ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো...

মনোয়ার হোসেন

প্রকাশিত: ২৩:০৩, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো...

শেকলে বাঁধা রূপসী, বাংলা ভাষা, তুমি-আমি-দুর্বিনীত দাসদাসী/একই শেকলে বাঁধা পড়ে আছি

শেকলে বাঁধা রূপসী, বাংলা ভাষা, তুমি-আমি-দুর্বিনীত দাসদাসী/একই শেকলে বাঁধা পড়ে আছি শতাব্দীর পর শতাব্দী/আমাদের ঘিরে শাঁই-শাঁই চাবুকের শব্দ, স্তরে স্তরে শেকলের ঝঙ্কার...। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে এই বন্দি শেকলের আবর্ত থেকে আপন শক্তিতে জেগে উঠেছিল বাংলা ভাষা। দ্রোহের অনলে শোষকের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তকে ছারখার করে জয়ী হয়েছিল বাংলা বর্ণমালা।

পরাজিত হয়েছিল পরাধীনতার শৃঙ্খলে গড়া স্বেচ্ছাচারী সরকারের  সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। সেই সুবাদে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে ঠিকানা খুঁজে নিয়েছিল বাংলা মায়ের মাতৃভাষা। তাই তো বাংলা ভাষা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হবে কিনাÑ এমন প্রশ্ন নিয়ে যখন বিতর্ক জন্মে, তখন  সোচ্চার হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনতা। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দেশভাগের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান নামের যে রাষ্ট্র জন্মেছিল তাতে বাঙালি ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ।

কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠের ন্যায্যতাকে অস্বীকার করে ভাষার প্রশ্নের বাঙালির  মতামতকে উপেক্ষা করেছিল শাসকগোষ্ঠী। তাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক বিতর্কের পথ ধরে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে পূর্ব বাংলার জনগোষ্ঠী।  ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসের প্রথম সক্রিয় ভাষা আন্দোলনের নেপথ্যে সচেতনভাবে এই সংখ্যাগরিষ্ঠতার চেতনা এবং একটি বিশেষ মানবগোষ্ঠী হিসেবে স্বাতন্ত্র্যবোধ কাজ করছিল। এই ভাষা আন্দোলনের লক্ষ্য নিছক ভাষা অধিকারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। নেপথ্যে ছিল বাঙালির অস্তিত্ব ও স্বাধিকার আদায়ের লড়াই। 
সাতচল্লিশে দেশভাগের বাস্তবতায় বাংলার মূল কেন্দ্র কলকাতা পূর্ববঙ্গের বাইরে পড়ে। এই অঞ্চল থেকে বহু হিন্দু জমিদার কলকাতায় চলে যান। অন্যদিকে ভারতের ধনাঢ্য মুসলমানরা চলে যান পশ্চিম পাকিস্তানে। ভূমিনির্ভর ধনী মুসলমানরা বাস করতেন পশ্চিম পাকিস্তানে। মুসলিম লীগের মূল নেতৃত্বেও ছিলেন তারাই। তাই অচিরেই স্পষ্ট হয়, রাষ্ট্রভাষা উর্দু হলে চাকরির ক্ষেত্রে বেকায়দায় পড়বে বাঙালিরাই। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে পূর্ব বাংলায় সরকারি চাকরিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের আধিপত্য ছিল।

দেশ বিভাগের পর অধিকাংশ হিন্দু কর্মকর্তা-কর্মচারী চলে যান ভারতে। সে সময় ইংরেজ আধিপত্যেরও অবসান হয়। কিন্তু দেশ বিভাগ কার্যকর হওয়ার পর শুধু রাজনীতির ক্ষেত্রেই নয়, চাকরির ক্ষেত্রেও উদর্ুুভাষীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা বাঙালিদের চেয়ে উন্নততরÑ এই মনোভাব প্রকাশ পায় তাদের আচরণে। স্বভাবতই চাকরিসহ নানা ক্ষেত্রে বাঙালি সুবিচার পাবে নাÑ এমন আশঙ্কা ঘনীভূত হয়। তাই ভাষার প্রশ্নটি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মনে প্রগাঢ় হয়ে দেখা দিয়েছিল।
একইসঙ্গে শোষণের পশ্চাৎভূমি হয়ে উঠেছিল পূর্ব বাংলা। নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের বেশিরভাগ মানুষের বাস ছিল পূর্ব বাংলায়। ১৯৫১ সালের আদমশুমারিতে দেখা যায়, পাকিস্তানের বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে বাঙালি ছিল ৫৪.৬ শতাংশ, পাঞ্জাবি ২৮.৪ শতাংশ ও উর্দুভাষী ৭.২ শতাংশ। নিরঙ্কুুশভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল বাঙালি। অন্যদিকে পাকিস্তানের আঞ্চলিক ভাষাগুলোর মধ্যে বাংলাভাষাই ছিল সবচেয়ে সমৃদ্ধ।

এসব ছিল বাংলা ভাষার সপক্ষে বড় যুক্তি। স্বভাবতই পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষ আশা করেছিল এ অঞ্চলের উন্নয়নে সচেষ্ট হবে পাকিস্তানি শাসকরা। কিন্তু সেটা হয়নি। রাজধানী হওয়ার পাশাপাশি  ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস আদালত সবই পশ্চিমাঞ্চল ঘিরেই বেড়ে উঠল। পূর্ব বাংলার ক্রমশ অভ্যন্তরীণ উপনিবেশে পরিণত হওয়ার শঙ্কা  দেখা দেয় এ অঞ্চলের মানুষের। সে কারণে ভাষা আন্দোলন হয়ে উঠেছিল পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের অস্তিত্বের লড়াই এবং অধিকার আদায়ের আন্দোলন।

×