
মুর্তজা বশীরের জন্মদিন উদ্যাপনে বৈচিত্র্যময় প্রদর্শনী
আমি জীবনভর চেষ্টা করেছি; এখন কী পেলাম সেটি আমার কাছে কিছু না। মৃত্যুর পর বেঁচে থাকব কি না, সেটি হলো আমার সাধনা। আপমি বিশ্বাস করি, এখন কী পেলাম সেটি বড় কথা নয়। চিত্রকলা হোক, সাহিত্য হোক- সময়কে অতিক্রম করে কেউ যদি সৃষ্টি করতে না পারেন, সেটি লাইফটাইম এ্যাচিভমেন্ট হবে না। মানুষ হারতে পারে, কিন্তু ধ্বংস হবে না। মৃত্যুর পর আপন সৃজনে-কর্মে এভাবেই বেঁচে থাকতে চেয়েছেন পথিকৃৎ চিত্রশিল্পী ও ভাষাসংগ্রামী মুর্তজা বশীর। তার সে লক্ষ্য পূরণ হয়েছে।
শরীরী অস্তিত্ব না থাকলেও আপন সৃষ্টির আলোয় দীপ্তিমান বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটি। চিত্রকলা থেকে লেখালেখির ভুবনে রেখেছেন অনন্য কীর্তির স্বাক্ষর। বুধবার ছিল প্রয়াত এই শিল্পীর ৯০তম জন্মদিন। শিল্পের আলোয় ভিন্নভাবে উদ্যাপিত হলো দিনটি। তাই আনুষ্ঠানিকতার বাইরে অনানুষ্ঠানিক আয়োজনটিও হয়ে ওঠে অনন্য। এই চিত্রশিল্পীর আঁকা চিত্রকর্ম, তারুণ্য থেকে বার্ধক্যের নানা সময়ের আত্মপ্রতিকৃতি, তার জীবনের বিভিন্ন সময়ের আলোকচিত্র, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের চিত্রিত চিত্রিকর্মসহ অটোগ্রাফ খাতা, সুলতানী আমলের কয়েন, নানা ধাতুতে গড়া আংটিসহ শিল্পীর সংগ্রহের নানা অনুষঙ্গ নিয়ে সজ্জিত হয়েছে প্রদর্শনীটি। ফার্মগেটের মণিপুরীপাড়ার বাসভবনে ভিন্নধর্মী প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে মুর্তজা বশীর ট্রাস্ট।
অনাড়ম্বর এ আয়োজনে এসে উপস্থিত হন মুর্তজা বশীরের বোন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা গীতি আরা সাফিয়া চৌধুরী, বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, এইচএসবিসি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান, স্থপতি আবদুল্লাহ খালিদের স্ত্রী কুলসুম খালিদ, আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন প্রমুখ। পরিবারের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন শিল্পীর দুই মেয়ে মুনীরা বশীর ও মুনিজা বশীর।
এছাড়াও মুর্তজা বশীরের সান্নিধ্যপ্রাপ্ত শুভাকাক্সক্ষীদের অনেকেই সমবেত হয়েছিলেন অনানুষ্ঠানিক জন্মদিন উদ্যাপনের এ আয়োজনে। স্মৃতিচারণের পাশাপাশি শিল্পীর বর্ণিল জীবনের মূল্যায়ন করেন তারা। এ আয়োজনে বাংলাদেশ ম্যাচ বক্স কালেক্টরস ক্লাবের উদ্যোগে পোস্ট অফিস থেকে প্রকাশিত মুর্তজা বশীরের ছবিসংবলিত স্মারক খাম তুলে দেয়া হয় তার দুই মেয়ের হাতে। স্মারক খামটি তুলে দেন দিয়াশলাই সংগ্রাহক সাকিল হক।
