
নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ সাইবার অপরাধ বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে। মানুষের ঘরে থাকা এবং প্রযুক্তির সহজলভ্যতায় বাড়ছে ইন্টারনেট ব্যবহার। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অপরাধ। করোনা পরিস্থিতিতে এই প্রবণতা আরও বেড়েছে। নানা সীমাবদ্ধতায় তাৎক্ষণিক সমাধান দিতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ কারণে নানাভাবে নাজেহাল হতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। সাইবার অপরাধ দমনে এবার সরকার গ্রহণ করেছে বহুমুখী উদ্যোগ। ইতোমধ্যে চালু হয়েছে সাইবার ট্রাইব্যুনাল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে গঠন করা হয়েছে সাইবার ইউনিট। প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। শীঘ্রই চালু করা হবে সাইবার থানার কার্যক্রম। দেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি। গত বছর সারাদেশের বিভিন্ন থানা থেকে ৭২১টি মামলা বিচারের জন্য সাইবার ট্রাইব্যুনালে এসেছে। চলতি বছর এর সংখ্যা অনেক বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর আগে ২০১৮ সালে এসেছিল ৬৭৬টি, ২০১৭ সালে ৫৬৮টি, ২০১৬ সালে ২৩৩টি, ২০১৫ সালে ১৫২টি, ২০১৪ সালে ৩৩টি এবং ২০১৩ সালে এসেছে ৩টি মামলা। ক্রমেই মামলার সংখ্যা বাড়ছে। গত বছরের মোট অভিযোগের ৫৩ শতাংশ এসেছে পুরুষদের কাছ থেকে, বাকি ৪৭ শতাংশ এসেছে নারীদের কাছ থেকে। এবার করোনাকালীন অধিকাংশ মানুষ বাসায় বসেই অফিসের কাজ করেছেন। সারাদিন কাটছে তাদের প্রযুক্তির মধ্যে। এই কারণে সাইবার অপরাধ আরও বাড়ছে। যারা সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছেন, তারা পাচ্ছেন না সমাধান। এমনই সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন দেশের নামী-দামী তারকারা। তারকাদের ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটারসহ ইউটিউবেও তাদের নিয়ে বহু কুরুচীপূর্ণ মন্তব্য করছে কতিপয় বিকৃত মানসিকতার মানুষ; যা শিল্পীর মানসিক অবস্থাকে বিপর্যস্ত করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভেতর ফেসবুক সবচেয়ে জনপ্রিয়। তাই বাংলাদেশের তারকারা সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত হন ফেসবুকে। অনেকে কেবল বুলিংয়ের শিকার হয়ে কাজের আগ্রহও হারিয়ে ফেলেছেন।
অতিসম্প্রতি ফেসবুকে প্রতারণার দায়ে গ্রেফতার হয়েছে চার বিদেশী। ফেসবুকে বন্ধুত্ব তৈরি করে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেয়া ছিল তাদের প্রতারণার কৌশল। ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের (সিআইডি) অর্গানাইজড ক্রাইম শাখা চক্রের চার সদস্য সিসম, মরো মহাম্মদ, মরিসন, এ্যান্থনিকে গ্রেফতার করে। এরা নাইজিরিয়া ও ঘানার নাগরিক। পুলিশ জানায়, গ্রেফতার চার বিদেশীর প্রতারণার শিকার একজন ভিকটিমের অভিযোগের সূত্র ধরে সিআইডি তাদের খুঁজে বের করে। তারা অভিনব কায়দায় (সাধারণত বিপরীত লিঙ্গের আইডির সঙ্গে) ফেসবুকে বন্ধুত্ব তৈরি করে। বন্ধুত্বের এক পর্যায়ে প্রতারণার ফাঁদ পেতে ব্ল্যাকমেলের মাধ্যমে অর্থ আদায় করে। প্রতারণার মাধ্যমে সারাদেশে গত কয়েক মাসে তারা অসংখ্য ভিকটিমের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। একইদিনে ‘শিলংতীর’ নামে অনলাইন জুয়ার সঙ্গে জড়িত চারজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। জুয়া থেকে হাতিয়ে নেয়া টাকা তারা হুন্ডির মাধ্যমে ভারত পাচার করত। ১৯৯০ সালে সিলেটের সীমান্তবর্তী ভারতের শিলং ও গৌহাটি থেকে চালু হয় এই জুয়া খেলাটি। এর পর ধীরে ধীরে জুয়া খেলাটি সিলেটের অনেককে সর্বস্বান্ত করে নেত্রকোনা হয়ে রাজধানীতে প্রবেশ করে। পুলিশ প্রথমে রাজধানীর কালাচাঁদপুরে