ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৬ মে ২০২৫, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

পাইলট প্রকল্পে বন্দী সব ;###;কবে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা চালু হবে কেউ জানে না ;###;উন্নয়ন প্রকল্প ও বাড়তি গাড়ি বাধা ;###;মাসে কোটি টাকা গচ্চা ;###;দ্রুত ট্রাফিক বিভাগের হাতে সব ন্যস্ত করার পরামর্শ

হাত উঁচিয়ে নিয়ন্ত্রণ ॥ ইচ্ছে আইনে রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা

প্রকাশিত: ১১:০৪, ২ অক্টোবর ২০১৯

হাত উঁচিয়ে নিয়ন্ত্রণ ॥ ইচ্ছে আইনে রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা

রাজন ভট্টাচার্য ॥ সবুজ বাতি জ্বলছে। ঠিক তখন ট্রাফিক পুলিশের হাত উঁচিয়ে দিয়ে গাড়ি থামানোর চেষ্টা। একদিকে চেষ্টা অন্যদিকে সিগন্যাল অমান্য করে গাড়ির ছুটে চলা। হাতের ইশারায় কাজ হয়নি। রাস্তার একপ্রাপ্ত থেকে অন্যপ্রাপ্ত না আসা পর্যন্ত কে কার কথা শোনে। প্রায় ৪০ সেকেন্ড পর গাড়ি থামল। ততক্ষণে জেব্রাক্রসিং ছাড়িয়ে ৫০ গজ সামনে বহর। তবুও ঝোপ বুঝে মোটরসাইকেল চালকদের ছুটে চলার চেষ্টা। শনিবার দুপুরে রাজধানীর ব্যস্ততম পয়েন্ট মগবাজার মোড়ের চিত্র এটি। চার রাস্তার সব প্রান্ত থেকেই গাড়ির সমান চাপ। কাকরাইল হয়ে মগবাজারমুখী রাস্তাটি ভিআইপি হিসেবে পরিচিত। তাই এখানে যারা নিয়মিত ট্রাফিকের কর্তব্য পালন করেন তাদের সব সময় ভিআইপিদের ব্যাপারে বাড়তি সতর্ক থাকতে হয়। এটি অঘোষিত নিয়ম। মন্ত্রী, পুলিশ ও র‌্যাবের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ সরকারী বড় বড় কর্তার অনেকেই এ সড়ক ব্যবহার করেন। তাই এই রুটে বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে গাড়ি ছাড়া হয়। যদিও হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের সামনে থেকে উড়াল সড়কের একটি লুপ মহাখালী ও সোনারগাঁও হোটেল পর্যন্ত গেলেও দিন দিন নিচের সড়কে যেন গাড়ির চাপ বাড়ছেই। বাস্তবতা হলো জাইকার অর্থায়নে মগবাজার মোড়ে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল কার্যক্রম শুরুর পাইলট প্রকল্প চলছে। এখানে ট্রাফিক পুলিশের যারা নিয়মিত ডিউটি করছেন তাদের বক্তব্য হলো নামমাত্র সিগন্যাল চলে। নিয়মানুযায়ী লাল-সবুজ আর হলুদ বাতি জ্বলছে। কিন্তু স্বয়ংক্রিয় নিয়মে সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, একেক রুটে গাড়ির চাপ একেক রকম। যে রুটে দেখা যায় লাল বাতি জ্বলে আছে সেখানে হাজারো গাড়ির লাইন। যেখানে সবুজ বাতি সেখানে দেখা যায় রাস্তা অনেকটা ফাঁকা। এর সঙ্গে ভিআইপিদের ব্যাপারে আলাদা সতর্ক থাকতে হচ্ছে। বড় সমস্যা হলো কোন রকম গবেষণা ছাড়াই স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল চালুর চেষ্টা হচ্ছে। যদি গবেষণা হতো তাহলে হয়তো কিছুটা হলেও নিয়ম মানা সম্ভব ছিল। সামনে মৌচাক, মালিবাগ রেলগেট, শান্তিনগর, কাকরাইলসহ আশপাশের সব সিগন্যাল এখন স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাপনার আওতায়। যদিও এটি নামমাত্র। ট্রাফিক পুলিশের ইচ্ছে আইনে চলছে গোটা রাজধানীর সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম। কবে নাগাদ আধুনিক সিগন্যাল পদ্ধতি চালু হবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। মূলত পাইলট প্রকল্পে বন্দী আধুনিক সিগন্যাল পদ্ধতি। একের পর এক প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। যাচ্ছে বিপুল অর্থ। অথচ কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। ২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে আরও অন্তত ২০টি সিগন্যাল রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সেগুলোর চিত্রও একই রকম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রায় ১৫ লাখ রেজিস্ট্রেশনভুক্ত যানবাহন চলছে রাজধানীতে। প্রতিদিন রাজধানীর বাইরে থেকে বিপুলসংখ্যক গাড়ি নগরীতে প্রবেশ করছে। এর বাইরে অনিবন্ধিত পরিবহন রয়েছে ১০ লাখের বেশি। এই প্রেক্ষাপটের মধ্যেও বিশে^র উন্নত শহরগুলোর মতোই ঢাকায় অন্যান্য নাগরিক সুবিধা বেড়েছে। কিন্তু যানজট ও ট্রাফিক ব্যবস্থায় একেবারেই পিছিয়ে। যা সত্যিই অবাক করার ঘটনা বলে মনে করেন। বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার মধ্য দিয়ে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা চালুর পরামর্শ দিয়ে তারা বলছেন, সিগন্যাল কার্যক্রম দ্রুত সময়ের মধ্যে ট্রাফিক বিভাগের হাতে ন্যস্ত করতে হবে। অবৈজ্ঞানিক চিন্তায় ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিলে কখনও এ সমস্যা সমাধান হবে না। সেইসঙ্গে সকল সিদ্ধান্ত দ্রুত কার্যকর করার পক্ষেও মত দিয়েছেন তারা। ট্র্রাফিক সদস্যরা জানান, কিছু সিগন্যাল বাতি রিমোটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কিন্তু সড়কে গাড়ির চাপ বেশি থাকায় ট্রাফিক সিগন্যাল মানছেন না যানবাহন চালকরা। তাদের এই অভ্যাস পরিবর্তন করতে আরও কিছু সময় লাগবে। এ জন্য সবার মাঝে ট্রাফিক সচেতনতা বেশি জরুরী। পুলিশের একাধিক সূত্র বলছে, কর্মকর্তাদের একটি পক্ষ ইচ্ছে আইনে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের পক্ষে। আধুনিক ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু হলে বিপুলসংখ্যক জনবল বেকার হতে পারে এই চিন্তা থেকেই নানা কৌশলে তা বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হচ্ছে বারবার। পর্যবেক্ষক ও সাধারণ মানুষের বক্তব্য হলো, উন্নত শহর নির্মাণে যানজট নিরসন ও ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই। বিশে^র বড় বড় সব শহরেই স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে ট্রাফিক সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে। দিন দিন আরও আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হচ্ছে এ কাজে। কলকাতা শহরেও এখন রাস্তায় খুব একটা ট্রাফিক দেখা যায় না। কেউ আইন ভঙ্গ করলে সিসি ক্যামেরায় পর্যবেক্ষণ করে চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। অনেক দেশে ট্রাফিক আইন ভঙ্গের কারণে চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্সের পয়েন্ট কাটা হচ্ছে। এক পর্যায়ে অনেকের লাইসেন্স বাতিলও করছে সরকার। অথচ রাজধানী ঢাকায় ট্রাফিক আইন ভঙ্গের মহড়া চলছে রাতদিন। সেইসঙ্গে হাত-রশি-বাঁশি নির্ভর সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ চলছেই। প্রশ্ন হলো তাহলে এতসব প্রকল্প নেয়ার সুফল কি। সিটি কর্পোরেশন ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে টানাটানি ॥ ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা দীর্ঘ সময় ধরেই সিটি কর্পোরেশনের আওতায় ছিল। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশের দায়িত্ব ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার। তাই সবকিছু পুলিশের হাতে ছেড়ে দেয়া উচিত। এ নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে রশি টানাটানি চলছে দীর্ঘদিন ধরেই। পুলিশের পক্ষ থেকেও অনেকবার দাবি করা হয়েছে তাদের হাতে সবকিছু দায়িত্ব দেয়ার। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য গত ১৬ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গভর্ন্যান্স ইনোভেশন ইউনিটের ‘ঢাকা শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন’ সংক্রান্ত এক সভায় ট্রাফিক সিগন্যালে স্বয়ংক্রিয় বৈদ্যুতিক সিগন্যাল ব্যবস্থাপনা পুলিশের কাছে হস্তান্তর সিদ্ধান্ত হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, শহরের ট্রাফিক সিগন্যালগুলো নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পুলিশের হাতে দিতে বলা হয়। এর আগে তা নিয়ন্ত্রণ করত ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি)। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিলেও এখন সার্বিক কার্যক্রম পুলিশ বিভাগকে বুঝিয়ে দেয়া হয়নি সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে। ৭২টি মোড়ে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল চালু করতে হবে ॥ ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন সূত্র জানায়, শহরের ৭২টি গুরুত্বপূর্ণ মোড় রয়েছে। এর মধ্যে ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগে ৩৪, পূর্ব বিভাগে ১২, উত্তরে ১১ ও পশ্চিমে ১৩টি ট্রাফিক সিগন্যাল রয়েছে। ২০০৯ সালের ২২ নবেম্বর এসব সিগন্যালে বাতি চালু করা হলেও অল্প দিন যেতেই তা শিথিল হয়ে যায়। পরে একে একে বিকল হয়ে পড়ে বাতিগুলো। এসব মোড়ে ২০০২ সালে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে (প্রায় ২৫ কোটি টাকা) আধুনিক ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি স্থাপন করে নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (কেইস) প্রকল্প। কিন্তু নানা ধরনের ত্রুটির কারণে এর ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়নি। গত বছরের ১৬ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশের পর ডিএসসিসি ও ডিএনসিসি থেকে সিগন্যাল বাতিগুলো ট্রাফিক পুলিশের কাছে হস্তান্তরের উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে তার আগেই ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের উদ্যোগ নেয় কেইস প্রকল্প। এ জন্য প্রায় ২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে বিদেশ থেকে রিমোট ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ আমদানি করা হয়। এখন সিগন্যালগুলো সক্রিয় করার কাজ চলছে। ইতোমধ্যে বাংলামোটর, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, কাকরাইল মসজিদ, মৎস্য ভবন, কদম ফোয়ারা, কার্জন হল (শিক্ষাভবন) ও শাহবাগ মোড়ের ট্রাফিক সিগন্যাল চলছে নতুন ব্যবস্থাপনায়। এগুলোতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ লাগানো হয়েছে। সেগুলো রিমোটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করছে ট্রাফিক পুলিশ। ডিএসসিসি সূত্র জানায়, ৭২টি স্থানেই ট্রাফিক সিগন্যাল বসানোর কথা ছিল। কিন্তু মেট্রোরেলের কারণে ৮ থেকে ১০টি স্থানে সিগন্যাল বসানো যাচ্ছে না। আর যে সাতটি স্থানে সিগন্যাল বসানো হয়েছে, সেগুলো গত বছরের ৬ ডিসেম্বর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে কারিগরি কোন ত্রুটি দেখা দিলে তা ঠিক করে দেবে কেইস প্রকল্প। পরবর্তীতে ১০০টি মোড়ে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল বাতি লাগানো হলেও কোনটাই বাস্তবে কাজে আসছে না। ওই প্রকল্প হাতে নেয়ার পর একমাত্র গুলশান-২ গোলচত্বরেই সিগন্যাল মেনেই যান চলাচল শুরু হয়। সেখানে লাল বাতি জ্বলতেই থেমে যায় গাড়ি। নির্দিষ্ট কাউন্ট-ডাউন শেষে হলুদ, এরপর জ্বলে ওঠে সবুজ সংকেত। ঠিক তখনই ঘুরতে শুরু করে চাকা। নগরীর বাকি সড়কগুলোতে ট্রাফিক পুলিশের হাতের ইশারাই মেনেই চলাচল চলে যানবাহন। অথচ সিগন্যাল বাতি মেনেই গাড়ি চলার কথা রাজধানীতে। যদিও গুলশান-২ এর আধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থা এখন আর নেই। জানতে চাইলে কেইস প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, বাংলামোটর ও হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়ে রিমোট দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে সিগন্যাল চালু করা হয়েছে। তা সফল হওয়ার পর এই সাতটি ট্রাফিক সিগন্যাল হস্তান্তর করা হয়। এর আগে পুলিশের সাতজন