ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৮ জুন ২০২৫, ৪ আষাঢ় ১৪৩২

আব্দুস সামাদ মণ্ডল: ইতিহাস সংরক্ষণের এক নীরব সাক্ষী

লুবনা শারমিন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ।

প্রকাশিত: ১২:৫৯, ১৬ মে ২০২৫

আব্দুস সামাদ মণ্ডল: ইতিহাস সংরক্ষণের এক নীরব সাক্ষী

ছবি: জনকন্ঠ

তাঁকে আর ধরাছোঁয়া যাবে না। শোনা যাবে না তাঁর প্রাচীন ইতিহাসের গল্প, শোনা যাবে না ইতিহাসের নিদর্শন সংগ্রহ করতে গিয়ে লোমহর্ষক কাহিনী। মাত্র কিছুদিন আগেই চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন তিনি। শেষ বিদায়ের আগেও বয়সের ভার তাঁকে কাবু করতে পারেনি। দুচোখে স্বপ্ন বুনতেন। আবার তিনি সময় কাটাবেন ইতিহাসের পাতায় ঘুরে ঘুরে। প্রত্নতত্ত্ব, প্রত্নসম্পদের নেশায় বুদ হয়ে থেকেই জীবনের শেষ সময়টা কাটাবেন। অদম্য আগ্রহ আর উদ্যম ছিলো ঠিক চোখে পড়ার মতোই। যখন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহ করতে গিয়ে তিনি দুবার গোখরা সাপের ছোবল থেকে বেঁচে ফিরেছেন। দুনির্বার হয়ে আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়িয়েছেন প্রত্নতত্ত্বের সন্ধানে। সমস্ত ভয়, আশঙ্কার উর্ধ্বে চলে গিয়েছিলেন তিনি। আর এখন জাগতিক সমস্ত ভয়, জরা, ব্যাধির উর্ধ্বে। উর্ধ্বালোকে চলে গিয়েছেন তিনি। যাওয়ার আগে তিনি দিয়ে গেছেন জীবনের শেষ সাক্ষাৎকার। নতুন প্রজন্মের কাছে শুনিয়েছেন তাঁর অদম্য যাত্রার গল্প। ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে চেয়েছেন প্রাচীন ইতিহাসের কাহিনীছড়াতে চেয়েছেন জ্ঞানের আলো। তাইতো জ্ঞানার্জন জ্ঞান ছড়িয়ে দেবার নিমিত্তে নিজ বাড়িতে গড়েছেন প্রায় পনর হাজার বইয়ের এক বৃহৎ ভাণ্ডার একটি বিশাল পাঠাগার।

আব্দুস সামাদ মণ্ডল।  রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রতিষ্ঠিত বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের সংগ্রাহক। জাদুঘরটির প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহশালার অনেকটা তাঁর হাতেই সমৃদ্ধ। তিনি চাইতেন প্রাচীন বাংলার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, মূর্তি, পাণ্ডুলিপি এবং ঐতিহাসিক নিদর্শনে আরও সমৃদ্ধ হোক। এসব সংগ্রহের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ নির্দশনই আব্দুস সামাদ মণ্ডল একাই সংগ্রহ করেছিলেন। বয়সের ভারে শরীর নুয়ে পড়লেও জাদুঘর, প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশন নিয়ে কথা বলার সময় তাঁর চোখ যেনো চকচকে হয়ে উঠছিলো। তাঁর দুচোখে ভেসে উঠছিলো সেসব দিনের কথা। যখন ঝড়-ঝঞ্ঝাকে তুচ্ছ করে এসব নিদর্শন সংগ্রহ করতেন। কখনো রাত কাটিয়েছেন গাছতলায়, কখনো বৃষ্টিতে ভিজেছেন। কখনো প্রাণনাশের হুমকিও পেয়েছেন। তবু তিনি দমে যাননি। ইতিহাসের নিদর্শনকে সংরক্ষণ করতে সব বাধাবিপত্তিও তুচ্ছ করেছেন। রাজশাহীর বাসায় বসে কথা বলতে বলতেই দুচোখ চলে যাচ্ছিলো সেই সুদূর অতীতে। সেই অতীত তাঁর চোখের সামনে মূর্তমান হয়ে উঠছিলো যেনো।

