
নামে উন্নয়ন কেন্দ্র। আদতে জেলখানার চেয়ে বাজে অবস্থা তিনটি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের। বিভিন্ন ভয়ংকর ও লঘু অপরাধে গ্রেপ্তারকৃত অল্প বয়সী বালক বালিকাদের এসব উন্নয়ন কেন্দ্রে বন্দি জীবন কাটাতে হয়।
নামে উন্নয়ন কেন্দ্র। আদতে জেলখানার চেয়ে বাজে অবস্থা তিনটি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের। বিভিন্ন ভয়ংকর ও লঘু অপরাধে গ্রেপ্তারকৃত অল্প বয়সী বালক বালিকাদের এসব উন্নয়ন কেন্দ্রে বন্দি জীবন কাটাতে হয়। তিনগুণ নিবাসী নিয়ে এসব উন্নয়ন কেন্দ্রের অবস্থা খুবই বেহাল। এক কাত হয়ে ঘুমাতে হয় কিশোর বন্দিদের। তাদের জীবনমানের পাশাপাশি খাবার মান অত্যন্ত নি¤œমানের। উন্নয়ন কেন্দ্রে আছে বড় ভাইয়ের কালচার। তাদের অন্যায় অত্যাচারে অতিষ্ঠ এখানকার নিবাসীরা। গত ২০ জানুয়ারি সন্ধ্যায় টঙ্গীর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের টয়লেট থেকে রিজ উদ্দিন মোল্লা (১৭) নামে ভারতীয় এক কিশোরের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার হয়েছিল।
রিজ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার মগরাহাট থানার মর্যাদা এলাকার আব্দুল গাফফারের ছেলে। পুলিশ জানায়, অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে রিজের বিরুদ্ধে গত বছর ৫ জুলাই কিশোরগঞ্জ থানায় মামলা হয়। পরে তাকে টঙ্গীর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। রিজ ওই কেন্দ্রের ৫ নম্বর কক্ষে থাকত।
এর আগে ২০২০ সালে যশোর পুলের হাট শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পিটুনিতে তিন কিশোর মারা যায়। কেন্দ্রে তাদের সঙ্গে থাকা কয়েকজন কিশোর আহত হয়েছিল। একই কেন্দ্রে ২০১৪ সালে ১৫ কিশোর কাঁচ দিয়ে শরীর রক্তাক্ত করে প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিল, ওরা ভালো নেই। নির্মম এই ঘটনায় কিশোর কেন্দ্রে নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। সে সময় দেশের তিনটি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। এখন নির্যাতনের মাত্রা কম হলেও দেশের তিনটি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের বেহাল দশা।
দেশের তিনটি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালনা করছে। একের পর অপ্রীতিকর ঘটনা জন্ম দেওয়া এসব কেন্দ্রের অনেক করুণ অবস্থা। আসনের চেয়ে তিনগুণ নিবাসী কষ্ট ও যন্ত্রণায় দিনযাপন করছে তারা। এক কাত হয়ে ঘুমাচ্ছে। জীবনমানের পাশাপাশি খাবার মান অত্যন্ত নিম্নমানের অভিযোগ রয়েছে। আছে বড় ভাই কালচার। রীতিমতো জেলাখানার চেয়ে ভয়ংকর অবস্থা এখানে। এমন অভিযোগ সেখানে বন্দিজীবনে বসবাসকারী কিশোর ও অভিভাবকদের। বন্দিজীবনে বড় ভাই গ্যাংদের অন্যায় অত্যাচারে অতিষ্ঠ তারা। সম্প্রতি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে জামিনে বের হওয়া কিশোর জানালেন সেখানকার দুর্বিষহ জীবনের কথা।
কেমন আছে নিবাসীরা ॥ টঙ্গী, গাজীপুর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে বালক এখানে অনুমোদিত আসনের সংখ্যা ৩০০। এর বিপরীতে তিনগুণের বেশি নিবাসী আছে ৯০৫ জন। দিনে রাতে ঘুমাতে গেলে এক কাত হয়ে ঘুমাতে হয়। অসহ্য গরম চর্ম রোগে আক্রান্ত হচ্ছে অনেক নিবাসী। আর কেন্দ্রে বড় ভাইয়ের জাঁতাকলে জীবন ওষ্ঠাগত এখানকার বালক নিবাসীরা। তাদের জীবনমান, খাবার দাবার অত্যন্ত নিম্নমানের বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। গোসলখানার নোংরা পবিবেশ। বাথরুমে উপচে পড়া ময়লার দুর্গন্ধে সেখানকার নিবাসীদের পরিবেশ ভারি হয়ে উঠে। সম্প্রতি টঙ্গী শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে জামিনে বের হওয়া এক কিশোর জানালেন কেন্দ্রের ভেতরকার দুর্বিষহ জীবনের কথা।
এ ব্যাপারে টঙ্গী, গাজীপুর শিশু উন্নয় কেন্দ্রের (বালক) তত্ত্বাবধায়ক সহকারী পরিচালক এহিয়াতুজ্জামান জনকণ্ঠকে জানান, আগের পরিবেশ এই কেন্দ্রে নেই। এখানে আবাসন সমস্যাটা একটু বেশি। আসন সংখ্যার চেয়ে তিনগুণ বেশি নিবাসী কষ্ট করে এখানে থাকছে। সম্প্রতি আবাসন সংকট নিরসনের জন্য এখানে ১৪ তলা ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। যাতে নিবাসীরা আরাম করে ঘুমাতে পারে। খাবার মান আগের তুলনায় অনেক ভালো। দুই একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়া কিছু হচ্ছে না। সব ভালোভাবে চলছে।
তিনি জানান, ১৯৭৮ সালে ৩.৭১ একর জমির ওপর নিবাসীদের জন্য দোতলা ও পাঁচতলা দু’টি ভবন এবং মূল ভবন (প্রশাসনিক ভবন) দোতলা। এ নিয়ে যাত্রা শুরু করে টঙ্গী শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে। এই সরকার আসার পর টঙ্গী খাবার মান বৃদ্ধি করা হয়েছে। সকাল, বিকেল ও রাতে মাছ, মাংস, দুধসহ উন্নতমানে খাবার দেয়া হচ্ছে। প্রতি সপ্তাহ শুক্রবারে ভালো খাবার পরিবেশন করা হয়। আর বছরে বিশেষ দিনগুলো পোলাউ মাংস, সেমাইসহ উন্নত খাবার পরিবেশন করা হয়। সহকারী পরিচালক এহিয়াতুজ্জামান জানান, ৯০৫ জন নিবাসী বিভিন্ন মামলার আসামি রয়েছে। হত্যা মামলার আসামি ২০০ জন, মাদক মামলা আসামি ২০০ জন, নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা আসামি ২০০ জন। আর বাকিরা চুরি, ছিনতাই, ডাকাতিসহ বিভিন্ন মামলার আসামি।
এদিকে গাজীপুর কোনাবাড়ির শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র (বালিকা) আসন সংখ্যা দেড়শ’। তার মধ্যে বিভিন্ন অপরাধে আসামি ৮৬ জন এখানে থাকছে। হত্যা, নারী পাচার, মাদক মামলার প্রায় ৬০ আসামি রয়েছে। এখানকার আবাসনের কোন সমস্যা নেই। তবে নোংরা পরিবেশ, খাবার দাবার অত্যন্ত নিম্নমানের আর নিরাপত্তাকর্মী ও কর্মচারীদের দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ নিবাসীরা। সম্প্রতি এই শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে জামিনে বের হওয়া দুই কিশোরী এসব অভিযোগ করেন।
তবে এ ব্যাপারে এই শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের (বালিকা) তত্ত্বাবধায়ক সহকারী পরিচালক ওবায়দুল্লাহ আল মাসুদ জনকণ্ঠকে জানান, ২০০৩ সালে ১.০৫ একর জমির ওপর গাজীপুর কোনাবাড়ী শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে (বালিকা) প্রতিষ্ঠা করা হয়। ৪ তলা আবাসিক ভবনের প্রতি তলায় ১০ কক্ষসহ ৪০টি কক্ষে ৮৬ জন বালিকা নিবাসীরা আরাম আয়েশে থাকছেন।
তিনি জানান, এই উন্নয়ন কেন্দ্রের থাকা ও খাওয়া পরিবেশ অনেক উন্নত। ইনডোর মাঠে ব্যাডমিন্টন, কেরামবোর্ড, দড়ি লাফ, দাবা খেলা হয়। পাশাপাশি তিনতলার মূল ভবনে লাইব্রেরি, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার রয়েছে। কম্পিউটার, এম্ব্রোডায়েরি, সেলাই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতি সপ্তাহে সাংস্কৃতিক প্রোগ্রাম করা হয়। আর ধর্মীয় প্রোগ্রাম থাকে সব সময়।
এদিকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পিটুনিতে তিন কিশোরের মৃত্যু এবং নিজেদের শরীরের ১৫ কিশোর কাঁচ দিয়ে শরীর রক্তাক্ত করে প্রতিবাদসহ বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম দেয়া যশোর পুলেরহাট শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রটি (বালক)। ৩০০ আসনের বিপরীতে ৯৫৬ জন নিবাসী নিয়ে কষ্ট ও যন্ত্রণায় কাটছে তারা। এক কাত হয়ে ঘুমানো, নি¤œমানে খাবার, আর বড় ভাইদের জাঁতাকলে পিষ্ট এখানকার নিবাসীরা। সম্প্রতি জামিনে বেরিয়ে আসা এক কিশোর কষ্ট ও যন্ত্রণায় কথা জানান। এ কথা সে জানায়, এখানকার নিবাসীরা কষ্টে আছে। ১৯৯৫ সালে ৫.২২ একর জমির ওপর যশোরের পুলেরহাটে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র (বালক) প্রতিষ্ঠান করা হয়।
এ ব্যাপারে এই কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক মো. মঞ্জুরুল হাছান জনকণ্ঠকে জানান, এসব অপ্রীতিকর ঘটনায় বিভাগীয় মামলা হয়েছে। পুলিশের এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করেছেন। তিনজনের মৃত্যুর ঘটনায় বিচার চলছে। এই ঘটনার পর আমি দায়িত্ব নিয়েছি। এর পর আর কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। আমি চেষ্টা করে আগের অবস্থান থেকে ভালো পরিবেশ ফিরিয়ে এনেছি। এখানে আবাসন সমস্যা ও খাবারের মান তেমন ভালো না। বর্তমানে প্রতিমাসে ৩৭শ’ টাকা বরাদ্দ ধরা হয়েছে।
এক মাস আগে খাবারে ৫ হাজার টাকা বৃদ্ধির জন্য সমাজ সেবা অধিদপ্তরের পরিচালক প্রতিষ্ঠানের কাছে লিখিতভাবে আবেদন করা হয়েছে। আশাকরি খুব শীঘ্রই এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন হবে। তিনি স্বীকার করেন, এখানে দুইটি তিনতলা আবাসিক ভবনে ৩০০ আসনের বিপরীতে ৯৫৬ জন নিবাসী রয়েছে। তিনগুণের বেশি নিবাসী এখানে কষ্টে থাকছেন। এখানে হত্যা মামলার আসামি রয়েছে ২০০ জনের ওপরে। তারপর নারী নির্যাতন ও মাদক মামলার আসামি রয়েছে প্রায় ৪শ’ জন। হেফাজতের নেতাকর্মীরা কুষ্টিয়ার বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্য ভাংচুরের বহুল আলোচিত ঘটনার দুই জন আসামি এখানে রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, গত ১৪ ফেব্রুয়ারি যশোর পুলেরহাট উন্নয়ন কেন্দ্রে নিজ ব্যারাকে ফ্যানের সঙ্গে গামছা পেঁচিয়ে জহুরুল ইসলাম নামে কিশোর নিবাসী আত্মহত্যা করে। যশোর কোতায়ালি থানা পুলিশ জানায়, পাবনা জেলার আতাইকুলা থানার একটি হত্যার মামলা আসামি ছিল জহুরুল। গত বছর ৩০ নভেম্বর সে এই কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে আসে।
নিরাপত্তাকারীদের কা- ॥ ২০১৯ সালের জুনের শেষ সপ্তাহে পুলিশী হেফাজতে থাকা অবস্থায় কিশোরী ধর্ষণের ঘটনায় দুই পুলিশসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়।
এক কিশোরী অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার ঘটনায় পুলিশের দুই সদস্যসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা হয়। সে সময়ের গাজীপুরের শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের (বালিকা) তত্ত্বাবধায়ক তাসনিম ফেরদৌসী বাদী হয়ে রাজধানীর কোতোয়ালি থানায় মামলাটি করেছিলেন। ২০২০ সালের মার্চে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের সামনে পুলিশই সিগারেট এনে ধরিয়ে দিয়েছিল টঙ্গী উন্নয়ন কেন্দ্রের দুই কিশোরকে। এই দুই কিশোর হাজিরা দিতে এসেছিল সেদিন। ২০১৭ সালে আকস্মিকভাবে পরিদর্শনে গেলে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্রকে কাছে পেয়ে টঙ্গী ও কোনাবাড়ী শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের শিশুরা খাবারের মান ভালো নাসহ বিভিন্ন সমস্যার কথা জানিয়েছিল।
শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোতে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছেই ॥ ২০২০ সালের ১৪ আগস্ট যশোর পুলেরহাট শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের ভেতরে কর্মচারীদের নির্মম পিটুনিতে তিন শিশুর মৃত্যু হয়। এ সময় ১৫ জন কিশোর আহত হয়। আহত কিশোররা বলছিল, কেন্দ্রের আনসার সদস্যরা তাদের ১৮ জনকে বেঁধে পেটানোর কারণেই এমনটা হয়েছে। এ নিয়ে দেশ জুড়ে তোলপাড় হয়। একসঙ্গে নিহত হওয়ার ঘটনা এটি প্রথম ছিল। ঘটনার পর পুলিশ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে। ঘটনা ঘটার পর হাইকোর্টের নির্দেশনা, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
ঘটনার পর সমাজসেবা অধিদপ্তর, যশোর জেলা প্রশাসন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন তথ্যানুসন্ধানে কমিটি গঠন করে তদন্ত করছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরে ২৯ বছর ধরে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালনকারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দুর্ঘটনা আগেও ঘটেছে। তবে কেন্দ্রের ভেতরে তিন শিশুর নিহত হওয়ার মতো ঘটনা এবারই প্রথম ঘটেছে, যা খুবই দুঃখজনক ও অনভিপ্রেত।
২০১৪ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে যশোরের শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের ১৫ কিশোর কাঁচ দিয়ে শরীর চিড়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। তারা কেন্দ্রের কয়েকটি ভবনের জানালার কাঁচ ভাঙচুর করে। পরে সীমানাপ্রাচীরের গায়ে থাকা পানির পুরোনো পাইপ বেয়ে পালিয়ে গিয়েছিল ছয় কিশোর। তারা সবাই খুনের মামলায় আদালতের মাধ্যমে এই কেন্দ্রে এসেছিল। ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে টঙ্গীর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের ২০ কিশোর আত্মঘাতী প্রতিবাদ করেছিল। টঙ্গী কেন্দ্রের শিশুরা আবার সংবাদের শিরোনাম হয় ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে।
খাবার না দেওয়া ও নির্যাতনের প্রতিবাদে কেন্দ্রের পাঁচ কিশোর নিজেদের শরীর কেটে ক্ষতবিক্ষত করে। ক্ষতস্থানে সেলাই দিতে হয়েছিল। ২০১৫ সালের জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে যশোরের কেন্দ্র থেকে শিপন (১৫) নামের এক কিশোর পালিয়ে যায়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিটি ঘটনায় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কমিটি গঠন, দায়ী ব্যক্তিদের সাময়িক বরখাস্তসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছিল। তবে ঘটনা থামেনি। কেন্দ্রগুলো সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সীমিত বাজেট, প্রশাসনিক দুর্বলতা, অপর্যাপ্ত জনবল, অনুন্নত সংশোধন প্রক্রিয়া, পুনর্বাসন কার্যক্রমসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিয়ে কেন্দ্রগুলো পরিচালিত হচ্ছে। এর ফলে একের পর এক ঘটনা ঘটেই চলছে এই তিনটি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে।
