ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধাপরাধী বিচার;###;পলাতকদের গ্রেফতার করে রায় কার্যকর করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপির প্রতি নির্দেশ

ঘোড়ামারা আজিজসহ ৬ রাজাকারের ফাঁসি

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ২৩ নভেম্বর ২০১৭

ঘোড়ামারা আজিজসহ ৬ রাজাকারের ফাঁসি

বিকাশ দত্ত ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গাইবান্ধার সাবেক সংসদ সদস্য জামায়াত নেতা আবু সালেহ মুহাম্মদ আব্দুল আজিজ মিয়া (৬৫) ওরফে ঘোড়ামারা আজিজসহ ছয় আসামিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- প্রদান করেছে ট্রাইব্যুনাল। এক নম্বর অভিযোগে আসামিদের আমৃত্যু কারাদ- এবং দুই ও তিন নম্বর অভিযোগে মৃত্যুদ- প্রদান করা হয়েছে। এর আগে গত ২৩ অক্টোবর মামলার প্রসিকিউশন ও আসামিপক্ষে যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপন শেষে রায় ঘোষণা অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখা হয়। মামলার অপর পাঁচ আসামি হলো রুহুল আমিন ওরফে মঞ্জু (৬৩), আবু মুসলিম মোহাম্মদ আলী (৬০), নাজমুল হুদা (৬২) ও আব্দুর রহিম মিঞা ও আব্দুল লতিফ (৬৩)। আব্দুল লতিফ ছাড়া সবাই পলাতক। পলাতক আসামিদের গ্রেফতার করে সাজা কার্যকর করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের আইজিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে । চেয়ারম্যান বিচারপতি মোঃ শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ বুধবার এ আদেশ প্রদান করেছে। ট্রাইব্যুনালে অন্য দুই সদস্য ছিলেন বিচারপতি আমির হোসেন ও বিচারক মোঃ আবু আহম্মেদ জমাদার। সংশ্লিষ্ট মামলায় প্রসিকিউটর ছিলেন ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। আসামিদের পক্ষে ছিলেন এ্যাডভোকেট খন্দকার রেজাউল আলম, গাজী এম এইচ তামিম। এটি ট্রাইব্যুনালের ২৯ তম রায়। নিয়ম অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালের মামলায় রায়ের এক মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ আদালতে আপীল করা যাবে। পলাতক পাঁচ আসামিকে সে সুযোগ নিতে হলে আত্মসমর্পণ করতে হবে। বুধবার বেলা সাড়ে দশটার আদালত বসার পর গাইবান্ধার ছয় আসামির রায় পড়া শুরু হয়। গ্রেফতার হওয়া একমাত্র আসামি আব্দুল লতিফকে তার আগেই কারাগার থেকে আদালতে আনা হয়। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম প্রারম্ভিক বক্তব্যে জানান, এ মামলায় তারা যে রায় দিচ্ছেন, তা ১৬৬ পৃষ্ঠার। পরে ট্রাইব্যুনালের বিচারক আবু আহমেদ জমাদার রায়ের সারসংক্ষেপের প্রথম অংশ পড়া শুরু করেন। বিচারপতি আমির হোসেন পড়েন রায়ের দ্বিতীয় অংশ। সবশেষে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান সাজা ঘোষণা করেন। রায়ের পর আসামি লতিফকে আদালত থেকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। আদালতে তার পরনে ছিল কালো প্যান্ট ও সাদা শার্ট। রায়ের পর প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন বলেন, রায়ে আমরা সন্তুষ্ট । ন্যায্য বিচার পেয়েছি। ঘোড়ামারা আজিজ রাজাকার কমান্ডার ছিলেন, এটি রায়ে প্রমাণিত। যে অপরাধ হয়েছে সব অপরাধে ওনার প্রত্যক্ষভাবে অর্থাৎ সে ‘কুখ্যাত’ কমান্ডার হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ঘটনা কেউ বেশি কেউ কম করেছে। কিন্তু যৌথভাবে পরিকল্পনা করে ঘটনাগুলো ঘটানো হয়েছে। এ কারণে শাস্তি কোনভাবে কমবে না। তিনি বলেন, ঘোড়ামারা আজিজ মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছে। তিনি তার এলাকার অপরাধের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তেমনি ২০১৩ সালে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে হরতাল-অবরোধের সময় পুলিশ ক্যাম্পে আব্দুল আজিজের নেতৃত্বে হামলা হয়েছে। তাকে ফাঁসির সাজা দিয়ে ট্রাইব্যুনাল যে রায় দিয়েছে এতে রাষ্ট্রপক্ষ সন্তুষ্ট। অন্যদিকে পর লতিফের আইনজীবী খন্দকার রেজাউল আলম বলেন, আমরা ন্যায়বিচার পাইনি। আমরা এই রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করব। পলাতক আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী গাজী এম এইচ তামিম বলেন, প্রসিকিউশন এ মামলায় যেসব সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করেছে তাতে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে না। পলাতক আসামিরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আত্মসমর্পণ করে আপীল বিভাগে আপীল করবেন। সাক্ষ্য-প্রমাণ বিবেচনায় তারা খালাস পেতে পারেন। এটি হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ২৯তম রায়। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর মামলাটি নিয়ে মোট ২৯টি মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। এই সব মামলায় ৬১ আসামি ছিলেন। দ- দেয়া হয়েছে ৫৯ জনকে। দুজন আসামি সোলায়মান মোল্লা ও আব্দুল লতিফ রায় ঘোষণার আগেই মারা যান। এই ৫৯ জনের মধ্যে ৩৬ জনকে মৃত্যুদ-, ২০ জনকে আমৃত্যু কারাদ-, একজনকে যাবজ্জীবন কারাদ- প্রদান ও একজনকে ৯০ বছরের দ- প্রদান করা হয়। দ-প্রাপ্ত ও তদন্তাধীন মোট ৮১ আসামি পলাতক রয়েছে। গাইবান্ধার এ ৬ আসামির তিন অভিযোগের মধ্যে প্রথমটিতে গাইবান্ধার মৌজামালি বাড়ি গ্রামে গিয়ে লুটপাট, স্বাধীনতার পক্ষের লোকজনকে আটক, অপহরণ ও নির্যাতন এবং পরে দাড়িয়াপুর ব্রিজে নিয়ে একজনকে হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলে হত্যার ঘটনায় আসামিদের আমৃত্যু কারাদ- দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল দ্বিতীয় অভিযোগে সুন্দরগঞ্জ থেকে ছাত্রলীগ নেতা মোঃ বয়েজ উদ্দিনকে ধরে মাঠেরহাট রাজাকার ক্যাম্প এবং থানা সদরে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে আটকে রেখে নির্যাতন এবং পরে গুলি করে হত্যা করে তার লাশ মাটিচাপা দেয়ার ঘটনায় ছয় আসামির সবাইকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছে। তৃতীয় অভিযোগে সুন্দরগঞ্জ থানার পাঁচটি ইউনিয়নে স্বাধীনতার পক্ষের ১৩ চেয়ারম্যান ও মেম্বারকে আটক করে নির্যাতন এবং পরে নদীর ধারে নিয়ে গুলি করে হত্যার ঘটনাতেও আসামিদের সবার মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছে। মামলার কার্যক্রম গত ১৬ এপ্রিল মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউশনের আনা সব সাক্ষীর জবানবন্দী ও জেরার কার্যক্রম শেষ করার পর যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য ৮ মে দিন নির্ধারণ করেছিল ট্রাইব্যুনাল। ওই দিন ট্রাইব্যুনালের নির্ধারিত দিনে ঘোড়ামারা আজিজসহ আসামিদের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগের বিষয়ে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউশন। পরে ৯ মে আসামিপক্ষের আইনজীবী গাজী এমএইচ তামিম পাল্টা যুক্তিতর্ক শেষ করেন। উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হওয়ায় পর রায় ঘোষণার জন্য মামলাটি অপেক্ষমাণ রাখে আদালত। বিচারপতি আনোয়ারুল হক মৃত্যুবরণ করায় ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। নবগঠিত ট্রাইব্যুনাল মামলাটি পুনরায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য দিন ধার্য করে আদেশ দিলে পুনরায় প্রসিকিউশন যুক্তিতর্ক শুরু করে। আসামি আজিজসহ গাইবান্ধার ছয়জনের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়। ওই