ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ডায়ালাইসিসের ফিতে স্বেচ্ছাচারিতা

নিঃস্ব হচ্ছে পরিবার ॥ কিডনি রোগের চিকিৎসায়

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ০১:৪৬, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

নিঃস্ব হচ্ছে পরিবার ॥ কিডনি রোগের চিকিৎসায়

.

অসংক্রামক রোগের মধ্যে মহামারি আকার ধারণ করছে কিডনি রোগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বে ৮৫ কোটির বেশি মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত। দেশে অন্তত ২ কোটি মানুষ ভুগছে কিডনিজনিত বিভিন্ন রোগে। এদের মধ্যে কিডনি বিকল হয়েছে ৮ লাখ রোগীর। প্রতিস্থাপনের সুযোগ সীমিত থাকায় ডায়ালাইসিস ছাড়া কিডনি রোগীদের সুস্থ থাকার আর কোনো উপায় নেই। কোনো কোনো রোগীর সপ্তাহে  ৩ থেকে ৪ বার পর্যন্ত ডায়ালাইসিস করতে হয়।

বেশিরভাগ বেসরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস ফি শুরু হয় ৩ হাজার টাকা থেকে। তবে একটু উন্নতমানের হাসপাতালে এ খরচ ৫ থেকে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত। ন্যূনতম মানের হাসপাতালগুলোতে ৩ হাজার টাকা করে সপ্তাহে তিনবার করে একজন রোগীকে ডায়ালাইসিসের জন্য দিতে হয় অন্তত ৩৬ হাজার টাকা। আর যদি উন্নতমানের কোনো হাসপাতালে যাওয়া হয় তাহলে রোগীপ্রতি মাসে শুধু ডায়ালাইসিসের খরচ পড়বে ৬০ হাজার টাকা। বছরে এ খরচ দাঁড়ায় সাড়ে ৭ লাখের বেশি। সরকারি হাসপাতালগুলোতে মাসের পর মাস অপেক্ষা করেও সিরিয়াল না পেয়ে জীবন বাঁচানোর তাগিদে বাধ্য হয়ে এসব বেসরকারি হাসপাতালেই ডায়ালাইসিস করাতে হয় তাদের। এতে কিডনি রোগীর সঙ্গে সঙ্গে ভুগতে হয় পুরো পরিবারকে। আর্থিকভাবে নিঃস্ব হতে হয় বেশিরভাগকেই। সরকারি হাসপাতালে সিরিয়াল পেলেও সেখানেও ওষুধের দাম বাবদ দিতে হয় ১২ থেকে ১৪শ’ টাকা। সপ্তাহে তিন দিনের হিসাবে মাসে সেই খরচ দাঁড়ায় ১৬ হাজার ৮শ’ টাকা। বছরে ২লাখ ১হাজার ৬শ’ টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিডনি অকেজো হওয়ার পর ডায়ালাইসিস করে বেঁচে থাকতে কিডনি রোগীদের ১২ থেকে ২২ শতাংশ লোকের সম্পদ বিক্রি করে দিতে হচ্ছে। দেশের কিডনি রোগীদের মোট এক শতাংশেরও কম কিডনি প্রতিস্থাপনের সুবিধা রয়েছে। ফলে যতদিন রোগী বেঁচে থাকবে, ততদিন ডায়ালাইসিসের বিকল্প নেই। কিন্তু রোগীর তুলনায় রাজধানীসহ দেশের কোথাও সরকারি হাসপাতালগুলোতে নেই পর্যাপ্ত ডায়ালাইসিসের সুযোগ। এসব হাসপাতালে এত পরিমাণ রোগীর ডায়ালাইসিসের চাহিদা থাকে যে সিরিয়াল পেতে পেতে পার হয়ে যায় মাস পর্যন্ত। কিন্তু যে রোগীর প্রতিসপ্তাহে ৩ বার ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন, সেই রোগীর সিরিয়ালের অপেক্ষায় বসে থাকার উপায় থাকে না। তাই, বাধ্য হয়ে রোগীর স্বজনরা নিয়ে যায় বেসরকারি হাসপাতালে। সরকার নির্ধারিত নির্দিষ্ট কোনো ফি না থাকায় এসব হাসপাতাল ডায়ালাইসিসের জন্য তাদের ইচ্ছেমতো ফি আদায় করে রোগীর স্বজনদের কাছে। বাড়ি, জমি, সম্পত্তি সব বিক্রি করেও প্রিয়জনকে বাঁচাতে মরিয়া স্বজনরা হাসপাতালের নির্ধারিত ফি মাসের পর মাস বহন করে।
