ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলামের সাক্ষাতকার

ড্যাপ বাস্তবায়নের মাধ্যমেই উন্নত দেশ বিনির্মাণ সম্ভব

-

প্রকাশিত: ২৩:১৭, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২

ড্যাপ বাস্তবায়নের মাধ্যমেই উন্নত দেশ বিনির্মাণ সম্ভব

আশরাফুল ইসলামের সাক্ষাতকার

ঢাকাকে কার্যকরী ও বাসযোগ্য মহানগরী হিসাবে গড়ে তুলতে প্রণয়ন করা হয়েছে ড্যাপ বা ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য উন্নয়ন প্রস্তাবনার কার্যকর সমন্বয়ের জন্য ‘নগর সরকার’ প্রতিষ্ঠা করা অতীব জরুরী। সেই আলোকে পরিকল্পনায় ‘মহানগর সরকার’ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়েছে।
ড্যাপের মহাপরিকল্পনায় নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্তের সাশ্রয়ী আবাসন ব্যবস্থার লক্ষ্যে পরিকল্পনায় মোট ৫৮টি এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব এলাকায় সাশ্রয়ী আবাসন পদ্ধতিতে স্বল্প আয়ের মানুষেরা সাধ্যের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী কিস্তি প্রদানের মাধ্যমে নিজস্ব আবাসের মালিক হওয়ার সুযোগ পাবেন।
এছাড়া ড্যাপে ব্লকভিত্তিক আবাসন পদ্ধতিকে বিভিন্ন প্রণোদনার মাধ্যমে বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। এই নীতিমালা কার্যকর হলে কিছু জায়গা উন্মুক্ত স্থান রাখার শর্তে স্বাভাবিক উচ্চতার চেয়ে বেশি উচ্চতার ইমারত নির্মাণ করা যাবে। পরিবেশবান্ধব শহর তৈরির লক্ষ্যে পরিকল্পনায় পাঁচটি বৃহৎ আঞ্চলিক পার্কের প্রস্তাবনা করা হয়েছে। এছাড়া ৫৫টি জলকেন্দ্রিক পার্ক, ১৩টি বৃহৎ ইকোপার্ক (ভাওয়াল বনসহ) এবং ১৩টি অন্যান্য পার্ক এবং খেলার মাঠ নির্মাণের প্রস্তাবনা করা হয়েছে।
সড়কপথ, নৌপথ এবং রেলপথকে গুরুত্ব দিয়ে এই সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। এতে ঢাকার চারদিকে মোট ১৩টি আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল এবং ২টি ট্র্যাক টার্মিনালের প্রস্তাব করা হয়েছে।
ড্যাপ বাস্তবায়ন নিয়ে দৈনিক জনকণ্ঠের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতকারে এসব তথ্য জানিয়েছেন ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)’র প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মোঃ আশরাফুল ইসলাম। তিনি বলছেন, আধুনিক নগর ব্যবস্থাপনা কৌশলের যে সকল প্রস্তাবনা ড্যাপে দেয়া হয়েছে তা বাস্তবায়নের মাধ্যমেই ২০৪১ এর উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণ সম্ভবপর হবে। গত ২৩ আগস্ট ড্যাপের গেজেট প্রকাশ করেছে সরকার। সাক্ষাতকারটি নিয়েছে জনকণ্ঠের স্টাফ রিপোর্টার ইবরাহীম মাহমুদ আকাশ।
জনকণ্ঠ : ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে এ পর্যন্ত কতগুলো পরিকল্পনা নেয়া হয়। প্রথম পরিকল্পনাটি নেয়া হয় কত সালে। পরিকল্পনাবিদের নাম কি?
