ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

হিজরতের নামে নিরুদ্দেশ ৪ জনসহ গ্রেফতার ৭

ঘরছাড়া তরুণদের ভোলার চরাঞ্চলে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২৩:৫৮, ৬ অক্টোবর ২০২২

ঘরছাড়া তরুণদের ভোলার চরাঞ্চলে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়

জঙ্গী সম্পৃক্ততায় র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার সাতজন

নব্য জেএমবির মতো জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ সমমনারা ফিরছে একটি নতুন প্লাটফর্মে। ২০১৭ সাল থেকে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামে নতুন প্লাটফর্ম যাত্রা শুরু করে। এতে নব্য জেএমবিসহ অধিকাংশ জঙ্গী সংগঠনের নেতাকর্মী এবং জামিন নিয়ে পলাতক জঙ্গীরা এই প্লাটফর্ম গঠন করে। এর পর থেকে তরুণদের জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ করে নতুন এই জঙ্গী সংগঠনে ভেড়ানোর চেষ্টা শুরু হয়। ঘরছাড়া তরুণদের ভোলার চরাঞ্চলে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।

সম্প্রতি জঙ্গীবাদে জড়িয়ে কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বাড়ি ছেড়ে যাওয়া চারজনসহ মোট সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছে, হোসাইন আহম্মদ (৩৩), নেছার উদ্দিন ওরফে উমায়ের (৩৪), বণি আমিন (২৭) ও চার নিরুদ্দেশ তরুণ ইমতিয়াজ আহমেদ রিফাত (১৯), হাসিবুল ইসলাম (২০), রোমান শিকদার (২৪) ও সাবিত (১৯)। শুক্রবার রাতে র‌্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-১১ এর অভিযানে মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়।

এ সময় তাদের কাছ থেকে নব্য জঙ্গি সংগঠনের প্রচারপত্র, বিস্ফোরক তৈরির নির্দেশিকা, নব্য জঙ্গি সংগঠনের কর্মপদ্ধতি, উগ্রবাদী বই, জিহাদী ভিডিও সম্বলিত একটি ট্যাব উদ্ধার করা হয়। বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব তথ্য জানান।
তিনি জানান, সম্প্রতি কুমিল্লা ও অন্য অঞ্চল থেকে বাড়ি ছেড়ে কথিত হিজরত করে অর্ধশতাধিক যুবক। যাদের মোটিভেশন, প্রশিক্ষণসহ সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণে নেতৃত্ব দিচ্ছেন জেএমবি, নব্য জেএমবি, হিজবুত তাহরীরসহ অন্যান্য নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন থেকে আসা নেতৃস্থানীয়রা।
র‌্যাবের মুখপাত্র বলেন, গত ২৩ আগস্ট কুমিল্লা সদর এলাকা থেকে আট তরুণ নিখোঁজ হয়। ওই ঘটনায় গত ২৫ আগস্ট কুমিল্লার কোতোয়ালি থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়। র‌্যাব নিখোঁজের ঘটনায় ভুক্তভোগীদের উদ্ধারে ও জড়িতদের গ্রেফতারে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ আট তরুণের মধ্যে শারতাজ ইসলাম নিলয় (২২) নামের তরুণ গত ১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কল্যাণপুরের নিজ বাড়িতে ফিরে আসে। র‌্যাব ফিরে আসা নিলয়কে তার পরিবারের হেফাজতে রেখে নিখোঁজ বাকি সাত সদস্য ও জড়িতদের গ্রেফতার করে।
কমান্ডার খন্দকার মঈন জানান, গত ২৩ আগস্ট সকাল ১০টায় কুমিল্লা থেকে নিলয়সহ নিখোঁজ পাঁচ তরুণ কুমিল্লা টাউন হল এলাকা থেকে সোহেলের নির্দেশনায় দুই ভাগ হয়ে লাকসাম রেলক্রসিংয়ের কাছে হাউজিং এস্টেট এলাকার উদ্দেশে যাত্রা করে। সেখান থেকে তাদের অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি লাকসামের একটি বাড়িতে নিয়ে যান। সেখান থেকে নিলয়, নিহাল, সামি ও শিথিলকে কুমিল্লা শহরের একটি মাদ্রাসার মালিক নিয়ামত উল্লাহর কাছে পৌঁছে দেয় সোহেল।
তার তত্ত্বাবধানে একদিন থাকার পর সোহেল চার জনকে নিয়ে ঢাকায় আসেন এবং নিহাল, সামি ও শিথিলকে অজ্ঞাত ব্যক্তির কাছে বুঝিয়ে দিয়ে নিলয়কে পটুয়াখালীর একটি লঞ্চের টিকেট কেটে পটুয়াখালীতে পাঠায়। পটুয়াখালীতে গ্রেফতারকৃত বনি আমিন নিলয়কে গ্রহণ করে স্থানীয় এক মাদ্রাসায় নিয়ে যায়। গ্রেফতারকৃত হুসাইন ও নেছার ওরফে উমায়েরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। বনি আমিন নিলয়কে তিনদিন তার বাসায় রাখে। তার বাসায় অতিথি আসায় পরে নিলয়কে হুসাইনের মাদ্রাসায় রেখে আসে।

