বগুড়ার আমরা ক’জনার একটি অনুষ্ঠানে বর্ষার কীর্তন ও গীত নৃত্যনাট্য পরিবেশনা
কীর্তনের সুর মানব মনে ভক্তি ও ভাবের সৃষ্টি করে যা মাটির গভীর থেকে উৎসারিত। তেমনি বাঙালীর হৃদয়ের লোকাচারে যত কথা যত রাগ অনুরাগ অভিমান তা গীতের মধ্যেই পাওয়া যায়। গ্রামীণ জীবনে যে কেউ মনের আঙ্গিনা থেকে মুখে মুখে গীত রচনা করতে পারে। যে কারণে একেক অঞ্চলের গীতের ভাষার বৈচিত্র্য ধারা সমৃদ্ধ হয়েছে। এই সম্পদ নিয়ে আমাদের পথ চলা। বাঙালীর এই অমূল্য সম্পদ হারিয়ে যাচ্ছে। কীর্তন ও গীত শব্দটি নানাভাবে উচ্চারিত হয়। যেমন রসরঙ্গে বলা হয়-‘কীর্তন শুরু করেছে। গীত শুরু করেছে।’
শুদ্ধ কথায় কীর্তন যতটা শক্তিশালী আঞ্চলিক বা স্থানীয় কথায় গীত ততটাই শক্তিশালী। এই দুইয়ের সূক্ষ্ম পার্থক্য হলো : কীর্তনে গুরু গম্ভীর সুরের ভক্তির সঙ্গে মনের ভাব আড়াল থাকে। গীতে মনের ভাবের উচ্ছ্বাস ঘটে নেচে গেয়ে। বাঙালীর বিয়েতে নেচে গেয়ে গীত পরিবেশন করে নারী। মেয়েদের কণ্ঠের সুরে গীত ও পুরুষের কণ্ঠের সুরে গীতি। দুইয়ে প্রাচুর্য আছে।
কীর্তন সুর মেয়েদের কণ্ঠে যতটা আকর্ষণীয় পুরুষের কণ্ঠ ততটা নয়। কীর্তন ভক্তির সঙ্গে ভাবের সংমিশ্রণে ধরণী চলে আসে।
আর ধরণী বিশে^র মানুষের মা। যে কারণে মায়ের ভক্তি মেয়ের কণ্ঠেই শক্তিশালী সুর হয়ে ওঠে। বিজ্ঞজনেরা বলেন, প্রকৃতি, ধরণী ও সৃষ্টিকে জানা ও পাঠের চেয়ে খুব সহজে কাছে পাওয়া যায় কীর্তনের সুরে। কীর্তনেই সৃষ্টির গুণাবলী বর্ণিত হয়। যেমন ‘দেখেছি রূপ সাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনায়’। যার মধ্যে লুকিয়ে আছে সৃষ্টির রূপ হৃদয়ের মানুষ যা কাঁচা সোনা।
কীর্তনের ভক্তি সুরের পাশাপাশি মানুষের মনের আবেগ উচ্ছ্বাসের আনন্দ বেদনার কথায় আপন মনেই রচিত হয় গীত। মানুষ তার অঞ্চলের ভাষায় তাৎক্ষণিক হাসি কান্না বেদনা ভাললাগা ভালবাসা দিয়ে তৈরি করে সুরের বাক্য। যা একেক অঞ্চলের একেক ভাষায় হলেও মাধুর্য ও ভাবের আদান প্রদান প্রতিটি কালে প্রতিটি স্থানে একই সুরে গাঁথা যায়।
কীর্তন গানের প্রকৃত উৎস চ-িদাস ও শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন বিদ্যাপতি। ১৫শ’ শতকে শ্রী চৈতন্য ভক্তি সঙ্গীতের এই ধারা সকলের মধ্যে জনপ্রিয়তা পায়। চৈতন্যের মৃত্যুর পর কীর্তন পাঁচটি ধারায় নামকরণ ও রূপান্তরিত হয় উৎপত্তিস্থল ও কবিদের নামানুসারে। ১৬শ’ শতকে বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার গদানহাটি পরগনার বাসিন্দা নরোত্তম দাস একটি ধারার সূচনা করেন। যা গদানহাটি নামে পরিচিতি পায়। ভারতের বীরভূম জেলার জানানদাস মনোহর্ষী ধারার প্রবক্তা। বর্ধমানের বিপ্রদাস ঘোষের আবিষ্কার রেনেটি ধারা। মান্দারনি কীর্তনের সূত্রপাত হয় ঝাড়খ-ে।