অভিযান চালিয়ে দুজনকে গ্রেফতার করে এবং এর সূত্র ধরে আরও দু’জনকে গ্রেফতার করে নেত্রকোনার কলমাকান্দা থানা এলাকা থেকে। ঘটনা দুটি সাম্প্রতিক। এমন ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। অধিকাংশই অভিযোগ আকারে আসছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে, বাকি সবই থেকে যাচ্ছে আড়ালে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাইবার অপরাধী শনাক্ত ও ভিকটিমদের তাৎক্ষণিক সমস্যার সমাধান দিতে পারছে না থানা পুলিশ। থানায় সেই ধরনের লজিস্টিক সাপোর্ট ও তথ্য প্রযুক্তিতে (আইটি) দক্ষ পুলিশ সদস্যের অভাব রয়েছে। ফলে চাইলেই কোন তদন্ত কর্মকর্তা প্রযুক্তি মামলার তদন্ত করতে পারেন না। তাই সব প্রযুক্তি মামলার সমাধান করতে শীঘ্রই সাইবার পুলিশ স্টেশন বা সাইবার থানা হচ্ছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির অধীনে প্রস্তাবিত এই সাইবার থানার প্রধান হবেন একজন পুলিশ সুপার (এসপি) পদমর্যাদার কর্মকর্তা। তার সঙ্গে ১৬৯ প্রযুক্তিদক্ষ কর্মকর্তা থাকবেন। রাজধানীর ঢাকায় সাইবার থানা স্থাপিত হলেও এটির কার্যক্রম দেশব্যাপী। সাইবার মামলা পরিচালনা করবেন এসব দক্ষ কর্মকর্তা।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সাইবার থানা চালু বিষয়ে আন্তরিক। মন্ত্রণালয় চায় দ্রুত এই থানা চালু হোক। কারণ, অপরাধের ধরন পাল্টেছে। বর্তমানে প্রযুক্তিগত অপরাধের মাত্রা আগের যে কোন সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। প্রযুক্তিগত অপরাধের শিকার হচ্ছেন সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা। তাই এটি দ্রুত চালুর বিষয়ে সরকারী নিদের্শনা আছে। সাইবার থানার কাঠামোসহ সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। আশা করছি চলতি বছরের মধ্যে সাইবার থানা স্থাপন করা হবে। প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসসংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির (নিকার) সভায় এটার অনুমোদনও হয়ে গেছে। থানার কার্যক্রম শুরু না হলেও ইতোমধ্যে সারাদেশে যেসব সাইবার মামলা হচ্ছে সে সবের কাগজপত্র সংগ্রহ করা হচ্ছে। কার্যক্রম শুরু হলেই মামলার তদন্ত করবে সাইবার থানা। ভুক্তভোগীরা দ্রুত সেবা পাবে বলে আমরা আশাবাদী।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সাইবার ক্রাইম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এ সংক্রান্ত মামলাও বাড়ছে। গত ৭ বছরে সারাদেশের বিভিন্ন থানা থেকে বিচারের জন্য সাইবার ট্রাইব্যুনালে দুই হাজার ৬৪২টি জমা পড়েছে। এর মধ্যে ১২৪টি মামলার রায় ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনাল। অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় ৩৫টি মামলায় আসামির সাজা হয়েছে। আর অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায় ৮৯টি মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছে। সূত্র জানায়, দক্ষ তদন্ত কর্মকর্তা দিয়ে মামলার তদন্তও করানো হচ্ছে না। ফলে মামলার সংখ্যা বাড়তেই থাকে। ঝুলে যায় বিচার কাজ। আবার যথেষ্ট যুক্তি-প্রমাণের অভাবে মামলাগুলো যেমন খারিজ হয়ে যায়, আসামিরাও তেমনই খালাস পেয়ে যান।
সাইবার থানা ॥ একজন পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে প্রধান করে গঠিত হবে সাইবার থানা। তার সঙ্গে থাকবেন তিন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ১২ সহকারী পুলিশ সুপার, ২৪ পুলিশ পরিদর্শক, ৭২ উপপরিদর্শক, ১৮ সহকারী উপপরিদর্শক এবং ৪০ কনস্টেবল। প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন পুলিশ কর্মকর্তারা এখানে নিয়োগ পাবেন। পাশাপাশি প্রযুক্তি বিষয়ে তাদের একাধিক প্রশিক্ষণও দেয়া হবে। এসব প্রশিক্ষিত প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন পুলিশ কর্মকর্তা যে ধরনের সাইবার অপরাধই হোক না কেন, তারা সমাধান দিতে পারবেন। সাইবার মামলার চার্জশীট সরাসরি সাইবার ট্রাইব্যুনালেই দাখিল করবেন সংশ্লিষ্ট মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।
