পরে ১৪ দলীয় জোটের স্বার্থে তিনি তা প্রত্যাহার করে নেন। এবার মনোনয়ন পাওয়ার আশাবাদ পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি। দলটির স্থানীয় নেতাদের মতে, স্বচ্ছ পরিচ্ছন্ন ইমেজের নেতা প্রার্থী হলে নৌকার আবারও জয় সুনিশ্চিত হবে।

বিষয়ে আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুর রহমান বেলায়েত বলেন, ‘আমি কোনো সময় এমপি নমিনেশন চাইনি। ছাত্রাবস্থায় একবার বঙ্গবন্ধু ডেকে নিয়ে মনোনয়ন দিয়েছেন, তখন বাধ্য হয়ে আমি নির্বাচন করেছি। দ্বিতীয়বারও একই অবস্থা। আমাদের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে নির্বাচন করতে বলেছেন। আমি তখন ব্যবসায়িক কাজে লন্ডনে যাব, টিকিটও করেছিলাম। তখন নেত্রী বলেছিলেন, দেশে যাও। আমি তার কথা ফেলিনি। তৃতীয়বারও মাহবুবুর রহমান সাহেব আর আমি নির্বাচন করেছিলাম। আমরা একই বয়সের। সেই নির্বাচনে মাহবুবুর রহমান সাহেব কোটি কোটি টাকা খরচ করেন, আমি সেটা করিনি। আমি তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমি আর নির্বাচন করব না। এখনো নির্বাচন করার চিন্তা করি না। নেত্রী মনোনয়ন দিলে নির্বাচন করবেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে এই সফেদ রাজনীতিক বলেন, ‘নেত্রী যদি দেন, আর যদি দেখি দুর্নীতিবাজগুলো বাদ যায়, তখন বিবেচনা করব। এর আগে নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা বলব না।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের গোলাম কুদ্দুছও একই সুরে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘নেত্রী যদি মনে করেন আমি প্রার্থী, তাহলে আমি প্রার্থী। দল যদি মনে করে এবং এলাকার জনগণ যদি ভালো মনে করে তাহলে আমি প্রার্থী হব। আমার ব্যক্তিগত আকাক্সক্ষা এক্ষেত্রে মুখ্য নয়। তবে এটি ঠিক, আমি দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় কাজ করেছি। ১৯৯০ সাল থেকে পরবর্তী বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ২০০১- বিএনপি-জামায়াতের ক্ষমতা দখলের পর নেতাকর্মীদের ওপর যে নির্যাতন নিপীড়ন হয়েছে, সে সময়টাতে আমি সার্বক্ষণিক নেতাকর্মীদের পাশে ছিলাম। সংগঠনেও কাজ করেছি দীর্ঘদিন। এলাকার নেতাকর্মী সাধারণ মানুষের সঙ্গে আমার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টানা গত দুই টার্ম ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য এলাকার অবকাঠামোগত অনেক উন্নয়ন করেছেন। কিন্তু আসনটির বর্তমান মূল সমস্যা হলো মাদক ঊঠতি বয়সীদের উৎপাত। ভাই-ভাইয়ের বিরোধেও প্রায়শই জড়িয়ে পড়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগের একাংশ। দলাদলি আর হানাহানি এখন পরিবারের মাঝেও ঢুকে পড়েছে। এসব ঘটনা শক্তহাতে মোকাবিলা এবং দলের অভ্যন্তরীণ বিভেদ দ্রুত সমাধান করতে না পারলে আগামী নির্বাচনে ভোটের ক্ষেত্রে তার প্রভাব পড়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের অনেকেই। তবে আগামী নির্বাচনে যারাই প্রার্থী হোক, আওয়ামী লীগ বিএনপির মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে।

×