আশরাফুল ইসলাম : ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে এখন পর্যন্ত ছয়টি পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম পরিকল্পনা    ঢাকা মাস্টার প্ল্যান-১৯৫৯ সাল। কমনওয়েলথের কলম্বো প্ল্যানের অধীনে ১৯৫৮ সালে ব্রিটিশ সংস্থা মিনোপ্রিও, স্পেন্সলি এবং ম্যাকফারলেন এই পরিকল্পনা তৈরি করে। দ্বিতীয় পরিকল্পনা করা হয় ১৯৮১ সালে। প্ল্যানিং কমিশন ঢাকা মেট্রোপলিটন ইনটিগ্রেটেড প্ল্যান (ডিএমএআইইউডিপি) তৈরি করে। তৃতীয় ঢাকা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান (ডিএমডিপি) স্ট্রাকচার প্ল্যান ১৯৯৫-২০১৫ এবং ডিএমডিপি আরবান এরিয়া প্ল্যান ১৯৯৫-২০০৫। চতুর্থ বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ২০১০-২০১৫। পঞ্চম ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান ২০১৬-২০৩৫। ষষ্ঠ বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) ২০২২-২০১৫। তবে ১৯১৭ সালে প্যাট্রিক গেডেস ঢাকা শহরের জন্যে একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করেন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সময়ে স্যার প্যাট্রিক গেডেসকে ঢাকা শহরের জন্য একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা সুপারিশ করার জন্য কমিশন দেয়া হয়েছিল।
জনকণ্ঠ : ওই সব পরিকল্পনাগুলো কেন বাস্তবায়ন হয়নি?
আশরাফুল ইসলাম : পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়িত না হওয়ার মূল কারণগুলো ছিল কর্তৃপক্ষের যথাযথ এবং কার্যকরী উদ্যোগের অভাব, প্রণীত পরিকল্পনা প্রতিবেদন এবং ম্যাপের ব্যাপক প্রচার উদ্যোগের অভাব, বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের উদ্যোগের অভাব, নগরের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার সাপেক্ষে পরিকল্পনায় প্রস্তাবিত নীতিকৌশলের কিছু অসামঞ্জস্য, অনুনোমোদিত নির্মাণ রোধে আইনের দুর্বল প্রয়োগ ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সম্পদের সীমাবদ্ধতা ছিল।
জনকণ্ঠ : বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) করতে কতদিন লেগেছে?
আশরাফুল ইসলাম : বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ২০২২-২০৩৫ সরকারীভাবে গেজেট আকারে প্রকাশ করতে সময় লেগেছে প্রায় সাড়ে ৭ বছর। বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ২০২২-২০৩৫ এর কাজ শুরু হয় ২০১৫ সালের মার্চে এবং সরকারী গেজেট আকারে প্রকাশিত হয় ২০২২ সালের ২৩ অক্টোবর। প্রকল্পের মেয়াদ ছিল মাত্র ২ বছরের।
জনকণ্ঠ : ড্যাপের কি কি বিষয় গুরুত্ব দেয়া হয়েছে?
আশরাফুল ইসলাম : ড্যাপে মূলত ১৪ বিষয়  গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এগুলো হলো-নিয়ন্ত্রিত মিশ্র ভূমি ব্যবহার, যোগাযোগ ব্যবস্থাপনা (সড়ক পথ, রেল পথ এবং নৌ পথ), ট্রানজিট ভিত্তিক উন্নয়ন, স্কুল ভিত্তিক জোনিং এবং স্বাস্থ্য সেবা পরিকল্পনা, নি¤œ বিত্তের জন্যে সাশ্রয়ী আবাসন, এলাকা ভিত্তিক জনঘনত্ব বিন্যাস পরিকল্পনা, প্রতিটি অঞ্চলে বৃহৎ আঞ্চলিক পার্ক নির্মাণ এবং জল ভিত্তিক বিনোদন কেন্দ্র, নগর জীবন রেখা, ব্লক ভিত্তিক উন্নয়ন, পুরান ঢাকার বিভিন্ন সাইট চিহ্নিত করে ‘আরবান রিডেভেলপমেন্ট প্রকল্প’ নেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। সংস্কৃতি ভিত্তিক শহুরে পুনর্জন্ম (সিবিইউআর) প্রক্রিয়ায় ভূমির পুনঃ উন্নয়ন কৌশল অবলম্বন করে এই এলাকায় মৌলিক সুবিধাদির ব্যবস্থা করার প্রস্তাবনা করা হয়েছে, দুর্যোগ সহনশীল ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা; মৌজাভিত্তিক নদী, খাল, পুকুরসমূহ এর ডিজিটাল ডেটাবেজ প্রস্তুত এবং যথাযথভাবে চিহ্নিত করে সংরক্ষণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে; বন্যা ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা; উন্নয়ন স্বত্ব প্রতিস্থাপন (টিডিআর)’র প্রস্তাবনা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন নির্দেশনা বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
জনকণ্ঠ : এই পরিকল্পনায় কয়টি অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত রয়েছে?