সাধারণত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, গুগল, স্কাইপে ভুয়া আইডি খুলে বিভিন্ন অনলাইন পোর্টাল ও ব্লগে মিথ্যা ও মানহানিকর তথ্য প্রচার, অশ্লীল ছবি ও ভিডিও আপলোড এবং মেসেজ পাঠিয়ে প্রতারণার ঘটনাই দাগী সাইবার অপরাধ হিসেবে পরিচিত। এদের লাঞ্ছনার শিকার বেশিরভাগ মানুষই নিজেকে লুকিয়ে রেখে বাঁচতে চায়। কখনও থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে। বেশি আক্রান্ত হলে মামলা করে।
পুলিশ সদর দফতর জানিয়েছে, দেশে সাধারণত ১৩ ধরনের সাইবার অপরাধের ঘটনা ঘটছে। এগুলো হচ্ছেÑ পারিবারিক বিদ্বেষ সৃষ্টি, স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া, বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে বিরোধ তৈরি, উগ্র ও বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য প্রচার, ইউটিউবে অন্তরঙ্গ ভিডিও ও ছবি আপলোড, ফেক এ্যাকাউন্ট তৈরি, পাসওয়ার্ড বা গোপন নম্বর অনুমান করে আইডি হ্যাক, মোবাইল ব্যাংকিং, ই-কমার্স, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি, অনলাইন এমএলএম (মাল্টি লেভেল মার্কেটিং), অনলাইনে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও অনলাইন গ্যামব্লিং (জুয়া)। সাইবার ক্রাইম বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, আগে সাইবার ক্রাইম বিষয়ক বেশি অভিযোগ আসত নারীদের কাছ থেকে। কিন্তু এখন সমান্তরালভাবে পুরুষরাও সাইবার ক্রাইমের শিকার হচ্ছেন।
পুলিশের ক্রাইম ডাটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (সিডিএমএস) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সাইবার অপরাধের ঘটনায় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় তিন হাজার ৬৫৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে এক হাজার ৫৭৫টি সাইবার ট্রাইব্যুনালে গেছে। নিষ্পত্তি হয়েছে ৫২২টির। মাত্র ২৫টি মামলায় আসামিদের সাজা হয়েছে। ভুক্তভোগীদের এসব অভিযোগের বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের ল-ফুল ইন্টারসেপশন সেল (এলআইসি), ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল (সিসিটিসি) ইউনিটের সাইবার সিকিউরিটি এ্যান্ড ক্রাইম বিভাগ, অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার পুলিশ সেন্টার, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সাইবার অপরাধ তদন্তবিষয়ক সেল, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি), তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের সাইবার হেল্প ডেস্ক এবং ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) কাজ করে। তবে মামলার তদন্ত করেছে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট। সিআইডির প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মাহবুবুর রহমান জানান, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাইবার পুলিশ স্টেশন রয়েছে। আমাদের দেশেও প্রয়োজন। কারণ সাইবার অপরাধ বাড়ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা ঢাকাতে একটি সাইবার পুলিশ স্টেশন করব। এখানে সারাদেশ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত যে কেউ অভিযোগ দিতে পারবেন। আমাদের জেলা অফিসে সিআইডি কর্মকর্তারা রয়েছেন, তাদের কাছেও অভিযোগ করতে পারবেন। সাইবার পুলিশ স্টেশনে করা অভিযোগগুলো আমরা কর্মকর্তাদের দিয়ে তদন্ত করাব।
