দাস লেনের ঐতিহাসিক স্থাপনা রোজ গার্ডেন
পুরান ঢাকার কে এম দাস লেনের ঐতিহাসিক স্থাপনা রোজ গার্ডেন। ৯১ বছরের পুরনো প্রাসাদোপম ভবনটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের জন্ম ইতিহাস। বর্তমানে ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষিত এই ভবনেই ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন দলটির পথচলা শুরু হয়। সেই বাস্তবতায় ২২ বিঘার বিশাল স্থাপনাটি সংরক্ষণের লক্ষ্যে ২০১৮ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ৩৩১ কোটি ১৬ লাখ দুই হাজার ৯০০ টাকায় কিনে নেয় সরকার। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগ্রহ অনুযায়ী স্থাপনাটি ঘিরে পুরান ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরতে জাদুঘর প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। তবে, উদ্যোগ গ্রহণের চার বছর পেরুলেও ঢাকা নগর জাদুঘর নামের প্রকল্পটি বৃত্তবন্দী হয়ে পড়ে দীর্ঘসূত্রতার কবলে। অবশেষে গতি পেয়েছে পরবর্তীতে পরিবর্তিত হওয়া ঢাকা মহানগর জাদুঘর নামের প্রকল্পটি। ইতোমধ্যে প্রকল্পের ডিপিপি (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল) অনুমোদন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীকে দেখানোর পর নক্সাও অনুমোদিত হয়েছে। অর্থ বরাদ্দের বিষয়টিও সম্পন্ন হয়েছে। সেই সুবাদে সকল জড়তা কাটিয়ে এসেছে প্রকল্প বাস্তবায়নের পালা। প্রকল্পের অধীন রোজ গার্ডেনের প্রতœতাত্ত্বিক সংস্কার ও সংরক্ষণ এবং জাদুঘর গড়ার জন্য জাতীয় অথনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ৩৩ কোটি ৪৮ লাখ ৫২ হাজার টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। আগামী মাসে বরাদ্দকৃত এই অর্থ ছাড়ের সমান্তরালে শুরু হবে প্রকল্পের কাজ। কাজ শুরুর দুই বছর পর অর্থাৎ ২০২৪ সালের জুলাই মাসে দর্শনার্থীদের জন্য রোজ গার্ডেন খুলে দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন ঢাকা মহানগর জাদুঘর প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে প্রতœতাত্ত্বিক অধিদফতর, গণপূর্ত অধিদফতর, জাতীয় জাদুঘর, শিল্পকলা একাডেমি ও স্থাপত্য অধিদফতর। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নগর ভবনের ঢাকা নগর জাদুঘরটি স্থানান্তরিত হচ্ছে এই প্রকল্পে। সেখানে গিয়ে ঢাকা মহানগর জাদুঘর নাম ধারণ করবে। রোজ গার্ডেনের সাবেক মালিকের তিন তলার বাসস্থানে জাদুঘর সাজানোর কাজটি করবে জাতীয় জাদুঘর। অন্যদিকে, গ্রীক স্থাপত্যশৈলীর রোজ গার্ডেনের মূল প্রাসাদোপম ভবনটি সংরক্ষণ ও সংস্কারের কাজটি করবে প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর। অনন্য স্থাপত্যশৈলীর এই ভবনটির সৌন্দর্য অপরিবর্তিত রেখে চলবে সংস্কারের কাজ। সেই সূত্রে হুবহু একই রকম ও অবিকৃত কাঠামোতেই থাকবে দালানটি। কালের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও কালের সাক্ষ্যবহ এই ভবনটি দর্শনীয় ভবন হিসেবে রাখা হবে। এ ছাড়া প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত বেঙ্গল স্টুডিওকে ব্যবহারযোগ্য করে তোলার কাজটি করবে শিল্পকলা একাডেমি। রোজ গার্ডেনের ভেতরের পুকুরটির সোন্দর্যবর্ধনের পাশাপাশি বর্ষাকালে জলাবদ্ধতা নিরসনসহ বিভিন্ন কাজ করবে গণপূর্ত অধিদফতর। আর পুরো প্রকল্পের সামগ্রিক নক্সা কিংবা পরিকল্পনার সমন্বয় করবে স্থাপত্য অধিদফতর।
প্রকল্পটি প্রসঙ্গে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়েছে। একনেকে অর্থ বরাদ্দের অনুমোদন হয়েছে। জুলাই মাসে এই অর্থ ছাড় দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পের নক্সা দেখার পর সেটিও অনুমোদন পেয়েছে। সব মিলিয়ে রোজ গার্ডেন ঘিরে নির্মিতব্য এই প্রকল্পটি আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে রূপ নেবে। শহরবাসীর কাছে এটি এক আকর্ষণীয় পর্যটন স্থানে পরিণত হবে। এই প্রাসাদোপম ভবনটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাস ও ঐতিহ্য। এখান থেকেই যাত্রা শুরু করেছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ইতিহাস