আশরাফুল ইসলাম : সমগ্র পরিকল্পনা এলাকাকে প্রথমত ৬টি প্রধান অঞ্চল বিভক্ত করে পরবর্তীতে বিভিন্ন নিয়ামকের ওপর ভিত্তি করে মোট ৭৫টি উপ-অঞ্চল ভাগ করা হয়েছে। উপ-অঞ্চল বিভাজনের নিয়ামকসমূহ হলো- এলাকার ভৌত কাঠামো; উন্নয়নের ধরন (পরিকল্পিত বা স্বতঃস্ফূর্ত এলাকা); এলাকার বিদ্যমান জনঘনত্ব; বিদ্যমান ভূমি ব্যবহার; আর্থসামাজিক অবস্থা; বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন এলাকা;  বিদ্যমান রাস্তার ঘনত্ব ও স্থাপনা ঘনত্ব বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।
জনকণ্ঠ : ডেনসিটি জোনিং কোন এলাকাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এটা কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে?
আশরাফুল ইসলাম : বাসযোগ্যতার সূচকে ঢাকা শহরের অতি নি¤œ অবস্থানের অন্যতম প্রধান কারণ অতিরিক্ত জনসংখ্যা ও অধিক জনঘনত্ব। উন্নয়ন পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় জনসংখ্যা, জনঘনত্ব এবং শহরের বিদ্যমান অবকাঠামো ও নাগরিক সুযোগ-সুবিধাদির সাপেক্ষে শহরের ভারবহন ক্ষমতা বিবেচনা না করা হলে যে কোন শহর তার বাসযোগ্যতা হারাবে। ঢাকাকে কার্যকরী ও বাসযোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (২০১৬-৩৫) এলাকাভিত্তিক জনঘনত্ব নির্ধারণের মাধ্যমে জনঘনত্ব বিন্যাস (ডেনসিটি জোনিং) পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ২০২২-২০৩৫ আওতাধীন সকল এলাকার জন্যে জনঘনত্ব বিন্যাস পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে।
জনকণ্ঠ : ব্লকভিত্তিক আবাসন পদ্ধতি কি? এটা কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে?
আশরাফুল ইসলাম : ব্লকভিত্তিক আবাসন পদ্ধতির অন্যতম উদ্দেশ্য হলো উল্লম্ব অর্থাৎ উচ্চতা সম্প্রসারণে উৎসাহিত করা, যাতে যত্রতত্র নগরাঞ্চল সম্প্রসারণ কমিয়ে আনা এবং শহরের নিচু জমি ও কৃষিজমির সুরক্ষা হয়। বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় ২০২২-২০৩৫ ব্লকভিত্তিক আবাসন পদ্ধতিকে বিভিন্ন প্রণোদনার মাধ্যমে বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। এই পদ্ধতির জন্য কয়েকটি বিষয় গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এগুলো হলো- ১. সাধারণত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্লটে কম উচ্চতা বিশিষ্ট ইমারত নির্মাণ করা যায় আবার অন্যদিকে পর্যাপ্ত উন্মুক্ত স্থান বের করা অনেক কঠিন ২. অপরদিকে, একাধিক ব্যক্তি মালিকানাধীন অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র প্লট একত্রীকরণের মাধ্যমে ব্লক পদ্ধতি অবলম্বনে ভমি ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ খরচও কমে যাবে। ৩. ব্লকভিত্তিক নীতিমালা কার্যকর হলে কিছু জায়গা উন্মুক্ত স্থান রাখার শর্তে স্বাভাবিক উচ্চতার চেয়ে বেশি উচ্চতার ইমারত নির্মাণ করতে পারবে।
জনকণ্ঠ : নগরজীবন রেখা বলতে কি বুঝানো হয়েছে? এর মধ্যে কি কি রাখা হয়েছে ?
আশরাফুল ইসলাম : ‘নগর জীবনরেখা’ যোগাযোগ ব্যবস্থার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত উন্নয়নে সাহায্য করবে। এটি ‘বহুবিধ কার্যক্রমের স্থান’ হিসেবে পরিগণিত হবে, যেখানে মানুষ হেঁটে রাস্তায় চলাচল উপভোগ করবে, পথের পাশে থাকা ব্যবসা এবং অন্যান্য কার্যক্রম আমাদের অভিজ্ঞতাকে ভিন্ন আঙ্গিকে নতুন করে তুলে ধরবে। জীবজগতের পারস্পরিক সহানুভূতি, প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং কৃত্রিম কাঠামোর মধ্যে সামঞ্জস্য, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, পরিবেশদূষণ প্রতিরোধ এবং প্রকৃতি ও মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতিতে ‘নগর জীবনরেখা’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এ ছাড়া স্থানীয় উদ্ভিদ রোপণের মাধ্যমে স্থানীয় জীববৈচিত্র্যের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে, যা খাদ্যের উৎস হিসেবেও কাজ করবে।
জনকণ্ঠ : ড্যাপে গণপরিবহন ব্যবস্থার বিষয়ে কি বলা হয়েছে? এটা কিভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব?