সদস্যকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এখন এর যথাযথ বাস্তবায়ন করবে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। বাকি সিগন্যালগুলো ঠিক করে তা নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশের কাছেই দেয়া হবে। তিনি বলেন, সকাল ও বিকেলে অফিসগামী লোকদের কারণে রাস্তায় যানজটের সৃষ্টি হয়। এই পরিস্থিতিতে পুলিশ যেদিকে গাড়ির বেশি চাপ দেখে, সেদিকে রিমোটের মাধ্যমে সময় নির্ধারণ করে দেবে। কত মিনিট সিগন্যালে থাকতে হবে, তা সিগন্যাল বাতির একটিতে দেখানো হবে। বাকি সময় রিমোট দিয়েই নির্ধারণ করা থাকবে। জনবল সঙ্কট ॥ সিগন্যাল বাতি কার্যকর রাখতে জনবল সঙ্কট চলছে। এখন ট্রাফিক কারিগরি জনবল ৩৯ জন, সহকারী প্রকৌশলী, প্রকৌশলীসহ সিগনাল টেকনিশিয়ানদের ট্রেনিং হচ্ছে। তারা সিগনাল ইনস্টল করা, সিগনাল নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে কাজ করবে। আর তারা এটা করতে পারলেই ট্রাফিক সিগনাল সরাসরি ডিএমপি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, প্রয়োজন ড্যাস বোর্ডভিত্তিক, সিসিটিভিভিত্তিক অনেক দূর পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে কোন জায়গায় কতক্ষণের কতটুকু সিগন্যাল বাতি দেয়া উচিত, সেজন্য একটা ব্যবস্থাপনা চালু করা। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ট্রাফিক পুলিশই যেন তার পেশাজীবী জনবল নিয়ে এটা করতে পারে, সেই সক্ষমতা তাকে অর্জন করা দরকার। যাচ্ছে কোটি টাকা, সুফল নেই ॥ রাজধানীতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপিত স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল বাতি অব্যবহৃত হয়ে পড়ে আছে। সেগুলো কার্যত কাজেই লাগছে না। অথচ এই বাতিগুলোর বিদ্যুত খরচ, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজে প্রতিমাসে প্রায় কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। এই অর্থ ব্যয় করা হয় সিটি কর্পোরেশন থেকে। সংশ্লিষ্টরা জানান, সিটি কর্পোরেশন ও ট্রাফিক বিভাগের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণে ট্রাফিক সিগন্যাল বাতিতে সফলতা আসছে না। রয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নকারীদের মধ্যেও আন্তরিকতার অভাব। যে কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে প্রকল্পটি। ট্রাফিক সিগন্যালকে পুলিশের হাতে ছেড়ে দেয়া উচিত ॥ যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, ‘ভবিষ্যতে সিগন্যালের ব্যাপারে এককভাবে দায়ী থাকবে পুলিশ। সিটি কর্পোরেশন থেকে সম্পূর্ণ ট্রাফিক সিগন্যালকে আলাদা করে পুলিশের হাতে ছেড়ে দেয়া উচিত। প্রয়োজনে তাদের লোকবল দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, রাজধানীতে যানজটের সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে নিয়ম না মানার অভ্যাস। সিগন্যালের যন্ত্র তো যন্ত্রের মতোই কাজ করবে। সেক্ষেত্রে সিগন্যাল বাতি প্রতিস্থাপন করতে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রও লাগাতে হবে। যেন কেউ সিগন্যাল অমান্য করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মামলাও করা যায়। জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মীর রেজাউল আলম বলেন, ‘বিশ্বে ট্রাফিক পুলিশই এই কাজ করে। তবে শতভাগ সুফল পেতে ধীরে ধীরে পুরো দায়িত্ব পুলিশের হাতে তুলে দেয়া দরকার। সড়কের আয়তনের তুলনায় ঢাকায় গাড়ির সংখ্যা অনেক বেশি। উন্নয়নমূলক কাজের জন্য কোনটাই সঠিকভাবে পালন করা যাচ্ছে না। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে কী করা যায়, তা নিয়ে নতুন করে ভাবা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। পাইলট প্রকল্পে বন্দী সিগন্যাল পদ্ধতি ॥ ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, গুলিস্তান, ফুলবাড়িয়া, পল্টন, গুলশান-১সহ চারটি ইন্টার সেকশনে ইতোমধ্যে অটোমেটিক ট্রাফিক সিগন্যাল সিস্টেম বাস্তবায়নের কাজ চলছে। এজন্য ট্রাফিক বিভাগে নিয়োজিতরা লোকজন সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমরা এর সফলতা পর্যবেক্ষণ করছি। যদি সুফল মিলে তাহলে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য ইন্টার সেকশনগুলোতেও অটো সিগন্যাল সিস্টেম কার্যকর করার উদ্যোগ নেব। তিনি বলেন, মগবাজার-মৌচাক উড়াল সড়কের ছয়টি ইন্টার সেকশন জাইকার অর্থায়নে অটোসিগন্যাল সিস্টেম কার্যকর করার চেষ্টা চলছে। অনেক সময় দেখা যায় গাড়ির চাপ বেশি থাকায় সিগন্যাল পদ্ধতি লাগাতার কার্যকর করা কঠিন হয়। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ধরেন ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় গাড়ি চলাচল অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু অন্যান্য সড়কে দিন দিন পরিবহনের চাপ বাড়ে। তাই একদিক নিয়ম মানা হলে অন্যদিকে যানজট বেড়ে যায়। ফলে সবকিছু আমাদের পর্যবেক্ষণের মধ্যে রয়েছে। মূলত কথা হলো গাড়ির সংখ্যা সহনীয় না হলে অটোসিগন্যাল চালানো খুবই কষ্টসাধ্য। এর বিকল্প হিসেবে রিমোট কন্ট্রোল পদ্ধতি বা সুইচ দিয়ে সিগন্যাল চালু বন্ধের ব্যবস্থার কথাও চিন্তা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ট্রাফিক বিভাগের প্রকৌশল ইউনিট এখন সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। পুলিশের ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিট চালুর বিষয়টি ইতোমধ্যে অনুমোদন হয়েছে। পুরো বিষয়টি আমাদের হাতে আসলে অটোসিগন্যাল ব্যবস্থা কার্যকর করার বিষয়টি আরও দৃশ্যমান হবে। বিশে^র অন্যান্য উন্নত শহরের সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে ঢাকা এগিয়ে গেলেও যানজটের সমস্যা আমাদের প্রকট। রাজধানী শহরে যা হবার কথা নয়। আগে থেকে পরিকল্পনামাফিক কাজ না হওয়ায় এ সমস্যা বড় আকার ধারণ করেছে। এখন দ্রুত সময়ের মধ্যে ইচ্ছা করলেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে পর্যায়ক্রমে এগিয়ে যেতে হবে। আশাকরি আগামী দিনগুলোতে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত হবে। তিনি বলেন, অটোমেটিক সিগন্যাল চালুর ক্ষেত্রে কিছু প্রক্রিয়া বাকি আছে। সেটা সম্পন্ন হলে চলতি বছরের মধ্যেই পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অধীনে চলে আসবে। সেটা আসার পরে আমরা টেকনিক্যাল লোক নিয়োগ করব। পরবর্তীতে আমরা স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক কন্ট্রোল ব্যবস্থা চালু করার জন্য টেন্ডার আহ্বান করব। আগামী দু’এক বছরের মধ্যে পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক পদ্ধতি চালু করা সম্ভব হবে বলেও জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা। বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা ছাড়া স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল পদ্ধতি বাস্তবায়ন হবে না ॥ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট নগরবিদ নূরুল ইসলাম নাজেম বলেন, আমরা সাম্প্রতিক সময়ে দেখলাম ঢাকার আধুনিক সিগন্যাল সিস্টেম চালুর জন্য বিশ^ব্যাংক বিপুল পরিমাণে অর্থায়ন করে। যা দিয়ে ২৫টি অটোসিগন্যাল চালু করা হয়। কিন্তু পুলিশ অটোমেটিক সিগন্যাল পদ্ধতি মানে না। তারা ইচ্ছামতো সিগন্যাল চালায়। এটা মনে রাখা উচিত যানবাহন নিয়ন্ত্রণে ম্যানুয়েল পদ্ধতি মেট্রোপলিটনে চলে না। এতে যানজট আরও বাড়ে। এটা প্রমাণিত। কিন্তু আমরা সনাতনী পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না। অটোসিগন্যাল চালুর ক্ষেত্রে সময় নির্ধারণ করা একটি বড় বিষয় একথা উল্লেখ করে এই নগরবিদ বলেন, সময় নির্ধারণের বিষয়টি ঠিক