ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৯ মে ২০২৫, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বিলম্বিত বিচারে ন্যায়বিচার অনিশ্চিত

ভুল সুরতহাল রিপোর্টে পার পেয়ে যায় প্রকৃত অপরাধীরা

প্রকাশিত: ২২:১৫, ৭ ডিসেম্বর ২০২০

ভুল সুরতহাল রিপোর্টে পার পেয়ে যায় প্রকৃত অপরাধীরা

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কান্দাপাড়ার পেরাব আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্র জিসান হোসেনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। পুলিশ তার লাশের সুরতহাল রিপোর্ট না করে তার পরিবারের হাতে তুলে দেয়। এ নিয়ে সেখানকার স্কুল ছাত্র-ছাত্রী ও এলাকাবাসী মানববন্ধন করে এই হত্যার বিচার দাবি করে। তবুও পুলিশ একে স্বাভাবিক মৃত্যু বলে দবি করে। পত্রপত্রিকায় লেখালেখির এক মাস পর জিসানের লাশ কবর থেকে তুলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়। ময়নাতদন্তে জানা যায়, জিসানকে পিটিয়ে ও শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছিল। স্থানীয়রা জানান, গত ২২ আগস্ট রূপগঞ্জের গোলাকান্দাইল এলাকায় সন্ত্রাসীরা তাকে নির্মমভাবে পিটিয়ে ছুড়ে ফেলে যায়। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরদিন তার মৃত্যু হয়। ময়নাতদন্তের জন্য লাশ ঢামেক মর্গে পাঠানো হয়। ঘটনাস্থল ঢাকার বাইরে হওয়ায় নিয়ম অনুযায়ী ডিএমপি’র শাহবাগ থানাকে জানানো হয়। শাহবাগ থানার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা সুরতহাল রিপোর্ট না করেই স্বাভাবিক মৃত্যু ঘোষণা করে জিসানের লাশটি পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেন। সারাদেশে এমন ঘটনা ঘটছে অহরহ। অনেক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার সুবিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তদন্তে দেখা গেছে, প্রতিদিন হাসপাতালের মর্গে হেলপার দিয়ে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে লাশের ছবি তুলে থানায় বসে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করা হচ্ছে। এর সঙ্গে জড়িত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গের ওয়ার্ড মাস্টারসহ বিশাল সিন্ডিকেট। মর্গের হেলপাররা হাসপাতালে মারা যাওয়া লোকদের আনা নেয়া করে। মোবাইলের মাধ্যমে লাশের ছবি তুলে সুরতহাল প্রতিবেদনকারী কর্মকর্তার কাছে থানায় পৌঁছে দেয়। এভাবে সুরতহালের কারসাজিতে ভুক্তভোগীরা বিচার থেকে বঞ্চিত হন। আড়াল হয়ে যায় খুন থেকে শুরু করে অস্বাভাবিক মৃত্যুর শত শত ঘটনা। পার পেয়ে যায় প্রকৃত আসামিরা। বিচারের বাণী নিরবে কাঁদে। শরীয়তপুরের চামটার হেনা আক্তারের কথা এখনও কেউ শুনলে শিউরে ওঠেন। ২০১১ সালের শুরুর দিকে চাচাত ভাই মাহবুবের লালসার শিকার হয় এই কিশোরী হেনা। ঘটনাটি স্থানীয় ইউপি সদস্য ইদ্রিস শেখের কানে পৌঁছলে তিনি লোকজন দিয়ে হেনাকে ধরে আনেন। গ্রামভর্তি মানুষের সামনে কিশোরী হেনাকে গুনে গুনে ১০০ দোররা মারা হয়। হেনার অসহায় আর্তি অবিরাম মেরে চলা দোররার গতি থামাতে পারেনি। এক পর্যায়ে হেনার জীবনের প্রদীপ নিভে যায়। হেনার সুরতহাল প্রতিবেদনে স্থানীয় নড়িয়া থানার পুলিশ আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়। সুরতহাল রিপোর্টে বলা হয়, তার শরীরে