ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সীমান্তে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অপতৎপরতা শিগগির যৌথ টহল দেবে বিজিবি

প্রকাশিত: ১৯:৩৫, ২৯ নভেম্বর ২০২২

সীমান্তে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অপতৎপরতা শিগগির যৌথ টহল দেবে বিজিবি

বিজিবি সদর দপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে মাইন পুতে রাখা, বিভিন্ন ধরনের মাদক পাচার, অবৈধ অনুপ্রবেশসহ সীমান্তে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী বা সন্ত্রাসী সংগঠনের সদস্যরা। 

মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তৎপরতার কারণেও সীমান্তে বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছে। তাই বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অপতৎপরতা রোধকল্পে বিজিবি ও বিজিপি যৌথ টহলের ব্যাপারে একমত পোষণ করেছে। খুবই শিগগির দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী যৌথ টহল শুরুও করবে বলে জানিয়েছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল সাকিল আহমেদ।    

বিজিবি এবং বিজিপি’র মধ্যে মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোতে গত ২৩ থেকে ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত ৮ম সীমান্ত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে গৃহিত সিন্ধান্তসমূহের বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে মঙ্গলবার দুপুরে বিজিবি সদর দপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান বিজিবি’র ডিজি। 

সম্মেলনে আলোচ্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে বিজিবি ডিজি বলেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা বা সংঘাতের কারণে বাংলাদেশ সীমান্তেও যে অস্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করছে, তা তাদের জানানো হয়েছে। এতে হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। প্রতিটি ঘটনার পর আমরা প্রতিবাদ জানিয়েছে। মিয়ানমার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে এবং এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে জানিয়েছে। 

আকাশ সীমা লঙ্ঘনের ঘটনাও ঘটেছে, সেটিও জানানো হয়েছে। আকাশ সীমা লঙ্ঘনের ফলে স্থানীয়দের মাঝে একটা শঙ্কা বা আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। এতে সীমান্তের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ব্যাঘাত ঘটে। তাই মিয়ানমারকে বলেছি, তারা ড্রোন উড়ালে কিংবা হেলিকপ্টার চলাচলের আগাম তথ্য যেন আমাদের শেয়ার করে। সীমান্তে মাইন পুতে রাখার কারণে আমাদের ও তাদের কিছু সংখ্যক লোক আহত হয়েছেন। 

তাদের মতে, বিচ্ছিনতাবাদীরা এই মাইন পুতে রাখে। আমরা বলেছি, এটা উভয় দেশের জন্যই থ্রেট। তাই এ বিষয়টি বিজিবি ও বিজিপি যৌথভাবে পর্যবেক্ষণ করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যৌথভাবে স্থলপথে টহল নিশ্চিত করতে পারলে মাদককারবারী, অবৈধ অনুপ্রবেশকারী ঠেকানো সম্ভব হবে। আর যৌথভাবে টহলের বিষয়টি আমরা পর্যালোচনা করবো, না হলে তাদের আবারো অবহিত করা হবে। 

বিচ্ছিন্নতাবাদী কারা? এমন প্রশ্নের জবাবে ডিজি বলেন, দুই দেশের বর্ডার বা এর নিকটতম জায়গায় সংঘাত হচ্ছে। কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী যেন তাদের ও আমাদের ভূখন্ডে প্রবেশ করে বিশৃঙ্খলা করতে না পারে, সেজন্য আমরা তথ্য আদান-প্রদান করব। 

কোন দেশই সীমান্তে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অবস্থান করতে দিবে বলে রাজি হয়েছে। যেসব জায়গায় চোরাচালান, মানব-পাচারের ঘটনা বেশি এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অপতৎপরতা বেশি সেখানে মাইন আছে বলে তারা জানিয়েছে। আমরা বলেছি, সেখানে আমরা যৌথভাবে কাজ করতে চাই। যেখানে ঝুঁকি কম সেখানে যেন মাইন সরিয়ে নেওয়া হয়। এসব বলার পর আমরা দেখব কতটুকু কাজ হচ্ছে। আমরা আপডেট জানব। এই তৎপরতা অব্যাহত থাকলে একটা ইতিবাচক ফল আসবে। 

সম্মেলনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়টিও গুরুত্বসহকারে উপস্থাপন করা হয়েছে জানিয়ে বিজিবি ডিজি বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন নিয়েও তারা আশ্বাস্থ করেছেন, তারা নোট করে রেখেছেন। বিষয়টি ওপর মহলে জানাবেন বলে জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ অব্যাহত থাকবে। 

