ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ৩১ মে ২০২৩, ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০

নাগরিক দুর্ভোগ

পথে ঘাটে মোবাইলে ইন্টারনেটে যৌন হয়রানি

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ২৩:২৪, ২৫ মার্চ ২০২৩

পথে ঘাটে মোবাইলে ইন্টারনেটে যৌন হয়রানি

মোবাইলে ইন্টারনেটে যৌন হয়রানি

ফাতেমা সুমী। একটি সরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন। অফিস রাজধানীর মতিঝিলে। কিন্তু পরিবারের অন্য সদস্যদের সুবিধার জন্য বসবাস করতে হচ্ছে মিরপুরের কালশীতে। প্রতিদিন ভোর বেলা বিভিন্ন কারখানার পোশাক শ্রমিকদের সঙ্গে কখনো দাঁড়িয়ে, কখনো বসে বাসে করে আসেন মিরপুর সাড়ে ১২ নম্বর মোড়ে। সেখান থেকে মতিঝিলগামী বাসে উঠে চড়েন। জ্যাম না থাকলে মোটামুটি ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যান মতিঝিল। এভাবেই প্রায় প্রতিদিন তার দিন শুরু হলেও কয়েকদিন যাবত এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার মধ্যে পড়তে হচ্ছে তাকে।

কালশী’র ২২ তলা ভবনের সামনে থেকে যখন বাসে ওঠেন ঠিক তখনই তার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় মাঝবয়সী একটা লোকও ওঠে ওই বাসে। ভিড় ঠেলে ঠিক সেখানেই দাঁড়ায়, যেখানে ফাতেমার অবস্থান। কখনো গাড়ির ব্রেক বা কখনো ভিড়ের ধাক্কার অজুহাতে ঢলে ঢলে পড়ছেন ফাতেমার গায়ে। অযাচিত স্পর্শের অনুভূতি হয়েছে কয়েকবার। গা ঘিন ঘিন করা অনুভূতি নিয়েই সারাদিন অফিস শেষ করে আবার ফিরছেন ঘরে। এমন সমস্যার কথা কাকে বলবেন কিছুই বুঝতে না পেরে বাথরুমে গিয়ে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলেন।
তবে রিমা সুলতানার অভিজ্ঞতাটা একটু ভিন্ন। নীলক্ষেতের কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে থাকেন। চাকরি করেন একটি বেসরকারি আইটি কোম্পানিতে। অফিসটা নিউমার্কেট এলাকায় হওয়ায় প্রতিদিনই হোস্টেল থেকে বের হয়ে ফুটওভার ব্রিজ পেরিয়ে যেতে হয় অফিসে। কিন্তু কয়েকদিন ধরেই এক লোক তার পিছু নিচ্ছে। পেছনে ফিরলেই অশ্লীল অঙ্গভঙ্গী করে। কাছে গিয়ে তাকে শিক্ষা দেবে কি, বরং ঘৃণা এবং ভয়ে বমি আসতে শুরু করে রিমার।

কয়েকবার ভেবেছে নিচে কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশকে গিয়ে নিজের অবস্থার কথা বলবে। কিন্তু কি বলবে তাই যেন ভেবে পায় না। টানা দুই দিন যায়নি অফিসে। এমন হয়রানির মুক্তি কোথায় জানা নাই তার।
শুধু ফাতেমা বা রিমা নন। ইউএনডিপি বাংলাদেশ, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং সিআরআইয়ের যৌথভাবে করা এক জরিপে উঠে এসেছে দেশের প্রায় ৮৭ শতাংশ নারী জীবনে অন্তত একবার হয়রানির শিকার হয়েছেন। ২৪ জেলায় ৫ হাজার নারীর ওপর করা জরিপের পরিপ্রেক্ষিতে আরও বলা হয়, নারীকে সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার হতে হয় বাস-লঞ্চ-ট্রেনের টার্মিনালে। প্রায় ৩৬ শতাংশ নারী নিয়মিত এসব স্থানে যৌন হয়রানির শিকার হন। এই ৫ হাজার নারীর মধ্যে ৫৭ শতাংশই গণপরিবহনকে সবচেয়ে অনিরাপদ বলে মনে করেন। এদের মধ্যে ৫২ শতাংশ নারী দিনে হয়রানির শিকার হন এবং বেশিরভাগ ঘটনা ঘটে বিকেলের দিকে।