করতে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা প্রয়োজন। যেমন মগবাজার কিংবা বাংলামোটর ইন্টার সেকশন। এখানে কোন পাশে গাড়ির চাপ কম-বেশি তা ঠিক করতে হবে। সে অনুযায়ী সিগন্যাল নির্ধারণ করতে হবে। যদি এমন হয় যেদিকে চাপ বেশি সেদিকে সময় কম দেয়া হলো, আর যেদিকে চাপ কম সেদিকে সময় বাড়িয়ে দেয়া হলো। তাহলে সমস্যার সমাধান মিলবে না কোনদিন। বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা ছাড়া পৃথিবীর কোন দেশই স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল পদ্ধতি কার্যকর সম্ভব হয়নি। শাহবাগ, কাওরানবাজার, গুলশান-১ ও ২, মতিঝিল, সাইন্সল্যাব, নিউমার্কেট ছাড়াও বিশেষ স্থানগুলোতে সিগন্যাল যদি সমান সমান বা কমবেশি হয় তাহলে সমস্যা আরও বাড়বে। বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা ছাড়া অটোমেটিক সিগন্যাল কার্যকর হবে না। তিনি বলেন, পপুলেশন ওয়াইজ চিন্তা করলে বিশে^র উন্নত শহরগুলোর মতোই আমাদের ঢাকা শহরের অবস্থান। কিন্তু অবাক করা বিষয় হল যানজট নিরসন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এখন ট্রাফিক পুলিশের হাতনির্ভর সিগন্যাল ব্যবস্থা। এটা কখনই মেনে নেয়া যায় না। এজন্য তিনি ট্রাফিক পুলিশের ব্যবস্থাপনার ত্রুটি ও স্বদিচ্ছার অভাবকেই দায়ী করেন। যে কোন মূল্যে সিগন্যাল পদ্ধতি আধুনিক করতে হবে। বিজ্ঞানসম্মত গবেষণার মধ্য দিয়ে এর বাস্তবায়ন সম্ভব বলেও মনে করেন তিনি। প্রাইভেট গাড়ির চাপ কমানো জরুরী ॥ ঢাকা মহানগর দক্ষিণ (ট্রাফিক) উপ-পুলিশ কমিশনার জয়দেব চৌধুরী স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল পদ্ধতি চালুর ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতা তুলে ধরে বলেন, বিশে^র উন্নত অনেক শহরে কখন গাড়ি চলাচলে হ্রাস হবে কখন বাড়বে তা নির্ধারিত থাকে। ঢাকায় সব সময় গাড়ি চাপ বেশি থাকে। সময় সময় তা মাত্রা ছাড়ায়। তাই কোন সিগন্যাল কত সময় চালু বা বন্ধ রাখতে হবে তা অনুমান করা কষ্টকর। তবে উন্নত শহরের আদলে ঢাকাকে গড়ে তুলতে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা চালুর বিকল্প নেই বলেও মনে করেন তিনি। বলেন, ভিআইপি প্রটোকল থাকলে পুরো সড়কে সৃষ্টি হওয়া যানজট নিরসন করতে অনেক সময় লাগে। তবে মেট্রো রেল চালু হলে আধুনিক সিগন্যাল পদ্ধতি চালু করা অনেকটাই সম্ভব হবে। এখন যানজট সহনীয় রাখতে আমরা চেষ্টা করছি মেয়াদোত্তীর্ণ খারাপ বাসগুলো বন্ধ করে এসি বা নতুন নতুন আধুনিক বাস নামাতে। এতে প্রাইভেটকারের ব্যবহার কমতে পারে। প্রাইভেট গাড়ির ব্যবহার কমলে চলমান সমস্যার অনেকটাই সুফল মিলবে। বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্কুল বাস চালুর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, একজন শিক্ষার্থীর জন্য একটি প্রাইভেটকার ব্যবহার করা হচ্ছে। অথচ একটি বাসে অন্তত ১০০ শিক্ষার্থী পরিবহন সম্ভব। এই নিয়ম চালু করা গেলে সড়কে গাড়ির চাপ কমে আসবে। তাছাড়া আবাসিক এলাকায় স্কুল ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলার কারণে ধানম-ি, গুলশানসহ অন্যান্য এলাকাতেও যানজটের সমস্যা বাড়ছে। এসব সমস্যা সমাধানে একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনারও তাগিদ দেন এই ট্রাফিক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, সিঙ্গাপুরের আদলে আমরা ঢাকা শহরের সড়কগুলোতে ঢেলে সাজাতে চাই। এজন্য নতুন নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও অর্থায়নের সুযোগ সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। আস্তে আস্তে নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে বলেও জানান তিনি। বলেন, আমি বিশ^াস করি একটা সময় এনালগ পদ্ধতি থেকে রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বেরিয়ে এসে ডিজিটালে রূপ নেবে।
×