সাইবার ট্রাইব্যুনাল ॥ দেশে সাইবার ক্রাইমের সংখ্যা যেমন বাড়ছে তেমনি দিন দিন বাড়ছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এ সংক্রান্ত মামলা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সাইবার ক্রাইমের মামলাগুলো দায়ের করার সময় তা যথেষ্ট যাচাই-বাছাই করা হয় না। মামলাগুলো দক্ষ তদন্ত কর্মকর্তা দিয়ে তদন্তও করানো হচ্ছে না। আর এই কারণে যথেষ্ট যুক্তি-প্রমাণের অভাবে মামলাগুলো যেমন খারিজ হয়ে যায়, আসামিরাও তেমনই খালাস পেয়ে যান। এ ব্যাপারে সাইবার ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর নজরুল ইসলাম শামীম জনকণ্ঠকে জানান, সাইবার ক্রাইমের যে মামলাগুলো থানায় নেয়া হচ্ছে, তার বেশিরভাগই ভিত্তিহীন। কোনরকম যাচাই-বাছাই না করেই থানায় মামলা নেয়া হচ্ছে। ফলে পরবর্তীতে তদন্ত শেষে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হলেও আসামিরা মামলা থেকে অব্যাহতি বা খালাস পেয়ে যান। আইনজীবী নজরুল ইসলাম শামীম জানান, বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনাল ২০১৩ সাল থেকে চলতি বছরের ২৪ আগস্ট পর্যন্ত ১২৪টি মামলার রায় ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় ৩৫টি মামলায় আসামির সাজা হয়েছে। আর অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায় ৮৯টি মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছেন। এছাড়া অভিযোগ গঠনের শুনানির দিনে মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন ২০০টির বেশি মামলার আসামিরা। এত বেশি সংখ্যক মামলার আসামি খালাস পাওয়ার কারণ সম্পর্কে সাইবার ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর নজরুল ইসলাম শামীম জনকণ্ঠকে জানান, থানায় বেজলেস মামলা নেয়া, মামলা দায়েরের পরে বাদী ও আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে সঠিকভাবে সাক্ষ্য উপস্থাপন না করা, তদন্ত কর্মকর্তা মামলার অভিযোগপত্রে আইটি রিপোর্ট দাখিল না করা এবং তদন্ত কর্মকর্তা সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও মামলার তথ্যগত কাগজপত্র সঠিকভাবে পর্যালোচনা না করে আদালতে রিপোর্ট প্রদান করায় আসামিরা খালাস পেয়ে যান। তিনি জানান, থানার উচিত সাইবার ক্রাইম সংক্রান্ত ভিত্তিহীন মামলা পরিহার করা। যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত ও প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট ছাড়া মামলা গ্রহণ না করা। দক্ষ তদন্ত কর্মকর্তা দিয়ে মামলার তদন্ত করা। মামলার বিচার চলাকালে সাক্ষ্য গ্রহণের সময় সাক্ষীদেরও সতর্ক থাকা উচিত। স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর নজরুল ইসলাম শামীম জানান, থানাগুলো অভিযোগ এলেই তা যাচাই-বাছাই না করেই মামলা রেকর্ড করে ফেলে। ট্রাইব্যুনালে মামলার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার এটাই অন্যতম কারণ বলে আমি মনে করি।
সাইবার বুলিং ॥ বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের শিশুকন্যাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কুরুচীপূর্ণ মন্তব্যে তোলপাড় শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে ডিএমপি সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন ছয়জনকে শনাক্ত করে নজরদারিতে রেখেছে। তাদেরকে আটক করতে পুলিশের একাধিক টিম মাঠে নেমেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানায়, ইতোমধ্যে এই ছয়জনের বিরুদ্ধে রাজধানীর রমনা থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছে সাইবার পুলিশ।