কোন আঘাতের চিহ্ন নেই। তাহলে হাজার হাজার মানুষের সামনে এই ঘটনা ঘটলেও সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি হয় এভাবে। শুধু তাই নয়, শরীয়তপুরের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকও ময়নাতদন্তে বিষয়টিকে আত্মহত্যা বলেই চালিয়ে দেন। সংবাদটি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হলে উচ্চ আদালতের একটি বেঞ্চ স্বতপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করে। কবর থেকে তুলে হেনার লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়। নতুন প্রতিবেদন বলছে, হেনা আত্মহত্যা নয়, হত্যার শিকার। হত্যার আগে হেনাকে ধর্ষণও করা হয়েছে। তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। আইন বিশেষজ্ঞরা জানান, ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিতই নয়, ঘটনা আড়াল করতে এই কাজ সচেতনভাবেই করা হয়। অধিকাংশ সুরতহাল প্রতিবেদনে অপ্রয়োজনীয় লেখা, ভুল তথ্য, অপরিচ্ছন্ন লেখার কারণে খুন থেকে শুরু করে বিভিন্ন অস্বাভাবিক মামলার প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করা যায় না। অপরাধীদের গ্রেফতার করে আইনের মুখোমুখি করা হলেও সুরতহালের গরমিল প্রতিবেদনের কারণে এরা পার পেয়ে যায়। সুরতহাল প্রতিবেদনে স্বচ্ছ ধারণা থাকলে মামলার তদন্তে গতি আসে। অপরাধীর শাস্তিও নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। ২০১৭ সাল বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপীলের রায় ঘোষণার সময় দুই বিচারপ্রতি তার মরদেহের সুরতহাল ও ময়নাতদন্তকারী প্রতিবেদন প্রস্তুতকারী পুলিশ সদস্য ও চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন। কারণ বিশ্বজিতের সুরতহাল রিপোর্টে গরমিল ছিল। এরকমই আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ডে দেখা যায়, পুলিশ সুরতহাল প্রতিবেদনে মৃত্যুর কারণ হিসেবে শুধু ছুরিকাঘাতকে উল্লেখ করেছে। ছুরিকাঘাত কিভাবে একমাত্র কারণ হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছিল এ নিয়ে পরে বিতর্ক তৈরি হয়। পুলিশী সুরতহালে ছুরিকাঘাত ছাড়া অন্য কারণ উল্লেখ না থাকায় রাসায়নিক পরীক্ষার (ভিসেরা) আলামত সংরক্ষণ করেনি মর্গ। চাঞ্চল্যকর এই ঘটনা সাদা চোখে দেখে একজন এসআই কিভাবে সিদ্ধান্তে পৌঁছান তা নিয়ে মামলার পরবর্তী তদন্ত কর্তৃপক্ষ প্রশ্ন তুলেছিল। তারা হত্যাকাণ্ডের ৭৫ দিন পর আবারও সাগর-রুনীকে কবর থেকে তুলে আনে আলামত সংগ্রহের জন্য। প্রায় আট বছরেও এই মামলাটিরও কোন কিনারা করতে পারেনি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। হেনা ট্র্যাজেডি উন্মোচনকারী অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক সম্প্রতি এক টেলিভিশন টকশোতে বলেছেন, ওই সময় শরীয়তপুরের সিভিল সার্জন আদালতকে বলেছিলেন, এমনটা জেলা পর্যায়ে হরদমই হয়ে থাকে। পুলিশের সুরতহাল প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করেই চিকিৎসক তার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করেন। শরীয়তপুরের সিভিল সার্জনকে উদ্ধৃত করে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের বক্তব্যের সত্যতা মিলেছে অনুসন্ধানে। জেলা পর্যায়ে ময়নাতদন্ত বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা গেছে, সুরতহাল