কীর্তনের ধারা সূচিত হয় বাংলাদেশের রাজশাহী ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ অঞ্চলে। কীর্তনের তিনটি তাল-দ্রুত, মধ্যম ও বিলম্বিত। তিনটি তালই বাংলা কীর্তনের সুরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কীর্তন গীতের মতো গ্রামীণ সংস্কৃতির অংশ। ১৮শ’ শতকে কলকাতা পত্তনের পর কীর্তনের সঙ্গে পাঁচালী সংযুক্ত হয়ে সংস্কৃতির বিশেষ অংশ হয়ে যায়। কবি কাজী নজরুল ইসলাম কয়েকটি কীর্তন সঙ্গীত রচনা করেন।
কীর্তনের সঙ্গে আরেকটি ধারা সূত্রপাত হয় যা বাংলার ঢপ গান বা ঢপ কীর্তনে পরিচিতি পায়। এই ঢপ গান মূলত বৈষ্ণব কীর্তনের লৌকিক ধারা। মনোহর কীর্তনের ঢপ গান সহজ-সরল ভাষায় হাল্কা সুরে নতুন ছন্দ সৃষ্টি করে। পরে এই ঢপ কীর্তন ও ঢপ গান ভীষণ জনপ্রিয়তা পায়। যশোর জেলার বাড়খাদিয়া গ্রামের রাধা মোহন বাউল ঢপ গানের চারটি পালা রচনা করে সুর দেন। যা ভক্তি রসে পূর্ণতা পায়। বাংলার আদি ধারার কীর্তন ও ঢপ গান বিলুপ্তির পথে।
ঢপ গানের অপর পৃষ্ঠায় আছে গীত। স্থানীয় লোকজন আবেগে গীতের আলাদা সুর সৃষ্টি করে। বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির অপার ভান্ডারে পল্লীর মাঠে ঘাটে প্রতিটি পরতে ছড়িয়ে আছে যে লোক সাহিত্য তারই বড় একটি অংশ গীত। যা লোক সংস্কৃতি। প্রতিটি দেশের সাহিত্য সংস্কৃতি বিকাশের তিনটি ধারা- আদিম কাল, মধ্য কাল ও আধুনিক কাল (কলি কাল)। লোক সংস্কৃতির ইংরেজী আধুনিক নাম ‘ফোকলোর’। ১৮৪৬ সালের আগে লোক সংস্কৃতিকে বলা হতো ‘পপুলার এ্যান্টিকুইটিজ’। ড. আশরাফ সিদ্দিকীর মতে ফোকলোরের দুইটি ভাগ। ১. মেটিরিয়াল ফোকলোর বা লোক শিল্প। ২. ফরমালাইজড ফোকলোর বা লোক সাহিত্য। লোক শিল্পের মধ্যে পড়ে লোক প্রথা লোক ভাস্কর্য লোক বাদ্যযন্ত্র লোক গীতি। লোক সাহিত্যের মধ্যে লোক রূপকথা, ধাঁধা, লোক সংস্কার কিংবদন্তি পুরা কাহিনী ইত্যাদি। গীতিকা স্থান এলাকাভেদে গল্প কাহিনীতে রূপ নিয়ে আরেক ধরনের গীত সৃষ্টি করেছে। যেমন ময়মনসিংহ গীতিকা।
পঞ্চগড়ের মেয়েলী গীতের নাম ‘হেরয়া’। লোক বিজ্ঞানীদের মতে লোকগীত লোক সাহিত্যের আদি সৃষ্টি। আজও সঙ্গীতকেই ‘গীত’ বলা হয়।
যেমন গীত রচনা। বাঙালীর গ্রামীণ জীবনে বড় একটি ধারা গীত। যে কোন উৎসব পার্বণে বিশেষ করে বিয়ের হলুদের অনুষ্ঠানে গীত অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে আছে। ঋতু বৈচিত্র্যে বিশেষ করে বর্ষা ঋতুতে মঙ্গল কামনায় গীত একটি অনুষঙ্গ। বিয়ের অনুষ্ঠানের গীতে কখনও বর কনে দুই পক্ষের মধ্যে বিদ্রƒপ ও রঙ্গরসের মাধ্যমে স্থানীয় কথায় প্রতিযোগিতা হয়। গীতের মাধ্যমে কে কাকে হারাতে পারে এমন মিষ্টি মধুর প্রতিযোগিতা বাঙালীর চিরায়ত আনন্দ বয়ে আনে। তারপরও লোকজ ধারার কীর্তন ও গীত অবহেলিত হয়েই থাকছে।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি লোকজ শিল্পকে ধরে রাখতে ফোকলোর সেল খুলেছে। শিল্পকলা একাডেমির বগুড়ার কালচারাল অফিসার শাহাদত হোসেন জানান, দেশের প্রতিটি এলাকায় লোকজ শিল্পীদের খুঁজে বের করা হচ্ছে। ঢাকায় ফোকলোর ফেস্টিভ্যালে (ফোকফেস্ট) দেশে বিদেশের লোকজ ধারার সঙ্গে পরিচিতি ঘটানো হয়।