ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

নাগরিক দুর্ভোগ ॥ ৬৮ শতাংশ বাসের দরজা জানালা ভাঙ্গা

ঢাকার অধিকাংশ বাস লক্কড়ঝক্কড়

ইবরাহীম মাহমুদ আকাশ

প্রকাশিত: ২৩:২৯, ৫ অক্টোবর ২০২২; আপডেট: ১৭:৪৮, ৬ অক্টোবর ২০২২

ঢাকার অধিকাংশ বাস লক্কড়ঝক্কড়

লক্কড়ঝক্কড় ও ফিটনেসবিহীন বাস-মিনিবাস দিয়ে চলছে ঢাকা মহানগরীর

লক্কড়ঝক্কড় ও ফিটনেসবিহীন বাস-মিনিবাস দিয়ে চলছে ঢাকা মহানগরীর অভ্যন্তরীণ বাস সার্ভিস। অনেক বাস চলছে রুট পারমিট ছাড়াই। অনুমোদিত বাস কোম্পানিগুলো চলছে না নির্ধারিত রুটে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে অনেক রুটে বাস পাচ্ছে না যাত্রীরা। আবার কোন কোন রুটে নোংরা সিট ও লক্কড়ঝক্কড় বাসে গাদাগাদি করে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। তাই ঢাকা মহানগরীর গণপরিবহন চলাচল করতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় বলে যাত্রীরা জানান।   
একশ্রেণীর মালিক ও শ্রমিক পরিবহন সেক্টরকে জিম্মি করে রাখার কারণে এই হ-য-ব-র-ল অবস্থা হয়েছে বলে মনে করে গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর আরএসটিপি’র পরিকল্পনাগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের পরামর্শ তাদের।  
ঢাকা মহানগরীতে সবচেয়ে নোংরা সিট ও লক্কড়ঝক্কড় পরিবহন সার্ভিস হলো যাত্রাবাড়ী-গাবতলী রুটে চলাচলকারী গাবতলী এক্সপ্রেস কোম্পানির বাস। এই কোম্পানির বাসগুলো মূলত সাভারের ইপিজেড থেকে নারায়ণগঞ্জের লিংক রোড (সাইনবোর্ড) পর্যন্ত চলাচলের জন্য এ-১৯০ রুটের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এই বাসগুলো গাবতলী-যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত চলাচল করে। সাভারের ইপিজেড ও নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড যায় না। যাত্রাবাড়ী থেকে গাবতলী যাওয়ার পর সাভারের যাত্রীদের নামিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু পুরো রুটের ভাড়া নেয়া হয় বলে যাত্রীরা জানান।
যাত্রাবাড়ী এলাকায় আনোয়ার নামের এক যাত্রী জনকণ্ঠকে বলেন, ‘ঢাকা শহরে যতগুলো বাস আছে এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ বাস হলো এই গাবতলী পরিবহন। এই বাসের সিটগুলো ছেঁড়া ও নোংরা। বাসের বডি লক্কড়ঝক্কড়। গাদাগাদি করে যাত্রী পরিবহন করা হয়। বাসে দাঁড়ানোর মতো কোন অবস্থা থাকে না। বাসের ভিতরে কোন ফ্যান থাকে না। দুই-একটি বাসে থাকলেও তাও নষ্ট থাকে বেশির ভাগ সময়।’