মতিউর রহমান বলেন, ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে রাজনীতিবিদদের অবদান অনস্বীকার্য। তবে রাজনীতিবিদদের বাইরে শিল্পীরাও দেশের আন্দোলনে বড় ভূমিকা পালন করেছেন। মুর্তজা বশীর সেই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকরা শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম। অন্যদিকে দেশে বহুমুখী প্রতিভাধর অনেকেই আছেন। শিল্পীদের মধ্যেও অনেকেই বহুমুখী প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। এই বহুমুখী প্রতিভাধর ব্যক্তিত্বদের মধ্যে মুর্তজা বশীর শ্রেষ্ঠতম।
নাসির আলী মামুন বলেন, মুর্তজা বশীর প্রয়াত হননি। তিনি এই বাড়ির দেয়ালে, কার্নিসে, নিজের পোর্ট্রেটের মধ্য দিয়ে আমাদের মধ্যে আছেন। তার সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে বেঁচে আছেন। আমাদের এখানকার গুণী মানুষেরা মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের সবকিছু নিয়ে চলে যান। এক্ষেত্রে মুর্তজা বশীর ব্যতিক্রম। তিনি সবকিছু গুছিয়ে রেখে গেছেন। সেগুলো মানুষের সামনে নিয়ে আসার যে দায়িত্ব তাঁর পরিবার নিয়েছে, আমরা তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।
মাহবুবুর রহমান বলেন, মুর্তজা বশীরের মৃত্যুর পর বেঁচে থাকার যে অন্বেষণ ছিল তাতে তিনি সফল হয়েছেন। তাঁর কাজ ও সংগ্রহের মধ্যে তিনি বেঁচে থাকবেন।
লুভা নাহিদ চৌধুরী বলেন, বাবার বন্ধু ছিলেন মুর্তজা বশীর। সেই সুবাদে ছোটবেলা থেকেই তাকে চিনি। তবে তিনি যে এত বড়মাপের একজন শিল্পী- সেই ছেলেবেলায় জানতাম না। তিনি একজন সার্থক শিল্পী। তিনি জীবনে যা কিছু করতে চেয়েছেন, তাই করতে পেরেছেন। আর এভাবে জীবনটাকে উদ্্যাপন করেছেন।
প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে ১৯৫৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মুর্তজা বশীরে আঁকা ১২০টি আত্মপ্রতিকৃতি। সেখানে নানা বয়সে, সময়ে ও পরিস্থিতি ভিন্ন ভিন্ন অভিব্যক্তিতে মেলে ধরেছেন নিজেকে। সঙ্গে রয়েছে স্ত্রী আমিনা বশীরের ১২টি প্রতিকৃতি। এর বাইরে রয়েছে পেইন্টিং, ড্রইং, লিথোগ্রাফি, কালি ও কলমের কাজ। আরো রয়েছে দুই মেয়ের প্রতিকৃতি। তার বিভিন্ন সময়ের নেয়া সাক্ষাতকারের ভিডিও চিত্র। আছে পাথর ভেঙ্গে গড়া ভাস্কর্য।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আঁকা ছবি ‘এপিটাফ অব মার্টিয়ার’। রয়েছে তার নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র চশমা থেকে টোব্যাকো পাইপ। এছাড়াও তার সংগৃহীত চাবির রিং, সুলতানী আমলের মাটির মুদ্রাসহ বিভিন সময় ও কালের সাক্ষ্যবহ কয়েন, অটোগ্রাফ বই, আলোকচিত্র, স্ট্যাম্প, নানা ধাতুতে গড়া রকমারি আংটি, তার রচিত গ্রন্থসহ নানা কিছু।
আগামী শনিবার পর্যন্ত চলবে এই প্রদর্শনী। প্রতিদিন বিকেল চারটা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত আগ্রহী দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকবে প্রদর্শনী। ঠিকানাটি হচ্ছে ফ্ল্যাট ৭/বি, শেলটেক মণিহার, ১৫৪/১ মণিপুরীপাড়া, ফার্মগেট।