আশ্রিত প্রকল্পটির সৌন্দর্য রক্ষায় রোজ গার্ডেনের আশপাশের নক্সাবহির্ভূত অবৈধ স্থাপনাসমূহ সরিয়ে ফেলা হবে। প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রতা প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী বলেন, প্রতœতাত্ত্বিক সংস্কার ও সংরক্ষণের কারণে কাজটি খুব সহজ নয়, বিধায় বিলম্ব হয়েছে। প্রকল্পটিকে নিখুঁতভাবে বাস্তবায়নে একসঙ্গে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও অধিদফতরকে যুক্ত করতে হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে রোজ গার্ডেনের মূল ভবনের স্থাপত্যশৈলী অক্ষুণœ রাখার বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। নব্বই বছরের পুরনো ভবনটির কাঠামোয় যাতে কোন পরিবর্তন না হয়, সেই বিষয়টি ভাবতে হয়েছে। সেই সঙ্গে রোজ গার্ডেনসংলগ্ন সড়কটি উঁচু হয়ে যাওয়ায় বর্ষাকালে অল্প বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধ হয়ে যায় পুরো আঙিনা। সেই জলাবদ্ধতা নিরসনে গণপূর্ত অধিদফতর, ওয়াসাসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করতে হয়েছে। অন্যদিকে, নগর ভবনের জাদুঘরটি রোজ গার্ডেনের পুরনো মালিকদের তিন তলার বাসস্থানে স্থানান্তরের প্রক্রিয়ায় জাতীয় জাদুঘরের পরামর্শ নিতে হচ্ছে। বেঙ্গল স্টুডিওকে ব্যবহার করে তোলার জন্য শিল্পকলা একাডেমিকে যুক্ত করা হয়েছে।
প্রকল্পটির পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের মহাপরিচালক রতন চন্দ্র প-িত। এ বিষয়ে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, জুলাই মাসেই অর্থ ছাড়ের সঙ্গে প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। ২০২৪ সালের জুলাই মাস নাগাদ সকল কাজ সম্পন্ন করে দর্শনার্থীদের জন্য রোজ গার্ডেন উন্মুক্ত করে দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। এই প্রকল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হচ্ছে রোজ গার্ডেনের মূল ভবনের সংস্কার ও সংরক্ষণ। কোন বিকৃতি না ঘটিয়ে ভবনটি ঠিক যেমন আছে, তেমন রাখার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। কাঠামো অপরিবর্তনীয় রাখার জন্য বিশেষভাবে নজর দেয়া হবে। সেই বিবেচনায় শুরুতে প্রতœতত্ত্ববিদদের তত্ত্বাবধানে ভবনটির ডকুমেন্টশনের কাজ হবে। তারা দেখবে ভবনটি এখন কেমন আছে। ভবনের প্রতিটি ইট থেকে ভাস্কর্য কিংবা সিঁড়িসহ সবকিছু হুবহু একই রকম রাখার লক্ষ্যে এই ডকুমেন্টেশন হবে। পাশাপাশি নিখুঁতভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নে কনসালটেন্ট বা পরামর্শক নিয়োগ করা হবে। এ ছাড়া ওই ভবনের সামনের সড়ক উঁচু হয়ে যাওয়ায় বর্ষাকালে জলমগ্ন হয়ে যাওয়া আঙিনা থেকে জলাবদ্ধতা দূর করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হচ্ছে। পুরো প্রকল্পের সামগ্রিক নক্সার কাজটি করবে স্থাপত্য অধিদফতর।
প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত ঢাকা মহানগর জাদুঘর প্রসঙ্গে জাতীয় জাদুঘরের কিপার ও প্রকল্পের উপ-পরিচালক বিজয় কৃষ্ণ বণিক বলেন, রোজ গার্ডেনের সাবেক মালিকের তিন তলার বাসস্থানটিই জাদুঘরে পরিণত হবে। জাদুঘরের কাঠামো দিতে এই ভবনটি সংস্কার করা হবে। আলোকসজ্জা, ইন্টোরিয়ার ডেকোরেশনসহ বিভিন্ন কাজ শেষে ভবটিকে জাদুঘরের উপযোগী করে গড়ে তোলা হবে। সংস্কারের পর ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নগর ভবনের ঢাকা নগর জাদুঘরের নিদর্শনসমূহ এখানে স্থানান্তর করা হবে। ইতোমধ্যে এসব নিদর্শন আমাদের কাছে হস্তান্তরের জন্য সিটি কর্পোরেশনে চিঠি দেয়া হয়েছে। নগর ভবনে থাকা অবস্থাতেই কিছু নিদর্শনের ক্ষতি হয়েছে।
প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত বেঙ্গল স্টুডিও সংরক্ষণের কাজটি করবে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। এ প্রসঙ্গে একাডেমির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রোজ গার্ডেনের মূল ভবনের মতোই স্টুডিওটিকে একই রকম রাখার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।