আশরাফুল ইসলাম : সড়কপথ, নৌপথ এবং রেলপথকে গুরুত্ব দিয়ে সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। ঢাকার সঙ্গে আশপাশের  শহরকে যুক্ত এবং যাতায়াত নির্বিঘœ করতে ৬টি মেট্রো, ২টি বিআরটি, ৬টি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা-ময়মনসিংহ রোডের সমান্তরালে ২টি প্রধান সড়ক, ২টি রিং রোড, রিং রোডের সঙ্গে সংযুক্ত রেডিয়াল রোড এবং বৃত্তাকার নৌপথের প্রস্তাব করা হয়েছে। ঢাকার চারদিকে মোট ১৩টি আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল এবং ২টি ট্র্যাক টার্মিনালের প্রস্তাব করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার, সড়ক ও জনপথ অধিদফতর, ডিটিসিএ, বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় ইত্যাদি সংস্থার সঙ্গে যথাযথ সমন্বয়ের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
জনকণ্ঠ : ড্যাপে ঢাকা শহরে বৃত্তাকার নৌ-পথের প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু নদীগুলোর যা অবস্থা তা বাস্তবায়ন সম্ভব কিনা?
আশরাফুল ইসলাম : নদীকে জীবন্ত সত্তা ফিরিয়ে দিতে দখল উচ্ছেদ এবং নাব্য ফিরিয়ে দিতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে হবে। ড্যাপে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃক প্রস্তাবিত বৃত্তাকার নৌ-পথ সমন্বয় করা হয়েছে। এই নৌ-পথ চালুর জন্য ঢাকার চারপাশে সব কালভার্ট, বক্স কালভার্ট বা নিচু সেতু ভেঙ্গে নেভিগেবল সেতু নির্মাণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই রকম ১৫টি সেতু পুনঃনির্মাণ করার সুপারিশ করা হয়েছে।
জনকণ্ঠ : ট্রান্সফার অব ডেভেলপমেন্ট রাইটস (টিডিআর) বলতে কি প্রস্তাব করা হয়েছে? এটা কিভাবে বাস্তবায়ন করা যাবে?
আশরাফুল ইসলাম : বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা এলাকার জন্য মূলত কৃষিজমি, বন্যাপ্রবাহ অঞ্চল বা সংবেদনশীল এলাকা সংরক্ষণের জন্য ট্রান্সফার অব ডেভেলপমেন্ট রাইটস (টিডিআর) এর প্রস্তাব করা হয়েছে। সহজভাবে বলতে গেলে উন্নয়ন স্বত্ব বিনিময় পদ্ধতি (টিডিআর) হলো, একজন তার উন্নয়ন স্বত্ব আরেকজনকে প্রদান করবেন এবং বিনিময়ে আর্থিকভাবে লাভবান হবেন। এটি প্রচলিত ভূমি ব্যবহার দ্বারা যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের ক্ষতিপূরণের এটি উদ্ভাবনী কৌশলমাত্র। এই উন্নয়ন স্বত্ব নিয়ে গ্রহণকারী আরও বেশি উচ্চতার স্থাপনা নির্মাণ করতে পারবেন এবং এর বিনিময়ে প্রেরণকারী উন্নয়ন স্বত্ব বিক্রির জন্য নির্ধারিত টাকা পাবেন। এভাবে উন্নয়ন স্বত্ব প্রতিস্থাপনের পদ্ধতিকে বলা হয় টিডিআর।
জনকণ্ঠ : নি¤œ ও মধ্যবিত্তদের জন্য সাশ্রয়ী আবাসন পদ্ধতি কি হতে পারে?