সিটিটিসির সাইবার ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার নাজমুল ইসলাম জানান, শনাক্ত হওয়া আইডিগুলো ঢাকার বাইরের। তাদের আটক করতে টিম কাজ করছে। আশা করছি, দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে। এডিসি নাজমুল ইসলাম জানান, বাংলাদেশের গর্ব সাকিব আল হাসানের শিশুকন্যাকে নিয়ে কিছু বিকৃত মানসিকতার লোক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সম্প্রতি কুরুচীপূর্ণ মন্তব্য করছে, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। ইতোমধ্যে মন্তব্যকারী ছয় ফেসবুক ইউজারকে আমরা শনাক্ত করেছি। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে প্রাথমিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আমরা রমনা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি নথিভুক্ত করেছি। তিনি জানান, আমরা চাই না সাধারণ কোন ফেসবুক ব্যবহারকারী এ হেন অপকর্মে জড়িয়ে যাক এবং তদন্তে কোন সাধারণ ফেসবুক ব্যবহারকারী বিপাকে পড়ুক। সে জন্যই সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। সম্প্রতি সাকিব ফেসবুকে সূর্যমুখী ফুলের বাগানে কানে লাল ফুল গোঁজা মেয়ের হাস্যোজ্জ্বল ছবি পোস্ট করেন। ফুলের মতো সুন্দর এ ছবির নিচে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কুরুচীপূর্ণ মন্তব্য করেছেন কয়েকজন বিকৃত মানসিকতার মানুষ। এদিকে একইভাবে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন জনপ্রিয় অভিনেতা জিয়াউল ফারুক অপূর্বের সাবেক স্ত্রী নাজিয়া হাসান। কিছুদিন আগেই তারা বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন। নাজিয়াকে জড়িয়ে বেশ কিছু অনলাইন পোর্টাল ও ইউটিউব চ্যানেল কয়েকদিন ধরে মিথ্যা ও বানোয়াট খবর প্রচার করে আসছে। ফেসবুকে সেসব খবরকে কেন্দ্র করে চলেছে কুরুচীপূর্ণ মন্তব্য। একমাত্র সন্তানের মায়ের সঙ্গে এসব আপত্তিকর আচরণ ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে অপূর্ব থানায় অভিযোগ করেছেন। এর কিছুদিন পর মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ও নুসরাত ইমরোজ তিশার দাম্পত্য জীবনের ১০ বছর পার করার খবরে ফেসবুকে অনেকে কুরুচীপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। দেশবরেণ্য শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার করোনা আক্রান্তের খবরেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জড়ো হয়েছে আজেবাজে মন্তব্য। বিষয়গুলো দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে বলে মত বেশিরভাগ তারকার। এখনই এই ধরনের অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা না করলে সামনে আরও কঠিন সময় অপেক্ষা করছে বলেও মনে করছেন তারা। তারকাদের ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটারসহ ইউটিউবেও তাদের নিয়ে বহু কুরুচীপূর্ণ মন্তব্য চোখে পড়ে, যা শিল্পীর মানসিক অবস্থাকে বিপর্যস্ত করে। বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর ভেতর ফেসবুক সবচেয়ে জনপ্রিয়।
ডিএমপির সাইবার ক্রাইম ইউনিট ॥ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার সিকিউরিটি এ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮ সালে তাদের কাছে সরাসরি এক হাজার ৭৬৫টি অভিযোগ জমা পড়েছিল। এছাড়া হ্যালো সিটি এ্যাপস, ফেসবুক, মেইল ও হেল্প ডেস্কের মাধ্যমে অভিযোগ এসেছে ৬ হাজার ৩০০টি। ২০১৯ সালে সরাসরি অভিযোগের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৯৩২ টিতে। আর হ্যালো সিটি এ্যাপস, ফেসবুক, মেইল ও হেল্প ডেস্কের মাধ্যমে অভিযোগ এসেছিল ৯ হাজার ২২৭টি। সাইবার ক্রাইম বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, আগে সাইবার ক্রাইম বিষয়ক বেশি অভিযোগ আসত নারীদের কাছ থেকে। এখন সমান্তরালভাবে পুরুষরাও সাইবার ক্রাইমের শিকার হচ্ছেন। ২০১৯ সালে মোট অভিযোগের ৫৩ শতাংশ এসেছে পুরুষদের কাছ থেকে, আর বাকি ৪৭ শতাংশ এসেছে নারীদের কাছ থেকে।