আশা করি, আমাদের মধ্যকার যোগাযোগ আরও জোরালো ও কার্যকর হবে। সেক্টর, ডিজি, সেক্টর কমান্ডার পর্যায়ে যোগাযোগ বাড়ানোর ব্যাপারে উভয়পক্ষই একমত হয়েছি।

ইতিবাচক মনোভাবের কথা অনেকবারই শুনেছি। কিন্তু কী কারণে জিরো লাইনে এখনো কয়েক হাজার মানুষ বসে আছে? তাহলে ইতিবাচক মনোভাব কীভাবে দেখছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে বিজিবি ডিজি বলেন, আমি মিয়ানমারের তিন পর্যায়েই কথা বলেছি। প্রত্যেক পর্যায়েই তারা আমাদের কথা গুরুত্বের সঙ্গে শুনেছেন। এই শোনা, ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করা, আশ্বস্ত করা, আমাদের কথা গ্রহণ করাকে আমরা ইতিবাচক সাড়া হিসেবে দেখছি। 

রোহিঙ্গা ইস্যুতে কাউন্টার পার্ট হিসেবে তাদের দায়িত্বহীন মনে হয়েছে। ইতিবাচক মনোভাব কি শুধু টেবিলের আলোচনাই? এমন প্রশ্নের জবাবে বিজিবি প্রধান বলেন, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা নাগরিকদের মিয়ানমারের জাতীয় পাঠ্য কারিকুলামে পড়াশুনা করানো হচ্ছে। কারিগরি শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের সন্তানরা মিয়ানমারের জাতীয় সংগীত পাঠ করছে, এই ভিডিও আমি তাদের দেখিয়েছি। বলেছি, মানবিক কারণে মানবিক বিপর্যয় ঠেকাতেই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। 

তাদের এও বুঝিয়েছে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে যাওয়ার পর তাদের জন্য বোঝা হবে না। এসব বলার পর তারা গুরুত্বসহকারে শোনেছেন, গ্রহণ করেছেন। আলোচনা করেছেন, ইতিবাচক আশ্বাস দিয়েছেন। তাই মনে হচ্ছে, এ ব্যাপারে বাস্তবতা রয়েছে। এটা হতেই হবে এবং সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। যদিও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন দীর্ঘ মেয়াদি একটা প্রসেস। তারা এই জায়গায় কাজ করছেন বলেই মনে হয়েছে। কূটনৈতিক পর্যায়েও কাজ হচ্ছে। বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে। 

রোহিঙ্গাদের নিয়ে গেলেও মিয়ানমারের রাখাইন তাদের রাখার জন্য প্রস্তুত কিনা, আপনারা সেখানে ঘুরে কী দেখেছেন?- এমন প্রশ্নের উত্তরে ডিজি বলেন, রাখাইনের পরিস্থিতি অনেকখানি উন্নীত হয়েছে বলে মনে হয়েছে। তাদের সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর সঙ্গে একটা সংঘাতও চলছে। এতেও বুঝা যায়, এটাও রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের জন্য একটা ইতিবাচক দিক। 

বাংলাদেশে ইয়াবার চোরাচালান, কারবার সবই হচ্ছে সীমান্ত পথে। যা আসে মিয়ানমার থেকে। সীমান্তে মাদক চোরাচালান রোধে বিজিবি কতটা সফল? এমন প্রশ্নের জবাবে ডিজি বলেন, বিজিবি মাদকের চোরাচালান বন্ধে সফল। তবে শতভাগ সফল তা বলব না। জিরো টলারেন্স নীতি ধারণ করে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে বিজিবি। 

সম্মেলনে মিয়ানমারের মাদক সংশ্লিষ্ট অফিসাররা ছিলেন। তারা তাদের দেশের মাদকের অবস্থান সম্পর্কে আমাদের অবহিত করেছেন, একটি তালিকা দেখিয়েছেন। তাদের দেশ থেকে কোন কোন পথে এবং কোথায় কোথায় মাদক যাচ্ছে, তা তারা দেখিয়েছেন। তাদের দেশ থেকে যে মাদক আসছে, তা তারা অস্বীকার করছেন না। মাদক যে তাদের জন্যও থ্রেট/ক্ষতিকর, এটা তারাও বলছেন। 