আশরাফুল ইসলাম : সরকারের ‘আশ্রয়ণ’ প্রকল্পসহ বিভিন্ন সময়ে নি¤œবিত্ত ও মধ্যবিত্ত জনগণের জন্য আবাসন সংস্থানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। নতুন ড্যাপে প্রস্তাবিত সাশ্রয়ী আবাসন পদ্ধতিতে স্বল্প আয়ের মানুষ সাধ্যের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী কিস্তি প্রদানের মাধ্যমে নিজস্ব আবাসের মালিক হওয়ার সুযোগ পাবেন। তাছাড়া সাশ্রয়ী হারে ভাড়াভিত্তিকভাবেও উক্ত আবাসনসমূহে বসবাসের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। নতুন ড্যাপের মহাপরিকল্পনায় নি¤œ ও নি¤œমধ্যবিত্তের সাশ্রয়ী আবাসন ব্যবস্থার লক্ষ্যে পরিকল্পনায় মোট ৫৮টি লোকেশন চিহ্নিত করা হয়েছে।
জনকণ্ঠ : বিদ্যালয়ভিত্তিক অঞ্চলের ধারণা ও স্বাস্থ্যসেবা কিভাবে বাস্তবায়ন করা যাবে?
আশরাফুল ইসলাম : এই পরিকল্পনার প্রস্তাবনা অনুযায়ী, যারা যে এলাকায় বসবাস করবে, তাদের ছেলেমেয়েরা সেই এলাকায় অবস্থিত স্কুলে ভর্তি হবে। এই ধারণাকে নগর-পরিকল্পনার ভাষায় বলা হয় বিদ্যালয়ভিত্তিক অঞ্চল ধারণা বা স্কুল ডিসট্রিক কনসেপ্ট। বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় প্রতিটি এলাকার সুষম উন্নয়নে এবং যানজট নিরসনে অঞ্চল ভিত্তিক মানসম্মত ৬২৭টি বিদ্যালয়, ২৮৫টি কলেজ এবং ২৮৭টি হাসপাতালের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া কমিউনিটি সেন্টারকে একটি কাজে ব্যবহার না করে বহুবিধ কাজে ব্যবহার করার উপযুক্ত করে তুলতে হবে। যেহেতু নগর এলাকায় জায়গার স্বল্পতা আছে, তাই দরকার হলে জমি অধিগ্রহণ করে, কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণের মাধ্যমে তা বহুবিধ কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে।
জনকণ্ঠ : বৃহৎ অঞ্চল পরিকল্পনা কি রয়েছে?
আশরাফুল ইসলাম : একটি পরিবেশবান্ধব শহরের জন্য যে পরিমাণ পার্ক, খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান থাকা দরকার, ঢাকা মহানগর অঞ্চলে (ডিএমআর) খুবই স্বল্প পরিমাণে আছে। ভৌত জরিপ থেকে দেখা যায়, ঢাকায় মোট উন্মুক্ত স্থানের পরিমাণ মোট এলাকার মাত্র শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ। যা খুবই নগণ্য। উন্মুক্ত স্থান, পার্ক, বন ইত্যাদি সবুজায়নের উদ্যোগ পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, বাস্তুতন্ত্রের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে। পরিবেশবান্ধব শহর তৈরির লক্ষ্যে পরিকল্পনায় পাঁচটি বৃহৎ আঞ্চলিক পার্ক পার্কের প্রস্তাবনা করা হয়েছে। এছাড়া ৫৫টি জলকেন্দ্রিক পার্ক, ১৩টি বৃহৎ ইকোপার্ক (ভাওয়াল বনসহ) এবং ১৩টি অন্যান্য পার্ক এবং খেলার মাঠ নির্মাণের প্রস্তাবনা করা হয়েছে।
জনকণ্ঠ : সর্বোপরি ড্যাপ বাস্তবায়নে নগর সরকার কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
আশরাফুল ইসলাম : রাজউক কখনও এই প্ল্যান এককভাবে বাস্তবায়ন করতে পারবে না। সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা এবং সকল ইউনিয়ন পরিষদ এবং এর সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে কার্যকর সমন্বয়ই পারে প্রণীত পরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়ন। আর এই সমন্বয়ক হিসাবে রাজউককেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। পরিকল্পনার প্রচার ও প্রসার ঘটাতে হবে, জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করতে হবে। রাজউক আওতাধীন এলাকার পরিকল্পনা ও উন্নয়ন প্রস্তাবনার কার্যকর সমন্বয়ের জন্য ‘নগর সরকার’ প্রতিষ্ঠা করা অতীব জরুরী। সেই আলোকে পরিকল্পনায় ‘মহানগর সরকার’ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়েছে।
জনকণ্ঠ : আমাদের সময় দেয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
আশরাফুল ইসলাম : আপনাকেও ধন্যবাদ।

×