একটি দেশের রাজধানীতে এ রকম বাস চলতে দেয়া একদম ঠিক না বলে জানান আমিনুল ইসলাম নামের অপর এক যাত্রী। আমিন জনকণ্ঠকে বলেন, ‘ভাই ঢাকা শহরে লোকাল বাসগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। বেশির ভাগ বাসের ফিটনেস নেই। গায়ের রং তো দূরের কথা ভিতরের অবস্থা আরও খারাপ। বাসের জানালাও ঠিক  নেই। গ্লাস ভাঙ্গা। এক পাশ থেকে অপর পাশে নড়ানো যায় না। সিটগুলো নড়বড়ে। ৩৬ সিটের বাসে বসানো হয়েছে ৪৬ সিট। এ কারণে এই সিটে পা ভাঁজ করে বসা যায় না। এসব বিষয় দেখার কেউ নেই।’  
ঢাকা শহরে ফ্লাইওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও মেট্রোরেলসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ হলেও গণপরিবহনের চেহারা ঠিক আগের মতো রয়েছে। কোন পরিবর্তন নেই এই গণপরিবহন সেক্টরে। চার বছর আগে ‘আকাশ পরিবহন’ নামের একটি বাস কোম্পানি চালু হয় সদরঘাট-রামপুরা-উত্তরা-দিয়াবাড়ী রুটে। চালুর পর এখন পর্যন্ত বাসের বডিতে কোন রং করা হয়নি বলে জানান মিলন নামের ওই বাসের হেলপার।
তিনি বলেন, ‘চার বছর যাবত একই অবস্থায় চলছে। মালিকরা শুধু টাকা চেনে। মাঝে-মধ্যে ইঞ্জিনের কাজ করাতে গ্যারেজে নেয়। কিন্তু বাসের বডিতে তেমন রং-টং করে না। কারণ ঢাকার যে রাস্তা রং করলে এক সপ্তাহও থাকে না। এক মাস ধরে বলেও একটা ফ্যান ঠিক করাতে পারি না। ঢাকায় যেসব গাড়ি চলে একটারও ব্যাক লাইট নেই। বাসে বাসে ধাক্কাধাক্কি করে এসব লাইট ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। এ ছাড়া ট্রাফিক পুলিশ ও লাইনম্যানের লাঠির বাড়িতে বডির এই অবস্থা তৈরি হয়েছে বলে জানান তিনি।
সারাদেশে দুই লাখের বেশি যানবাহনের ফিটনেস সনদ নেই ॥ বিআরটিএর তথ্যমতে, ঢাকা মহানগরীতে চলমান বাস-মিনিবাসের মধ্যে প্রায় ৬৮ শতাংশের দরজা-জানালা ভাঙ্গা। বসার সিট ছেঁড়া, ভাঙ্গা ৫২ শতাংশের ও বাইরের কাঠামো ভাঙ্গাচোরা ৬০ শতাংশের। দুই স্তরের কাঠামো (স্টিল ও ফোম/কাপড়) নেই ৮০ শতাংশ বাস-মিনিবাসের। যেসব বাসে স্টিলের কাঠামোর ভেতর ফোম বা কাপড়ের স্তর আছে সেগুলোরও অধিকাংশ ছেঁড়া। এ ছাড়া রাজধানীর অধিকাংশ বাসের পিছনের সিগনালিং লাইটগুলো অকেজো। কিছু কিছু বাস-মিনিবাসে পাখা থাকলেও বেশিরভাগ নষ্ট থাকে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।
বিআরটিএ’র এক সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, রাজধানীতে চলাচলকারী প্রায় সাড়ে তিন হাজার বাস-মিনিবাসের মধ্যে অর্ধেকের বেশির অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল (২০ বছর) পেরিয়ে গেছে। সব মিলিয়ে রাজধানীতে চলাচলকারী ৮৭ শতাংশ বাস-মিনিবাসই ফিটনেসবিহীন। এখনও সারা দেশে পৌনে দুই লাখের বেশি যানবাহন চলছে চলাচলের উপযোগী সনদ (ফিটনেস সনদ) ছাড়াই।
বিআরটিএর তথ্যমতে, ২০১১ সালের জুনে রাজধানীতে মিনিবাস নিবন্ধন না দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। এর পর আর কোন নতুন মিনিবাস রাজধানীতে নামেনি। গত ১১ বছরে বেসরকারী খাতে নতুন কোন বড় বাসও নামেনি। বিআরটিসি বেশকিছু বাস নামালেও অনেকগুলোই অকেজো হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া বর্তমানে রাজধানীতে ৯২টি কোম্পানির বাস সার্ভিস রয়েছে। তিন বছরে বন্ধ হয়ে গেছে ২৭টি কোম্পানি।
এ ছাড়া ১৬৬ রুটের মধ্যে ১১২টিতে কোন বাস নেই। ১২টি রুটে চলছে মাত্র একটি কোম্পানির বাস। ২০১০ সালে রাজধানীতে ২০ বছরের অধিক পুরনো বাস-মিনিবাস চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়। সে সময় একবার অভিযান চালানো হলে অনেকেই পুরনো বাস-মিনিবাস বন্ধ করে রাখে। অভিযানশেষে আবারও নামানো হয় পুরনো, ফিটনেসবিহীন বাস-মিনিবাস। তাই গত চার বছরে এসব গাড়ির বিরুদ্ধে আর অভিযান চালানো হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
এ বিষয়ে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নূরী জনকণ্ঠকে বলেন, ‘ঢাকা শহরের সব ফিটনেসবিহীন ও লক্কড়ঝক্কড় গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আমরা গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করব। এতে সচেতনতার জন্য দুই মাসের সময় দেয়া হবে। এর মধ্যে যদি বন্ধ না হয় তাহলে অভিযান চালিয়ে সব গাড়ি উঠিয়ে দেয়া হবে। এক্ষেত্রে মিডিয়ার সহায়তার দরকার হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে এসব ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় বলে জানান তিনি।’
গাড়ির ফিটনেসে ৫৯টি বিষয় দেখা হয় ॥ ব্যক্তিগত গাড়ি ছাড়া সব বাণিজ্যিক গাড়ির ফিটনেস সনদের মেয়াদ এক বছর। শুধু প্রাইভেটকার ও জীপসহ ব্যক্তিগত গাড়ির ফিটনেসের মেয়াদ দুই বছর। যেকোন গাড়ির ফিটনেস দেয়ার ক্ষেত্রে ৫৯টি বিষয় দেখা হয়। এসব বিষয় পুরোপুরি যাচাই করলে সারাদেশের প্রায় ৯০ শতাংশ গাড়ি ফিটনেস পাবে না বলে বিআরটিএর কর্মকর্তারা জানান। তবে ন্যূনতম বিষয়গুলো অবশ্যই দেখা হয় বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