রিপোর্টের ভিত্তিতে হয় ময়নাতদন্ত। তার ওপর জেলা পর্যায়ের কোন হাসপাতালেই ময়নাতদন্তের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। নিয়মিত কাজের বাইরে অন্যান্য চিকিৎসক অনেকটা দায়সারাভাবে লাশের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট তৈরি করেন। জেলার সব হাসপাতালে একজন করে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ নিয়োগের প্রস্তাব দীর্ঘদিনের। হাসপাতাল থেকে অনেকদূরে গিয়ে জেলা হাসপাতালের চিকিৎসকদের ময়নাতদন্ত করতে হয়। অনেকক্ষেত্রে চিকিৎসকরা মর্গ সহকারীদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে ময়নাতদন্ত করে থাকেন। বেশিরভাগ চিকিৎসক লাশ ধরেও দেখেন না। পচা-গলা লাশ হলে তো কথাই নেই। মর্গ সহকারী অথবা ডোমকে ফোনে নির্দেশ দিয়ে দায়িত্ব সারেন ডাক্তার। এতে মামলা পরিচালনার সময় বিপাকে পড়েন বাদী। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মামলার আসামিরা পার পয়ে যায়। সাবেক সিআইডির প্রধান মোখলেসুর রহমান বলেছিলেন, অধিকাংশ তদন্তকারীরই সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরির বিষয়ে কোন প্রশিক্ষণ নেই। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, চলতি বছর ১১ মাসে ডিএমপির ৫০টি থানার হত্যা, আত্মহত্যা, সড়ক দুর্ঘটনাসহ নানা ঘটনায় পুলিশের সুরতহাল করতে হয়েছিল তিন হাজার। এমধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে ১,৪১৫টি, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ মর্গে ৮৫০টি ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজে ৭৪১টি লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠায়। ঢাকাতে দিনে গড়ে ১০ থেকে ১২টি লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করতে হচ্ছে পুলিশকে। আর গেল বছর সুরতহাল রিপোর্টের সংখ্যা ছিল আড়াই হাজারের বেশি। সুরতহাল রিপোর্ট কি ॥ সুরতহাল সম্পর্কে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৪ ধারায় বলা হয়েছে, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অথবা এ সম্পর্কে ক্ষমতাবান কোন পুলিশ কর্মকর্তা যদি সংবাদ পান যে কোন ব্যক্তি আত্মহত্যা করেছে অথবা অপর কোন ব্যক্তি বা প্রাণী কর্তৃক বা কোন যন্ত্রের আঘাতে কেউ মারা গেছে। তখন যুক্তিসঙ্গতভাবে সন্দেহ করা যেতে পারে যে, অপর কোন ব্যক্তি কোন অপরাধ সংঘটন করেছে। সেক্ষেত্রে অবিলম্বে সুরতহাল তদন্তের জন্য ক্ষমতাবান নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটকে এ ব্যাপারে জানাবেন এবং পুলিশ কর্মকর্তা নিজে সেখানে যাবেন ও লাশের সুরতহাল প্রণয়ন করবেন। মৃত ব্যক্তির দেহে ক্ষত, ভাঙ্গা বা মচকে যাওয়ার দাগ, আঁচড়ের দাগ ও অন্যান্য আঘাতের চিহ্ন বর্ণনা করে এবং যেভাবে ওই চিহ্নের সৃষ্টি হয়েছে তা উল্লেখ করে আপাতদৃষ্টিতে মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে প্রতিবেদন করবেন এবং এলাকার সম্রান্ত দুই ব্যক্তির উপস্থিতিতে মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রস্তুত করবেন। অন্যদিকে ১৭৬ ধারা অনুসারে পুলিশের হেফাজতে কোন ব্যক্তির মৃত্যু হলে সুরতহাল করার ক্ষমতাসম্পন্ন ম্যাজিস্ট্রেট তা পরিচালনা করবেন। ম্যাজিস্ট্রেট মৃত্যুর কারণ নির্ণয়ের জন্য লাশ কবর থেকে উঠিয়ে পরীক্ষা করাতে পারেন (পিআরবি-২৯৯)। সুরতহাল রিপোর্টে গরমিল ॥ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের জলসিঁড়ি আবাসিক এলাকা থেকে রিপন (২৫) নামে এক ব্যক্তিকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে গত ২০ সেপ্টেম্বর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওদিনই তার মৃত্যু হয়। প্রথমে অজ্ঞাতনামা হিসেবে তার লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে ডিএমপির শাহবাগ থানা। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, লাশের মাথা, কপাল, গলা, ঘাড়, নাক ও কান স্বাভাবিক। কোন আঘাতের চিহ্ন নেই। সুরতহাল এই প্রতিবেদন তৈরি করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢামেক মর্গে পাঠানো হয়। অথচ ময়নাতদন্তের সময় তদন্তকারী চিকিৎসক লাশের ঘাড়ে স্পষ্ট আঘাতের চিহ্নসহ নানা আলামত পান। এটি খুন বলে উল্লেখ করেন তদন্তকারী চিকিৎসক। বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী সিরাজ প্রামাণিক জনকণ্ঠকে বলেন, গরমিল সুরতহাল প্রতিবেদনের কারণে একটি হত্যা মামলার আসামিরা উচ্চ আদালতে বেকসুর খালাস পেয়ে যান। তিনি একটি ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, দুই কর্মঠ সন্তান, স্ত্রী, নাতি-নাতনি নিয়ে ভালই কাটছিল রহিমা খাতুনের সংসার। একদিন সন্ধ্যায় প্রতিপক্ষরা তাদের বাস্তুভিটায় অবৈধ জনতায় দলবদ্ধ হয়ে ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। এতে নিহত হন রহিমা খাতুন। দুই সন্তানও আহত হয়। প্রতিপক্ষরা তাদের জমিজমা দখল করে নেয়। এ নিয়ে থানায় মামলা হয়। সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়, মৃত রহিমা খাতুনের বাম চোখের ভ্রুর ওপর কাটা চিহ্ন, চোখের নিচের হাড় ভাঙ্গা, মাথার পেছনে আঘাত। আর ডান দিকের গালে একটি কালসিটে দাগ আছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনেও ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা তাই লিখেন। আর মৃত্যুর কারণ হিসেবে আঘাতের ধাক্কা ও রক্তক্ষরণের কথাই উল্লেখ করা হয়। সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরির ঠিক আধা ঘণ্টা আগে বাদী ছাকু মিয়া থানায় যে এজাহার দাখিল করেন তাতে বলা হয় যে, মৃত ভিকটিমের ডান চোখের ওপর কাটার দাগ। আসামিরা ধারালো অস্ত্র ও ছুরি দিয়ে মৃত রহিমা খাতুনের ডান চোখের ওপর, ডান বুকে ও মাথায় উপর্যুপরি আঘাত করেছে। এজাহারে বর্ণিত ভিকটিমের শরীরের ক্ষতের স্থান হলো ডান চোখের ওপর আর প্রকৃত জখম হলো বাম চোখের ওপর। এ অসঙ্গতি নিয়ে মামলার তদন্ত চলতে থাকে। তদন্ত শেষে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতে চার্জশীট দাখিল করেন। শুরু হয় বিচারিক কার্যক্রম। আদালত সাক্ষ্য প্রমাণ শেষে আসামিদের বেকসুর খালাস দেন। এই আইনজীবী জানান, বেকসুর খালাসের অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম ও প্রধানতম কারণ ছিল মামলার এজাহারে বর্ণিত ভিকটিমের শরীরের আঘাতের স্থানের সঙ্গে (ডান চোখের ওপর) সুরতহাল ও ময়নাতদন্তে বর্ণিত আঘাতের স্থানের (বাম চোখের ওপর) গরমিল। একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এজাহারে একটি হত্যা মামলায় যদি দুটি ছুরিকাঘাতের কথা উল্লেখ থাকে, সুরতহালেও তা-ই লিখতে হবে। ময়নাতদন্তে যদি রিপোর্ট আসে