আমির হোসেন আমু
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য ১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু এমপি বলেছেন, সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর সময় রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দু’একজন সদস্য ভেটো দেয়ায় তা করা সম্ভব হয়নি। বঙ্গবন্ধু হত্যা কোন ব্যক্তির হত্যার বিষয় ছিল না। আমরা কি লক্ষ্য করলাম, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর চার মূলনীতি ছুড়ে ফেলা হলো। বঙ্গবন্ধুর হত্যার সঙ্গে যারা ষড়যন্ত্র করেছিল, তাদের বিষয়ে ‘একটা তদন্ত কমিশন সময়ের দাবি।
শনিবার ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশে ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা- : অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র ও মার্কিন যোগসাজশ’ শীর্ষক ওয়ার্কার্স পার্টির জাতীয় শোক দিবসের এক আলোচনা সভায় তিনি একথা বলেন। আলোচনা সভায় ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপির সভাপতিত্ব করার কথা থাকলেও করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার কারণে তিনি আসতে পারেননি। তবে আলোচনা সভায় তার মূলপত্রটি পাঠ করেন ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য কামরুল হাসান।
আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা এমপি। আলোচনা সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, সাংবাদিক সোহরাব হাসান।
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের পক্ষে সূচনাপত্র পড়েন পলিটব্যুরোর সদস্য কামরুল আহসান। ওই পত্রে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের নেপথ্যের ষড়যন্ত্র প্রকাশ করতে ‘জাতীয় তদন্ত কমিশন’ গঠন করার দাবি করা হয়। সেখানে বলা হয়, বঙ্গবন্ধুর হত্যার পিছনে অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের বিষয়টি এখন সবার জানা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কিছু মেজর, সেনাবাহিনীর আর্টিলারি ও ল্যান্সার বাহিনী নিয়ে এই অভ্যুত্থান সংঘটিত করে। এরা বঙ্গবন্ধুর ও তার পরিবারের নৃশংস হত্যাকা-ের সঙ্গে সরাসারি জড়িত ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারে এই হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে ফাঁসির দ- দেয়া হয়েছে ও তা কার্যকর হয়েছে।
কিন্তু এর সঙ্গে যে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ছিল সে সম্পর্কে কিছু কথা বলা হলেও সেসব কুশীলবকে চিহ্নিত করা হয়নি। এবং তাদের বিচারের আওতায় আনা হয়নি। হত্যার জন্য ৭২ সাল থেকে প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট তার বাস্তবায়ন হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পিছিয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পথভ্রান্ত হয়েছে, সুতরাং বঙ্গবন্ধু হত্যা সম্পর্কে অস্পষ্টতা রেখে দেশের রাজনীতি ও রাজনৈতিক অঙ্গনকে কলঙ্কমুক্ত করা যাবে না। শঙ্কামুক্ত করা যাবে না।
১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা কোন ব্যক্তির হত্যার বিষয় ছিল না। আমরা কি লক্ষ্য করলাম, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর চার মূলনীতি ছুড়ে ফেলা হলো। বঙ্গবন্ধুর হত্যার সঙ্গে যারা ষড়যন্ত্র করেছিল তাদের বিষয়ে ‘একটা তদন্ত কমিশন সময়ের দাবি। দুই বছর আগেও আমরা বলেছি। একটা বিচার বিভাগ হোক বা গণকমিশন হোক, সেটা গঠন করে তদন্ত করে নেপথ্যের নায়কদের খুঁজে বের করা হোক।’ তিনি আরও বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সুবিধাভোগী কারা ছিল? যারা ষড়যন্ত্র করেছে? জিয়া, মোশতাক জাতীয় পার্টির কাজ সেটা পরিষ্কার করে দেয়। সেই ষড়যন্ত্র এখনও আছে।
কেননা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে ১৯ বার হত্যার চেষ্টা করেছে। ওই সময় আমাদের নেতৃত্ব কেন ঘোষণা দিতে পারল না, সে কথা আজকে বলতে চাই না। বঙ্গবন্ধু গোটা জাতিকে যোদ্ধা হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। সেজন্যই নয় মাসের মধ্যে দেশ স্বাধীন হয়েছে। ১৪ দলীয় জোটকে আরও শক্তিশালী করা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় কাজ করে যাচ্ছেন। শীঘ্রই ১৪ দলীয় জোটের কর্মসূচী দেয়া হবে।