নিলয় মাদ্রাসা থেকে পালিয়ে গত ১ সেপ্টেম্বর কল্যাণপুরে নিজ বাড়িতে ফিরে আসে। পরে নিলয়ের দেয়া তথ্যমতে বনি আমিন, নেছার উদ্দিন ওরফে উমায়েরকে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক থেকে, হুসাইন আহমদ, রিফাত, হাসিব, রোমান শিকদার ও সাবিতকে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা জানায়, হাসিব ও রিফাত এক বছর আগে কুমিল্লার কোবা মসজিদের ইমাম হাবিবুল্লাহর কাছে সংগঠনের বিষয়ে প্রাথমিকভাবে ধারণা পায়। হাবিবুল্লাহ তাদের উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ করে ফাহিম ওরফে হাঞ্জালার কাছে নিয়ে যায়। ফাহিম তাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে মুসলমানদের ওপর নির্যাতনসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাত্ত্বিক জ্ঞান দেয়। এভাবে তাদের সশস্ত্র হামলার প্রস্তুতি নিতে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিষয়ে আগ্রহী করে তোলে।

গ্রেফতারকৃত রোমান স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য ৪০ দিন আগে নিরুদ্দেশ হয় এবং গ্রেফতারকৃত সাবিত দুই মাস আগে পটুয়াখালী থেকে নিখোঁজ হয়।
র‌্যাবের মুখপাত্র জানান, সোহেলের তত্ত্বাবধানে কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ হওয়া তরুণদের সশস্ত্র হামলার প্রস্তুতির জন্য প্রশিক্ষণ নিতে পটুয়াখালী ও ভোলাসহ বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হয়। নিরুদ্দেশ হওয়া তরুণদের বিভিন্ন সেফ হাউজে রেখে পটুয়াখালী এলাকার সিরাজ ওরফে রবির তত্ত্বাবধানে পটুয়াখালী ও ভোলার বিভিন্ন চর এলাকায় সশস্ত্র হামলা, বোমা তৈরি, শারীরিক কসরত ও জঙ্গীবাদ বিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।

গ্রেফতারকৃত হোসাইন আহম্মদ পটুয়াখালীর একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। নিষিদ্ধ বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠন থেকে কিছু সদস্যকে একীভূত করে ২০১৭ সালে এই নব্য জঙ্গী সংগঠনের কার্যক্রম শুরু হয়। পরে ২০১৯ সালে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ (পূর্বাঞ্চলীয় হিন্দের জামাতুল আনসার) হিসেবে সংগঠনটির নামকরণ করা হয়।
এক প্রশ্নের জবাবে র‌্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন জানান, বাংলাদেশের নিষিদ্ধ সংগঠন, বিশেষত জেএমবি, আনসার আল ইসলাম এবং হুজি’র বিভিন্ন পর্যায়ের কিছু নেতা ও কর্মী একত্রিত হয়ে এই উগ্রবাদী জঙ্গী সংগঠনের কার্যক্রম শুরু করে। গ্রেফতারকৃত হোসাইন সংগঠনের জন্য সদস্য সংগ্রহ ও তত্ত্বাবধান, তাত্ত্বিক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে সদস্যদের সশস্ত্র হামলার বিষয়ে প্রস্তুত করে তুলতেন। তিনি ২০১৪-১৫ সালে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় অধ্যয়নকালে সিরাজ নামক এক ব্যক্তির মাধ্যমে উগ্রবাদে অনুপ্রাণিত হন। এখন পর্যন্ত ১৫-২০ জন সদস্য সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
গ্রেফতারকৃত নেছার উদ্দিন ওরফে উমায়ের ভোলায় একটি সরকারী প্রতিষ্ঠানে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি ২০১৯ সালের আগে উগ্রবাদী কার্যক্রমে যুক্ত হন। তিনি হিজরত সদস্যদের প্রশিক্ষক ও তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। এ ছাড়া তিনি সদস্যদের বিভিন্ন তাত্ত্বিক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে সদস্যদের সশস্ত্র হামলার বিষয়ে প্রস্তুত করে তুলতেন। তিনি ৯-১০ জন সদস্যের তত্ত্বাবধান ও প্রশিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