ফিটনেসের সময় যে বিষয়গুলো দেখা হয় সেগুলো হলো-গাড়ির পরিচয়, ইঞ্জিনের পাওয়ার ইউনিট, চালকের সিটের অবস্থা, বডির নিরাপত্তা, জানালার নিরাপত্তা ও অবস্থা, ইঞ্জিনের সক্ষমতা, ধোঁয়া নির্গমন, চাকা এবং হুড, আকার এবং টায়ারের ধরন, টায়ারের অবস্থা, বাম্পার বার, অতিরিক্ত চাকা বহন, গাড়ি নকশা অনুযায়ী ট্রেলার কাপলিং, চাকার অবস্থা, ড্রাইভারের অবস্থান এবং পদক্ষেপ, প্রবেশের দরজা/ফ্ল্যাপ, লাগেজ বগিসহ বডির বাইরের অংশ, বাসের অভ্যন্তর এবং যাত্রী আসন, প্রবেশ এবং প্রস্থান ধরন এবং প্ল্যাটফর্ম, লুকিং গ্লাস অবস্থা, সামনের নির্দেশনা, অন্যান্য স্বচ্ছ উপকরণ, চালককে বাতাস হতে রক্ষা, উইন্ডস্ক্রিন ওয়াশার, স্পিডোমিটার এবং স্পিড গভর্নর, শ্রবণযোগ্য সতর্কতা, চালকের নিয়ন্ত্রণ, টেকোগ্রাফ, স্টিয়ারিং হুইল, স্টিয়ারিং কলাম, চাপ/ ভ্যাকুয়াম সতর্কতা, বিল্ড আপ চাপ/ভ্যাকুয়াম, হাতের নিয়ন্ত্রণে যন্ত্রাংশ ঠিক রাখা, হ্যান্ড লিভার যান্ত্রিক ব্রেকিং সিস্টেম নিয়ন্ত্রণ করে, পায়ের ব্রেক ঠিক রাখা, ব্রেক ঠিকমতো কাজ করে কি না, যানবাহনের ব্রেক হাত দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা, হ্যান্ড লিভার যান্ত্রিক ব্রেকিং সিস্টেম নিয়ন্ত্রণ করে, পায়ের ব্রেক ঠিক রাখা, ব্রেক ঠিকমতো কাজ করে কি না, চ্যাসিসের অবস্থা, বৈদ্যুতিক তারের এবং সরঞ্জাম, ইঞ্জিন এবং ট্রান্সমিশন মাউন্টিং, তেল এবং বর্জ্য ফুটো, জ্বালানি ট্যাংক এবং সিস্টেম, নিষ্কাশন এবং বর্জ্য সিস্টেম, সাসপেনশন লিঙ্কেজ এবং পিভট, বসন্ত ইউনিট, স্টিয়ারিং লিঙ্কেজ, স্টিয়ারিং, পাওয়ার স্টিয়ারিং, ট্রান্সমিশন সিফট, অতিরিক্ত ব্রেক, ব্রেক অ্যাকুয়েটর, সামনের লাইট, পিছনের বাতি, বাধ্যতামূলক প্রতিফলক, দিক নির্দেশক, হেড ল্যাম্প, বাতি বন্ধ করণ ও ট্যাক্সি মিটার ইত্যাদি।

×