কথা বলতে বলতেই তিনি জানাচ্ছিলেন, ‘নিদর্শন সংগ্রহ করতে গিয়ে আমাকে অনেক বাধা পেরোতে হয়েছে। বিভিন্ন সংবাদপত্র থেকে প্রত্নতত্ত্বের সন্ধান পেয়েছিলাম। এছাড়া তাবলীগে যুক্ত থাকার ফলে বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে পুরাকীর্তি প্রত্নতত্ত্বেও খোঁজ নিতাম এবং সেগুলো কৌশলে সংগ্রহ করে এনেছি।

আব্দুস সামাদ মণ্ডলের জন্ম ১৯৪৮ সালে রাজশাহীর কানপুকুরে। ছোটবেলা থেকেই পুরনো ঐতিহ্য, নিদর্শনের প্রতি একটা আলাদা মায়া, অসম্ভব মোহ কাজ করতো। আর এই মায়া, টানই তাকে নিয়ে যায় প্রত্নতত্ত্ব, ইতিহাসের প্রাচীন ভুবনে। ইতিহাস বিষয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করার পর আবার তিনি ইসলামের ইতিহাস সংস্কৃতিতে দ্বিতীয় মাস্টার্স করেছেন। ইতিহাসের মাঝেই আনন্দ খুঁজে পেতেন তিনি। প্রত্নতত্ত্ব সংগ্রহের প্রয়োজনে তিনি পনরটি ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন। ১৯৭৭ সালে তিনি রাজশাহী বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে প্রত্নতত্ত্ব সংগ্রাহক হিসেবে যোগদান করেন এবং ২০০৯ সালে অবসর গ্রহণ করেন।  তবু অবসর গ্রহণের পরও তিনি জাদুঘরের মায়া কাটাতে পারতেন না। নিয়মিত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো যত্ন করা দেখাশোনার জন্য জাদুঘরে যেতেন। কাজের প্রতি নিষ্ঠা ভালোবাসা দেখে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য তাঁকে ২০০৯ সালের অক্টোবর পুনরায় প্রত্নতত্ত্ব সংগ্রাহক হিসেবে দুই বছরের জন্য নিয়োগ দেন। পাশাপাশি তিনি ২০০৯ সালে শ্রম নিষ্ঠার স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমি কর্তৃক সম্মানসূচক ফেলোশিপ লাভ করেছেন।

জীবনের শেষ সময়ে শরীরের ডান অংশ ছিলো পক্ষাঘাতগ্রস্ত, চোখেও দেখতেন খুব কম আর শ্রবণশক্তিও আগের মতো ছিলো না আবদুস সামাদ মণ্ডলের। তবুও তাঁর সেই প্রবল ইচ্ছাশক্তি তাঁকে বাঁচার স্বপ্ন দেখাতো। তিনি স্বপ্ন দেখতেন আবারও বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে যাবেন, তাঁর নিজ হাতে সংগ্রহ করা প্রত্নতত্ত্বের মাঝে আবার নিজেকে খুঁজে পাবেন। জাদুঘরটি যে তাঁর দ্বিতীয় বাড়ি, সেকেণ্ড হোম! ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি নিয়েও তিনি বই পড়ে সময় কাটাতেন, বইয়ের পাতায় ইতিহাসকে খুঁজতেন, যেমন করে সারা বাংলাদেশে চষে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে প্রত্নতত্ত্ব সংগ্রহ করতেন।

বাংলাদেশের সমৃদ্ধ ইতিহাস সংস্কৃতির সংরক্ষণে অসামান্য অবদান রাখা আব্দুস সামাদ মণ্ডল ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহাসিক। ১৯১০ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজশাহীর বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর বাংলাদেশের প্রথম প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর যার  উন্নয়নে আব্দুস সামাদ মণ্ডলের অবদান অনস্বীকার্য। বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের সাথে একাত্ন হয়ে যাওয়া এই মানুষটি ২০২৪ সালের ১৫ নভেম্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। স্বীকৃতির আশা না করে অকাতরে সেবা দিয়ে ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকা পরপারে পাড়ি জমানো আব্দুস সামাদ মণ্ডল বরাবর অগোচরেই থেকেছেন। সত্যিকার নিঃস্বার্থ এই মানুষটি নিভৃতচারী হয়েই নিঃশব্দে চলে গেছেন পৃথিবীর অন্তরালে।

মুমু

×