ওই জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, হয়রানির প্রতিক্রিয়ায় ৩৬ শতাংশ নারী প্রতিবাদ করেছেন। হয়রানির শিকার হয়ে মাত্র ১ শতাংশ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা চেয়েছেন। সমীক্ষায় আরও দেখা যায়, প্রকাশ্যে হয়রানির শিকার হয়েও ৪৪ শতাংশ নারী কোনো সহযোগিতা পাননি।
এদিকে সম্প্রতি ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়ায় গণপরিবহন ছাড়াও রাস্তা, শপিং মল এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতেও নারীদের হয়রানি বাড়ছে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, টেক্সট মেসেজ, ইমেইলের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন নারীরা। 
গত কয়েক বছরে ঘরে বসে নারীদের অনলাইনে পণ্য বেচা-কেনার প্রসার যেমন বেড়েছে, তেমনি প্রায় সব শ্রেণির নারীদেরই অনলাইনে সরব দেখা যায় অনলাইন ব্যবসার কারণে। ফলে শহর থেকে গ্রাম কিংবা স্বল্প থেকে উচ্চশিক্ষিত অধিকাংশ নারীকেই অনলাইনে সরব থাকছেন সব সময়। ফলে ফেসবুক, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ বা ইউটিউবে তাদের বিচরণ আগের চেয়ে অনেক বেশি।
এক গবেষণা বলছে, দেশের ৭১ শতাংশ নারী সাইবার বুলিংয়ের শিকার। সাইবার বুলিংয়ের শিকার পাঁচ জন নারীর মধ্যে অন্তত: এক জন আত্মহত্যা করেন। দেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীসহ ফেসবুক ব্যবহারকারীদের একটি বড় অংশই সাইবার বুলিংয়ের শিকার। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, দেশের তিন-চতুর্থাংশ নারীই সাইবার বুলিংয়ের শিকার। দেশের প্রায় ১২ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর মধ্যে উল্লেখ সংখ্যক নারী। 
এমনই অনলাইন মাধ্যমে যৌন হয়রানির কারণে আত্মহত্যা করা বুবলীর (ছদ্মনাম) মা  জমিলা খাতুন (ছদ্মনাম) আক্ষেপ করে বলেন, পড়ালেখার সুবিধার জন্য মেয়েকে স্মার্টফোন কিনে দিয়েই কাল হলো। রাত জেগে পড়াশোনার বদলে রাত জেগে ফোনে কথা বলত মেয়ে আমার। আর সরলতার সুযোগে এক লম্পট তার নগ্ন ছবি নিয়ে নেয় নিজের কাছে। এসব ছবি দেখিয়ে নানা সময় মেয়েকে ব্ল্যাকমেইল করতে থাকে। মেয়ে আমার এসব যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে। আত্মহত্যা করে। এই কষ্ট কিভাবে মেনে নেব?
ইউনিসেফের ২০১৯ সালের এক জরিপ অনুযায়ী, দেশে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়া ৩৮ শতাংশ ১০ থেকে ১৩ বছর বয়সের, ৩৬ শতাংশ ১৪ থেকে ১৫ বছর এবং ১৬ থেকে ১৭ বছর বয়সী ২৫ শতাংশ। ঢাকায় অনলাইনে হয়রানির শিকার নারীদের ৭০ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের জরিপে দেখা গেছে, অনলাইনে হয়রানির শিকার হয়ে পেশা পরিবর্তন করেছেন, চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন কিংবা স্বাধীন চলাচলে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন, এমন নারীর সংখ্যা ৩২ শতাংশ। অনলাইনে নিরাপত্তাহীনতায় পড়েছেন ২৫ শতাংশ এবং সামাজিকভাবে হেয় হয়েছেন ১৭ শতাংশ নারী।
তবে তাদের মধ্যে বেশিরভাগই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে কোনো ধরনের অভিযোগ করে না জানিয়ে ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের সাইবার সিকিউরিটি বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মো. নাজমুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, সাইবার বুলিংয়ে জড়িত অনেককেই আমরা আইনের আওতায় নিয়ে আসার কাজ করছি। এটা শুধু ঢাকা কেন্দ্রীক নয়। আমাদের এই কার্যক্রম সারা দেশব্যাপী। এর মধ্যে নারীদের বুলিংয়ের ঘটনাই বেশি। কিন্তু মৌখিকভাবে তারা আমাদের কাছে জানালেও সামাজিক ট্যাবুর কারণে মামলা করতে চান না।

আর মামলা না হলে আমাদের জন্য পদক্ষেপ নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। আমাদের কাছে তরুণীদের যত অভিযোগ আসে তার অধিকাংশই প্রেমঘটিত সাইবার ক্রাইম। এসব ক্ষেত্রে তরুণীদের আরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন। সাইবার ক্রাইম এখন যে পর্যায়ে চলে গেছে লজ্জা আর ভয় পেয়ে থাকলে চলবে না। হয়রানির শিকার হলে ভুক্তভোগীদের অবশ্যই পুলিশের সহায়তা নিতে হবে।