১৯৯৫ সালে যশোরের কেন্দ্রটির নাম ছিল ‘কিশোর অপরাধী সংশোধন প্রতিষ্ঠান’। ২০০২ সালে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র এবং ২০১৭ সালে তার নামকরণ করা হয় শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র। কেন্দ্রটিতে অনুমোদিত পদ ৪৯, এর মধ্যে বর্তমানে বিভিন্ন পদে কর্মরত ২৬ জন। সহকারী তত্ত্বাবধায়ক, প্রসিকিউশন অফিসার, সোশ্যাল কেস ওয়ার্কার, হাউস প্যারেন্টসহ ২৩টি পদই শূন্য। কেন্দ্রের শিশুদের জন্য মাথাপিছু মাসিক বরাদ্দ ৩ হাজার ৭০০ টাকা। এর মধ্যে খাদ্য ও জ্বালানি বাবদ ২ হাজার ৫০০ টাকা বরাদ্দ। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ২০০ টাকা। চিকিৎসায় বরাদ্দ ১০০ টাকা। প্রশিক্ষণে ১৫০ টাকা, পোশাক ৩০০ টাকা, তেল, সাবানসহ অন্যান্য খাতে বরাদ্দ ২৫০ টাকা। চলতি বছর অক্টোবরে যশোর পুলেরহাট শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের (বালক) খাবারের বরাদ্দ ৫ হাজার করার জন্য লিখিত আবেদন করা হয়েছে সমাজ সেবা অধিদপ্তরের পরিচালক প্রতিষ্ঠানে।
সম্প্রতি জামিনে আসা এক কিশোরের অভিজ্ঞতা ॥ তরুণী হত্যার মামলার আসামি পুরান ঢাকার বাসিন্দা এক কিশোর। ওই কিশোর প্রায় তিন মাসের বেশি সময় টঙ্গী শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে ছিল। তিনি জামিনে আছেন। মুঠোফোনে ওই কিশোর জানায়, কেন্দ্রে থাকা একটু বেশি বয়সীদের মধ্য থেকে হাউস ক্যাপ্টেন ঠিক করে দেন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক। কেন্দ্রের ভাষায় ক্যাপ্টেন বা বড় ভাই নামে পরিচিত। সেই বড় ভাই তার পছন্দের নিবাসীদের নিয়ে একাধিক দল গঠন করে। জুনিয়র ব্যাচ, সিনিয়র ব্যাচ, চৌকি পাস (কয়েকটি তোশক দিয়ে বানানো), বাকেট পাস (পানির ড্রামে বসার যোগ্যতা অর্জনকারী), রিমোট পাসসহ বিভিন্ন নামের দল গঠন করে। এরা বড় ভাইয়ের বডিগার্ড হিসেবে পরিচিত। অনেক ক্ষমতাশালী। বিভিন্ন ফ্লোরে রাজত্ব কায়েম করে তারা। ওই কিশোররা শুনেছেন, কেন্দ্রের ভেতরে বিভিন্ন সময়ই অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে।
ওই কিশোর জানায়, কেন্দ্রে নতুন সদস্য গেলে তাকে ‘পাবলিক’ বলে ডাকা হয়। বড় ভাইয়ের নির্দেশনায়, পাবলিককে ৩৬৫টি নিয়ম মানতে হয়। প্রথমে বড় ভাইয়ের চোখের দিকে তাকানো যাবে না। তিনি বারান্দায় হাঁটলে নিবাসীদের ঘরের মধ্যে থাকতে হবে। বের হতে পারবে না। এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে গামছা ভিজিয়ে গুটলি পাকিয়ে নির্ধারিত ১৪৪টি মার খেতে হয় তাকে। সে জানায়, ৩৬৫টা নিয়ম কারও পক্ষে মানা সম্ভব নয়। তাই সব পাবলিককে মাইর খাইতে হয়। এই কিশোরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ১০ বছরের কম বয়সীদের একসঙ্গে রাখা হয়।
আর ১০ বছরের বেশি বয়সীদের আলাদা ফ্লোরে রাখা হয়। বড় ভাই ও ভাইয়ের অনুগত সদস্যদের থাকার জায়গা ‘হাইফাই’ থাকে। অনেকে নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে বড় ভাইকে টাকা দিয়ে তার বডিগার্ড হিসেবেও নিয়োগ পায়। তারা বড় ভাইকে ম্যানেজ করে বাইরে থেকে জিনিস এনে কক্ষে বসে খেতে পারে। বড় ভাই নির্দেশে কেন্দ্রের গার্ড ও কর্মচারীরা বাইরে থেকে যে কোনো জিনিস উন্নয়ন কেন্দ্রের আবাসনে আনাতে পারে। খাবারের প্লেটে নির্দিষ্ট পরিমাণ ভাত দেয়া হয়। এতে নিবাসীদের পেট ভরে না। মেনু অনুযায়ী গরুর মাংস, মুরগি, সবজি, শুঁটকি, দুধ, ডিমসহ অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য দেয়া হয়।
তবে হাউস ক্যাপ্টেন সবার প্লেট থেকে মুরগির রান, মাছের বড় পিস তুলে নিয়ে যায়। ফলে নিবাসীদের গরুর বড় টুকরা, মুরগির রানসহ উন্নতমানের খাবার জোটে না। গোসলের জন্য সাবানসহ বরাদ্দ করা অন্যান্য জিনিসের ক্ষেত্রে একই অবস্থা। ওই কিশোর জানায়, কেন্দ্রের পানি খুব খারাপ ও নোংরা। এজন্য অধিকাংশ নিবাসী শরীরে খোস পাঁচড়া (চুলকানি) হয়েছে। তবে গুরুতর আহত বা সমস্যা না হলে চিকিৎসকের দেখা মেলে না।