তবে মাদক পাচারের ক্ষেত্রে কিছু জেলে জড়িত। জেলেরা ছোট ছোট নৌকায় করে মাদক আনছে। পাহাড়ী, দুর্গম ও বন্যাঞ্চল সীমান্ত দিয়ে মাদকগুলো আনা হচ্ছে। ওই সব সীমান্তে দুই দেশের যে কোস্টল রয়েছে, তাদের মধ্যে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখতে বলা হয়েছে। আমরা আমাদের মাদক কারবারীদের নামের তালিকা তাদের দিয়েছি। বলেছি, এখান থেকে এরা গেলে যেন আটক করা হয়। 

আমাদের নজরে আসলেও আমরা তাদের দেশের চিহ্নিত মাদক কারবারীদের আটক করব। মিয়ানমার সীমান্তে মাদকের যে কারখানা রয়েছে, সেই তালিকাও বিজিপিকে দিয়েছি। বলেছি, তারা যেন এসকল মাদক কারাখানার বিষয়টি খতিয়ে দেখে এবং ব্যবস্থা নেয়। তারা মাদকের জব্দ তালিকা আমাদের দেখিয়েছে। আমরা মিলিয়ে দেখলাম, আমাদের সঙ্গে অনেক মিল রয়েছে। এতে বুঝা গেল, তারাও মাদক নিয়ে উদ্বিগ্ন, তারাও কাজ করছে। 

আগামী সীমান্ত সম্মেলন শুরু হবে ২০২৩ সালের মে অথবা জুন মাসে। সেই সম্মেলনের আগে আলোচ্য বিষয়গুলোর বাস্তবায়ন দেখা যাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে ডিজি বলেন, আমরা আগামি সম্মলনের আগেই বিজিপি’র সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে যোগাযোগ করব। আগ্রগতি নিয়ে জানতে চাইবো। 

উদাহরন টেনে ডিজি বলেন, আমাদের ১৮ জন জেলে ভুলবশত মিয়ানমারের সীমান্তে ঢুকে যায়। এদের মধ্যে ৪ জনকে ফেরত দেয়া হয়েছে। বাকি ১৪ জনকে তারা তাদের দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়েছে। বিষয়টি তাদের নজরে এনে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছি এবং বলেছি, নদী পথে জেলেরা বর্ডারের সীমানা বুঝতে পারে না। 

তাই ভুলবশত বর্ডার ক্রস করেছে। তাদের পরিবার এখন কষ্টে দিনাতিপাত করছে। এসব বিষয়গুলো মানবিক হিসেবে দেখার এবং সঙ্গে সঙ্গে পতাকা বৈঠক করে আলোচনার মাধ্যমে হস্তান্তর করার কথা জানিয়েছে। একই সঙ্গে ১৪ জন জেলের বিরুদ্ধে লিগ্যাল একশন শেষ হলে দ্রুত ছেড়ে দেয়ার কথাও তাদের জানিয়েছি।  

সীমান্তে ডিজিএফআইয়ের এক সদস্যকে খুন ও স্পেশাল অপারেশনের বিষয়ে ডিজি সাকিল আহমেদ বলেন, দেশের ভূখন্ডে যেকোন সংস্থা স্পেশাল অপারেশন চালাতে পারে। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতেই অপারেশন পরিচালনা করা হয়েছিল। তবে অনেক সময় সময় স্বল্পতার কারণে বা ঘটনার আকস্মিকতার কারণে অনেক তথ্য শেয়ার করা সম্ভব হয় না। যে কারণে একজন ডিজিএফআই সদস্যকে আমরা হারিয়েছি। এটি আমাদের ভূখন্ডের ভেতরে ঘটেছে। এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এ ঘটনায় তদন্ত হচ্ছে। আমরা ভবিষ্যতে এ ধরনের কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার পুনরাবৃত্তি চাই না।

নেপিদোতে সীমান্ত সম্মেলনে এসব বিষয় ছাড়াও বিজিবি-বিজিপির সদস্যদের মধ্যে খেলাধুলা, প্রশিক্ষণ কর্মকান্ড বিনিময়; দুই দেশের কারাগারে আটক নাগরিকদের কারাবাসের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তরের বিষয়ে একমত পোষণ, কোন ব্যাপারে দ্রুত সাড়া প্রদান এবং ডিজি, ব্যাটালিয়ন কমান্ডার ও রিজিয়ন কমান্ডার পর্যায়ে বৈঠক নিয়ে উভয় পক্ষের গৃহীত সিন্ধান্তসমূহ তুলে ধরেন ডিজি।  
 

 

ফজলু /এমএস

সম্পর্কিত বিষয়:

×