বছরের ২৩ নবেম্বর প্রসিকিউশনের করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২৬ নবেম্বর ট্রাইব্যুনাল ছয়জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। এ মামলায় মাত্র এক আসামিকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় পুলিশ। পরে ঘোড়ামারা আজিজসহ সব আসামিকে পলাতক দেখিয়েই আদালতে মামলার বিচারিক কাজ শুরু হয়। জানা গেছে, জামায়াতের কেন্দ্রীয় সদস্য আব্দুল আজিজ মিয়া ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত চারদলীয় জোটের অধীনে জামায়াত থেকে গাইবান্ধা সুন্দরগঞ্জ-১ আসনে সংসদ সদস্য ছিলেন। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলাসহ ১৩টি মামলা হয়। সুন্দরগঞ্জ থানা শাখার জামায়াতের সক্রিয় সদস্য রুহুল আমিন ওরফে মঞ্জুর বিরুদ্ধে দুটি মামলা রয়েছে। এছাড়া উপজেলা জামায়াত নেতা আব্দুল লতিফের বিরুদ্ধে সুন্দরগঞ্জ থানায় মানবতাবিরোধী অপরাধসহ তিনটি মামলা হয়। আবু মুসলিম মোহাম্মদ আলী মুক্তিযুদ্ধের আগে ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা ছিলেন। পরে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়। ১৯৭০ সাল থেকে জামায়াতের কর্মকা-ে জড়িত নাজমুল হুদার বিরুদ্ধেও দুটি মামলা রয়েছে। আব্দুর রহিম মিঞা মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতের কর্মী ছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি কোন রাজনৈতিক কর্মকা-ে জড়িত ছিলেন, এমন তথ্য পাওয়া যায়নি। তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা রয়েছে। তিন অভিযোগ প্রথম অভিযোগ: ’৭১-এর ৯ অক্টোবর সকাল ৮ বা সাড়ে ৮টার সময় আসামিরা পাকিস্তানের দখলদার সেনাবাহিনীর ২৫/৩০ জনকে সঙ্গে নিয়ে গাইবান্ধা জেলার সদর থানাধীন মৌজামালি বাড়ি গ্রামে হামলা চালিয়ে চার নিরীহ, নিরস্ত্র স্বাধীনতার পক্ষের মানুষকে আটক, নির্যাতন ও অপহরণ করে। পরে তাদের দাড়িয়াপুর ব্রিজে নিয়ে গণেশ চন্দ্র বর্মণের মাথার সঙ্গে হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলে দিয়ে হত্যা করে এবং বাকিদের ছেড়ে দেয়। আসামিরা আটকদের বাড়ির মালামাল লুণ্ঠন করে। দ্বিতীয় অভিযোগ: ওই দিন বিকেল ৪টার দিকে আসামিরা সুন্দরগঞ্জ থানার মাঠেরহাট ব্রিজ পাহারারত ছাত্রলীগের নেতা মোঃ বয়েজ উদ্দিনকে আটক করে মাঠেরহাটের রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করে। পরদিন সকালে আসামিরা বয়েজকে থানা সদরে স্থাপিত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তিন দিন আটক রেখে নির্যাতনের পর ১৩ অক্টোবর বিকেলে তাকে গুলি করে হত্যা করে লাশ মাটিচাপা দেয়া হয়। তৃতীয় অভিযোগ: ’৭১-এর ১০ অক্টোবর থেকে ১৩ অক্টোবর আসামিরা পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর সহযোগিতায় সুন্দরগঞ্জ থানার পাঁচটি ইউনিয়নে স্বাধীনতা পক্ষের ১৩ চেয়ারম্যান ও মেম্বারকে আটক করে। তাদের তিন দিন ধরে নির্যাতন করার পর পাকিস্তানী সেনাদের ক্যাম্পের কাছে নদীর ধারে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে এবং লাশ মাটিচাপা দেয়। সেখানে ওই শহীদদের স্মরণে একটি সৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। সংশোধনী ॥ গত ২১ নবেম্বর দৈনিক জনকণ্ঠের শেষের পাতায় ঘোড়ামারা আজিজসহ ৬ আসামির মামলার রায় আজ শিরোনামে নিউজের এক জায়গায় ভুলবশত অবসরোত্তর ছুটিতে থাকা ঢাকার বিশেষ জজ মোঃ আবু আহম্মেদ মজাদার, আরেক জায়গায় আসামি পক্ষের আইনজীবীর নামের পাশে মোঃ শাহিনুর ইসলাম ছাপা হয়েছে। অনিচ্ছাকৃত এই ভুলের জন্য দুঃখিত। আসলে হবে ট্রাইব্যুনালের সদস্য বিচারক মোঃ আবু আহম্মেদ জমাদার। অন্যদিকে মোঃ শাহিনুর ইসলাম হবে না।
×