যে, তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে, তখন ওই মামলা প্রমাণের জন্য গলার ছাপ নিতে হবে। ডিএনএ টেস্ট করতে হবে। তারপর জানা যাবে কে বা কারা হত্যা করেছে। এভাবেই মূলত প্রতিটি রিপোর্ট মামলায় প্রভাব ফেলে। বিচারিক আদালত অত্যন্ত নিপুণভাবে সাক্ষ্য প্রমাণ ও উপস্থাপিত আলামত বিশ্লেষণ করে তার সিদ্ধান্ত টেনেছেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো এই, যে পুলিশ কর্মকর্তা বাদীকে এজাহার লিখতে সহায়তা করেছেন, সেই কর্মকর্তাই সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। সেই পুলিশ অফিসারই পুরো মামলাটি তদন্ত করেছেন। এজাহার গ্রহণ থেকে শুরু করে অভিযোগপত্র দাখিল পর্যন্ত কোন পর্যায়েই ভিকটিমের শরীরের আঘাতের স্থানসংক্রান্ত গরমিলের সুরাহা করেননি। তার অভিযোগপত্রের পক্ষে সাক্ষীদের ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ধারা জবানবন্দীতেও একই ভাষ্য লিপিবদ্ধ করেছেন। মামলার তদন্ত ও বিচারিক পর্যায়ে সাক্ষীদের জবানবন্দীর নানা অসঙ্গতির মধ্যে প্রধানতম অসঙ্গতি ভিকটিমের চোখের আঘাতের ডান-বামের পাল্লায় পড়েই ‘সন্দেহের সুবিধা’ পুরো অংশই চলে গেছে আসামিদের পক্ষে। তাই তারা বেকসুর খালাস। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে এই রায় হয়। বাদী এ খালাস আদেশের বিরুদ্ধে আপীল করতে চাইলে ও অসঙ্গতির কারণে শেষ পর্যন্ত আর তা পারেননি। বাদী ছাকু মিয়ার বিশ্বাস, জগতের সবাই তাদের প্রতারণা করেছে। তাদের মা রহিমা খাতুনের আঘাত অবশ্যই ডান চোখের ওপর। এজাহারে তারা ঠিকই লিখেছিলেন। সাক্ষীতেও তারা একই কথা বলেছিলেন। কিন্তু পুলিশ ও ডাক্তার ওটা ডানের পরিবর্তে বাম দিকে লিখে দিয়েছেন। গত ৬ আগস্ট ২০১৭ বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপীলের রায় ঘোষণার সময় হাইকোর্টের বিচারপতি রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তীর বেঞ্চ মরদেহের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুতকারী পুলিশ সদস্য ও চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন। কারণ বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ফুটেজের সঙ্গে সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের কোন মিল ছিল না। ভিডিও ফুটেজ ও সাক্ষীদের বর্ণনা অনুসারে বিশ্বজিতের শরীরে রড, লাঠি ও ধারালো অস্ত্রের একাধিক আঘাত থাকার কথা থাকলেও সুরতহাল প্রতিবেদন ও ময়নাতদন্ত রিপোর্টে এই আঘাতের তথ্য ছিল না। তাই বিষয়টিতে দায়িত্বে অবহেলা ছিল কি-না, তা খতিয়ে দেখতে আদালত আদেশ দেয়। একইভাবে ২০১৩ সালের ১৬ মার্চ রাত পৌনে তিনটায় পুলিশ উত্তরখানের আইচি হাসপাতাল থেকে অজ্ঞাতনামা এক বৃদ্ধ পথচারীর লাশ উদ্ধার করে ঢামেক মর্গে পাঠায়। তদন্ত কর্মকর্তা সুরতহাল প্রতিবেদনের এক জায়গায় উল্লেখ করেন, ওইদিন দিবাগত রাত দুটোয় উত্তরখানের আটপাড়ায় অজ্ঞাতনামা একটি গাড়ি অজ্ঞাত বৃদ্ধ পথচারীকে চাপা দিয়ে চলে যায়। এরপর স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে উত্তরখানের ওই হাসপাতালে নিলে ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন। নিহতের পরনে ছিল বিভিন্ন রঙের শর্টপ্যান্ট ও গায়ে চেক ফুলশার্ট। অপরদিকে লাশের সুরতহাল প্রতিবেদনের প্রাথমিক তদন্তে একই কর্মকর্তা মৃত ব্যক্তির নাম আব্দুল মান্নান উল্লেখ করেন। প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়, নিহত ওই বৃদ্ধ ভাসমান পাগল প্রকৃতির, স্থানীয়রা কেউ তাকে চেনে না। রাত পৌনে বারোটায় উত্তরখানের আটপাড়ায় বেপরোয়া গতির একটি কাভার্ড ভ্যানের (ঢাকা মেট্রো ট-১১-৬২৩৩) চাপায় ওই ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। শুধু তাই নয়, বিধিমোতাবেক সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরির দায়িত্ব পেয়ে একজন প্রথমিক রিপোর্ট তৈরি করেছিলেন। কিন্তু লাশের চালান কপি তৈরি করলেন অন্য এক কর্মকর্তা যা নিয়ে মর্গ সংশ্লিষ্টরাও বিভ্রান্তির মুখে পড়েন। অনেকক্ষেত্রে পুলিশ নিজেই সুরতহালকে ত্রুটিপূর্ণ বলে উল্লেখ করছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) দেশের ১১ জেলার ১২০ মামলার তদন্ত করতে গিয়ে ৩৬টির কারণ উদ্ঘাটন করতে ব্যর্থ হয়েছে। সিআইডি এর কারণ হিসেবে বলছে, নিহত ব্যক্তির সুরতহাল প্রতিবেদন ঠিকমতো হয়নি। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন বুঝা যায়নি। লাশ শনাক্ত হয়নি এবং সাক্ষ্য সংগ্রহ ঠিকমতো করা হয়নি। সে সময় সিআইডির বিশেষ সুপার আবদুল্লাহ আল মাহমুদের নেতৃত্বে ১২০ মামলার সমীক্ষা করা হয়। ওই সমীক্ষায় বলা হয়, এই ১২০ মামলা থানা থেকে সিআইডিতে আসতে সময় লেগেছে এক বছর চার মাস থেকে চার বছর পর্যন্ত। নিহত ১২০ জনের মধ্যে ৩৯ জনকেই খুন করা হয়েছে শ্বাসরোধে। অন্যদের মধ্যে দেশী অস্ত্রের আঘাতে ৬৩, গুলিতে আট, বিষ প্রয়োগে তিন এবং দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন সাতজন। সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, এসবের মধ্যে ৩৬ খুনের কোন কারণ উদ্ঘাটন করতে পারেনি সিআইডি। এর বেশিরভাগই শ্বাসরোধের মাধ্যমে খুন করা হয়েছে। মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও সামাজিক সেবা শাখার উপকমিশনার জনকণ্ঠকে জানান, আইন অনুযায়ী সুরতহাল প্রতিবেদনে লাশের পা থেকে মাথা পর্যন্ত বিভিন্ন দিকের বর্ণনা থাকতে হয়। শরীরের কোন্ অঙ্গটি কিভাবে পাওয়া গেছে, কোন আঘাত বা দাগের চিহ্ন আছে কি না এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হয়। এখানে মৃত ব্যক্তি কেমন ছিল। কী ধরনের আচরণ। এমন কথা উল্লেখের সুযোগ নেই। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ফরেনসিক বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ডাঃ হাবিবুজ্জামান চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, অনেক পুলিশ কর্মকর্তা ঘটনাটি ধামাচাপা ও ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য সুরতহাল প্রতিবেদন ঠিকমতো লেখেন না। অনেক পুলিশ অতি উৎসাহিত হয়ে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে মামলাটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা চালায়। ভুক্তভোগীরা থানায় গেলে মামলা নেয় না। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশের গাফিলতির কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু কিংবা আত্মহত্যার কথা বলে অনেক মৃতদেহ ময়নাতদন্ত ছাড়াই নিয়ে যাচ্ছে তাদের পরিবার। অথচ এগুলোর মধ্যে আঘাতজনিত মৃত্যু (হত্যার ঘটনা) রয়েছে। মৃতদেহগুলোর শরীর ঠিকমতো পরখ করলে এই ঘটনাগুলো ধরা পড়তে পারত। মামলাগুলো হত্যা মামলা হতে পারত।

আরো পড়ুন  

×