সূচনা বক্তব্যে আরও বলা হয়, সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রে এটা সুস্পষ্ট যে, সে সময়ের সেনা উপপ্রধান জিয়াউর রহমান এই মেজরদের চক্রান্ত সম্পর্কে জানতেন। খুনী ফারুকের দেয়া সাক্ষাতকার অনুযায়ী জিয়াকে তাদের এই উদ্যোগের বিষয় অবহিত করলে তিনি তাতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেননি বা বাধাদানের কোন রকম চেষ্টা করেননি। সেনা কর্তৃপক্ষ বা সরকার কাউকে তিনি বিষয়টি অবহিত করেননি। নিজে নিরাপদ থাকার জন্য বরং ঐ মেজরদের তাকে না জড়াতে বলেন। এবং নিম্ন পর্যায়ের অফিসাররা কিছু করলে করতে পারে বলে জানান।
১৯৮১ এর ১৭ মে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা দলের হাল ধরেই তিনিই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির প্রধান এজেন্ডায় পরিণত করেন। এদিকে প্রথমে জিয়াবিরোধী দশ দল ও এরশাদবিরোধী ১৫ দল গঠিত হলে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারের বিষয়টি বিরোধী রাজনীতির অন্যতম এজেন্ডায় পরিণত হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার জাতীয় এই শোক দিবসে কেবল তার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন, মিলাদ মাহফিল, কাঙালি ভোজ ও আলোচনা সভা করেই শেষ করা ঠিক হবে না।
এ বছর জাতীয় শোক দিবসে সকল জায়গা থেকে এই জাতীয় তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি তুলতে হবে। তা না হলে দেশে যে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি মাঝেমধ্যেই দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করে, ৭ দিনের মধ্যে সরকার ফেলে দেয়ার হুঙ্কার দেয় তার স্বরূপ উন্মোচন করা যাবে না। প্রধানমন্ত্রী নিজেই এই ষড়যন্ত্রের কথা বলছেন। এখনই সময় অঙ্কুরেই তার বিনাশ সাধন। বাংলাদেশে আরেকটি ১৫ বা ২১ আগস্ট ঘটতে দেয়া যাবে না।
জাসদ সভাপতি ইনু বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকা- ছিল নিছক কোন ব্যক্তিকে হত্যা নয়। বাংলাদেশকে দ্বিতীয় পাকিস্তান বানানোর ষড়যন্ত্র। সেই কাজ জেনারেল জিয়াউর রহমান পরিকল্পিতভাবে করেছেন। এরশাদ করেছেন। সংবিধানে এখনও সাম্প্রদায়িকতা-সামরিক সরকারের ক্ষত আছে।
এগুলো ধীরে ধীরে দূর করতে হবে। দ্বিতীয় পাকিস্তান বানানোর জন্যই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যার সঙ্গে কতিপয় ব্যক্তি জাড়িত নয়। বিদেশীরাও জড়িত আছে। সেজন্য তদন্ত কমিশন হওয়া উচিত।
একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবীর বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল নায়ক জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধু হত্যার মাধ্যমে পাকিস্তানের ধারায় দেশ নেয়া হয়েছিল। যে কারণে সংবিধান সংশোধন করে জিয়া বিসমিল্লাহ বসাল মাথার উপরে। বঙ্গবন্ধু ধর্মীয় রাজনীতি বন্ধ করেছিলেন।
জিয়া সেটা আবার পুনরুদ্ধার করে। এখনও সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রয়েছে। তার মানে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি রয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ এখন সেই সংবিধান ধারণ করে কি না? ‘বঙ্গবন্ধুর আশপাশে যারা ছিলেন, ডিজিএফআই, এনএসআই, এসবি তাদের প্রধানরা সেই সময় কোথায় ছিলেন?’
সাংবাদিক সোহরাব হাসান বলেন, ‘যারা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন, তারা কিন্তু সবাই তার আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন না। যড়যন্ত্র হয়েছিল। সেই সময় বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তায় আর্মি, পুলিশ, গোয়েন্দা সদস্য যারা ছিলেন, তারা জড়িত ছিলেন কি না, তা উদ্ঘাটনে জাতীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা হোক। আবার এই তদন্তের নামে যাতে কাউকে অযথা দোষারোপ করা না হয় সেটা দেখতে হবে। এজন্য একটি আন্তর্জাতিক কমিশন করার কথা ভাবা যেতে পারে।