এমনই এক কিডনি বিকল রোগীর ছেলে হামিদুজ্জামান। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, মায়ের কিডনি বিকল হওয়ার পর প্রথম ৬ মাস রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করিয়েছি। সপ্তাহে ৩ দিন ডায়ালাইসিসের জন্য ওখানে প্রতিবার দিতে হতো ৪ হাজার টাকা করে। একপর্যায়ে গ্রামের বাড়ি বিক্রি করে টাকা আনতে হয়েছে। তাও খরচ কুলাতে পারছিলাম না। পরে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে এনে আম্মাকে ভর্তি করাই। কিন্তু এখানেও প্রতি ডায়ালাইসিসে খরচ হয় প্রায় ২ হাজার টাকা। এছাড়া হাসপাতালে থাকা-খাওয়ার খরচ তো রয়েছেই। ওষুধের কথা না হয় বাদই দিলাম। এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে, চিকিৎসার খরচ যোগাতে সম্পত্তি ছাড়াও এটা-সেটা প্রতিদিনই বিক্রি করতে হচ্ছে। আমিই একমাত্র ছেলে। সারাক্ষণ মায়ের কাছেই থাকতে হয়। অন্য আয়ের সুযোগ নেই। সরকার যদি একটু সহযোগিতা করত, তাহলে হয়ত এতটা কষ্ট হতো না।
একই রকম আক্ষেপের কথা জানান, রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে কিডনি বিকল হওয়া মায়ের চিকিৎসায় নিঃস্ব প্রায় রহমান হোসেন। তিনি বলেন, এই হাসপাতালে ২৭ দিনে আইসিইউসহ বিল এসেছে ৮ লাখ ৭ হাজার টাকা। গ্রামের ধানী জমি বিক্রি করে এনে বিল পরিশোধ করে পরে একটি সাধারণ হাসপাতালে মাকে ভর্তি করিয়েছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছি চারবার। কিন্তু ভর্তির জন্য সিরিয়াল দিয়ে বিদায় দিয়েছে। এখন যে হাসপাতালে ভর্তি করেছি সেখানে ডায়ালাইসিসের জন্য প্রতিবার দিতে হয় ৩ হাজার টাকা। কতদিন এ খরচ চালাতে পারব, জানি না।
জানা যায়, দেশে সরকারি ও বেসরকারি ১০১টি কেন্দ্রে ডায়ালাইসিস করা হয়। এসব কেন্দ্রে ডায়ালাইসিসের সুযোগ পাচ্ছে মাত্র ১৮ হাজার রোগী। সবাইকে ডায়ালাইসিস দিতে দরকার কমপক্ষে এক হাজার কেন্দ্র। এসব কেন্দ্রের মধ্যে সরকারের জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি হাসপাতালের ডায়ালাইসিস কেন্দ্রে এবং চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ডায়ালাইসিস কেন্দ্রে রোগীর খরচ সবচেয়ে কম। এই দুটি কেন্দ্র চলে ভারতের ‘স্যানডোর’ নামের একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারিত্বে। প্রতিবার ডায়ালাইসিসের জন্য রোগীকে ৪০০ টাকা দিতে হয়, আর সরকার ভর্তুকি দেয় ১ হাজার ৭০০ টাকা। কিন্তু সম্প্রতি ডলারের মূল্য বৃদ্ধির অজুহাতে ডায়ালাইসিস ফি বাড়ানোর লক্ষ্যে চট্টগ্রামে ডায়ালাইসিস কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় স্যানডোর। এতে করে রোগীদের সৃষ্টি হয় চরম ভোগান্তি। এর কয়দিন পর একই অবস্থা তৈরি হয় ঢাকাতেও। কিন্তু কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও আজ বা কাল এখানেও ডায়ালাইসিস ফি বাড়াবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে কিছুটা সুলভ মূল্যে ডায়ালাইসিসসহ কিডনি রোগের চিকিৎসা পাওয়া যায় রাজধানীর ধানম-ির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে। হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, আমি নিজে যখন মিরপুরের কিডনি ফাউন্ডেশনে ডায়ালাইসিস নিচ্ছিলাম তখন অন্য রোগীদের কাছ থেকে অসহায়ত্বের কথা জেনেছি। দেখলাম চিকিৎসা আছে, কিন্তু মানুষ চিকিৎসা পাচ্ছে না। মানুষের কাছে ডায়ালাইসিস সেবা সহজলভ্য করার জন্য আমি এই কেন্দ্র স্থাপন করার উদ্যোগ নেই। হাসপাতালের চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় ডায়ালাইসিস করা হয়। ৫০ স্বাস্থ্যকর্মী (নার্স ও টেকনিশিয়ান) ও ছয় চিকিৎসক প্রতিপালায় কাজ করেন। কেন্দ্রে হেপাটাইটিস বি ও হেপাটাইটিস সি আক্রান্ত রোগীদের ডায়ালাইসিস করার জন্য ১৭টি পৃথক শয্যা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, রোগীকে ডায়ালাইসিসের জন্য নিবন্ধন করার আগে তার আর্থিক অবস্থার মূল্যায়ন করে থাকি আমরা। হতদরিদ্র মানুষের কাছ থেকে কোনো অর্থ নেওয়া হয় না। দরিদ্র মানুষের কাছ থেকে প্রতি সেশনের জন্য ১ হাজার ১০০ টাকা, মধ্যবিত্তের কাছ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা নেওয়া হয়। আর উচ্চবিত্ত বা ধনী রোগীদের কাছ থেকে নেওয়া হয় ৩ হাজার করে।
কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতালের চিকিৎসক শেখ মইনুল খোকন কিডনি রোগীদের বিষয়ে বলেন, কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিস এবং ট্রান্সপ্লান্ট হলে চিকিৎসা নিরবচ্ছিন্ন চালিয়ে যেতে হয়। কিডনি ডায়ালাইসিস করতে রোগীকে নিয়ে আসতে-যেতে আরেকজনকে আসতে হয়। রোগী নিজেও কর্মক্ষম থাকে না, আবার পরিবারের আরেকজন কর্মক্ষম ব্যক্তিকে তার জন্য ব্যস্ত থাকতে হয়। আমাদের কাছে অনেক রোগী শুরুতে ক্যাবিন নিয়ে চিকিৎসা করে কিন্তু একটা সময় তারা খরচ চালাতে না পেরে বিনামূল্যের শয্যা চায়। আমরা ভর্তুকি দিয়ে হলেও রোগী না পারলে তাকে ডায়ালাইসিস দিয়ে থাকি। কিন্তু অন্য জায়গায় তো এমনটি নয়। কিডনি রোগ এমনই একটি জটিল ও ব্যয়বহুল রোগ যে, রোগী ও তার স্বজনদের সর্বস্বান্ত করে দেয় এ রোগের চিকিৎসা ব্যয়।
সরকার থেকে কিডনি রোগের চিকিৎসায় ভর্তুকি দেওয়া প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক এ বি এম আব্দুল্লাহ। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী কিডনি রোগ একটি ভয়াবহ স্বাস্থ্য সমস্যা। এ রোগের মারাত্মক পরিণতি এবং চিকিৎসা ব্যয় সাধ্যাতীত হওয়ায় সিংহভাগ রোগীই প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। তবে এই রোগ প্রতিরোধযোগ্য। একটু সচেতনতায় এটি প্রতিরোধ করা যা। তবে চিকিৎসা খরচের ক্ষেত্রে আমি বলব, দরিদ্র রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে ‘সুরক্ষা বিমা’ চালু এবং মরণোত্তর দেহ দানের বিষয়টি বেশি করে আলোচনায় আনতে হবে। দেশে প্রতিবছর ১৫ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। একটি সময় পর্যন্ত তাদের কিডনি, লিভারসহ অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ভাল থাকে। সেগুলো দান করা হলে দুস্থ রোগীদের জন্য কিডনি পাওয়া সহজ হবে। এসব কিডনি প্রতিস্থাপনে যদি সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনা দেওয়া হয় তাহলে কিডনি রোগে আর কোনো রোগীর স্বজনকে সহায়সম্বলহীন হতে হবে না।
সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন একটি সফল কিডনি প্রতিস্থাপিত হয়েছে যা উদাহরণ হতে পারে উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, ব্রেন ডেথ রোগী সারাহ ইসলামের কিডনিতে সুস্থ জীবন পেয়েছেন দুই নারী। এমন যদি মরণোত্তর কিডনি পাওয়া যায় তাহলে প্রতিস্থাপন করলে ওই রোগীকে আর ডায়ালাইসিস করাতে হবে না। এতে স্থায়ী চিকিৎসা সম্ভব। ব্রেন ডেথ বা শুধু হার্টবিট ছাড়া শরীরের অন্য কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাজ করছে না এমন একজন রোগীর শরীর থেকে অন্তত ১০ রকমের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন করে অন্য একজন মানুষ সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারে। আর এই প্রক্রিয়াকেই বলে ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্লান্ট। একজন ব্রেন ডেথ রোগীর দুটি কিডনি দুজনকে, একটি লিভার একজনকে, দুটি লাংস দুজনকে, হৃদযন্ত্র একজনকে, অন্ত্র  একজনকে, অগ্ন্যাশয় একজনকে দান করা খুবই সহজ একটি প্রক্রিয়া। বরং ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্লান্টটি অন্যান্য ট্রান্সপ্লান্ট থেকে সহজ। তাই, শুধু কিডনি নয় অন্যান্য জটিল অসংক্রামক রোগেরও স্থায়ী চিকিৎসা সম্ভব ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্লান্টের মাধ্যমে।

 

×