গ্রেফতারকৃত বনি আমিন উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করে পটুয়াখালী এলাকায় কম্পিউটার সেলস এ্যান্ড সার্ভিসের ব্যবসা করে। সে সদস্যদের আশ্রয় প্রদান ও তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত ছিল। সে ২০২০ সালে হোসাইনের মাধ্যমে জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ে। সে ২২-২৫ জন সদস্যকে আশ্রয় প্রদান ও তত্ত্বাবধানে জড়িত ছিল। গ্রেফতারকৃত রিফাত কুমিল্লাতে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক ১ম বর্ষে অধ্যয়নরত ছিল। গ্রেফতারকৃত হাসিব উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে অধ্যয়নরত এবং একটি অনলাইন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল।

তারা ইমাম হাবিবুল্লাহর মাধ্যমে জঙ্গীবাদে দীক্ষিত হতে গত ২৩ আগস্ট বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়। গ্রেফতারকৃত রোমান পুর প্রকৌশল বিষয়ে ডিপ্লোমা করে গোপালগঞ্জে ইলেকট্রিক্যাল ও স্যানিটারি বিষয়ক কাজ করত। সে অনলাইনে বিভিন্ন ভিডিও দেখে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয় এবং স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে সংগঠনটি সম্পর্কে ধারণা পায়। পরে সে প্রায় এক মাস আগে বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়।

গ্রেফতারকৃত সাবিত উত্তরা এলাকায় প্রায় এক মাস আগে একটি ছাপাখানায় স্টোর কিপারের কাজ করত। সে তার একজন আত্মীয় ও অনলাইনে ভিডিও দেখার মাধ্যমে উগ্রবাদে অনুপ্রাণিত হয়। সে জুন মাসে ঢাকায় সিরাজের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর প্রায় দুই মাস আগে নিখোঁজ হয়।

আরেক প্রশ্নের জবাবে নিখোঁজ তরুণদের সম্পর্কে পরিবারকে তথ্য দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে র‌্যাব কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, তারা কাটআউট পদ্ধতিতে কাজ করছিল। অনেক সদস্য এখনও ধরা পড়েনি। হয়ত কেউ কেউ পরিবারে ফিরেও যেতে পারে। আমরা আত্মতুষ্টিতে ভুগছি না। আর জঙ্গী হামলা হবে না, এমনটা আমরা কখনও বলিনি। আমাদের গোয়েন্দা কার্যক্রম চলমান আছে। হিন্দুদের বড় উৎসব গেল। তেমন কিছু ঘটেনি। এই নতুন মঞ্চের দক্ষিণাঞ্চলের নেতাসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছি। এখন পর্যন্ত কতজন সদস্য সক্রিয় সে সম্পর্কে শক্ত কোন তথ্য আমরা এখনও পাইনি।
তিনি বলেন, স্টেপ টু স্টেপ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। একটি স্তর পার হওয়ার পর পরের স্তরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ঘরছাড়া তরুণদের মূলত সুপ্ত চিন্তাকে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে জঙ্গীবাদে। সশস্ত্র সংগ্রামের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে ভোলার চরাঞ্চলে। তাদের আরও নতুন নতুন প্রশিক্ষণের পরই উপরের ধাপে উত্তীর্ণ করার প্রক্রিয়া চলছিল।
কমান্ডার মঈন বলেন, বিচার বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রমের বিরুদ্ধে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ তরুণদের মোটিভেট করা হচ্ছিল। হিজরত করা তরুণদের আইসোলেশনে রেখে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধের জন্য ক্রোধ-ক্ষোভকে কাজে লাগানোই ছিল প্রথম কৌশল। আমরা নতুন এই সংগঠনের মধ্যম সারির বেশ কয়েকজনের নাম পেয়েছি। তারা বিভিন্ন নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন থেকে এখানে এসে নেতৃত্বে গেছে। তাদের গ্রেফতার করতে অভিযান চলছে। এই সংগঠন নিষিদ্ধ নয়, অন্য সংগঠনের চেয়ে এটা শক্তিশালী। তারাই মূলত মানিয়ে চলার জন্য পেশাদারি ও কারিগরি প্রশিক্ষণের পাশাপাশি সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়েছে।

×