ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মিনা ট্র্যাজেডির প্রভাব

সৌদিতে কোরবানির ঈদে ছিল না উৎসব আমেজ

প্রকাশিত: ০৫:১১, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫

সৌদিতে কোরবানির ঈদে ছিল না উৎসব আমেজ

বাবুল হোসেন, মক্কা থেকে ॥ সৌদি আরবে এবারের কোরবানির ঈদে ছিল না উৎসব আমেজ। রঙিন পোশাকে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতেও দেখা যায়নি কোন হাজীকে। বৃহস্পতিবার মিনায় মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় সাত শতাধিক হাজী নিহত হওয়ায় হজে আসা বিশ্বের সকল হাজী ছিলেন শোকার্ত। শোকের কালোছায়া নেমে আসে মিনা থেকে মক্কা পর্যন্ত সবখানে। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা হাজীদের মধ্যে কোরবানি করার ইচ্ছা থাকলেও তা ফিকে হয়ে যায়। এজন্য হাজীদের মক্কা বা অন্য কোন শহরে কোরবানির জন্য নির্ধারিত স্থানে যেতে দেখা যায়নি। যদিও হাজীরা পবিত্র মক্কায় মসজিদুল হারামে ছাগল ও দুম্বা কোরবানি দিতে আগাম টাকা জমা দেন। তবে হাজীদের উট কোরবানি দেয়ার প্রবল ইচ্ছা থাকলেও এ বছর মার্স রোগের আশঙ্কায় বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। সৌদি কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে আগাম বিধিনিষেধ আরোপ করায় হাজীরা উট কোরবানি দিতে পারেননি। কোরবানি উপলক্ষে বাংলাদেশসহ এশীয় অঞ্চলের হাজীদের মধ্যে আনন্দ উপভোগ করার ইচ্ছা থাকলেও মিনায় ভয়াবহ ট্র্যাজেডির কারণে কোন আগ্রহ বা ব্যাকুলতা দেখা যায়নি। ঝালকাঠির মুক্তিযোদ্ধা হাজী মকবুল হোসেন তালুকদার জানান, ঈদের আনন্দ ম্লান করে দিয়েছে ‘মিনা ট্র্যাজেডি’। মিনাতে তো বটেই, দেশে কীভাবে স্বজনেরা ঈদ করেছে খোঁজ নিতে ইচ্ছে করেনি হাজী মকবুলের। ময়মনসিংহ থেকে সরকারী ব্যবস্থাপনায় হজে আসা কৃষক লীগ নেতা হাজী ইউসুফ আলী আক্ষেপ করে জানান, হজ করতে আসা এতগুলো হাজীর একসঙ্গে মৃত্যু কিছুতেই মেনে নেয়া যাচ্ছে না। কীভাবে ঈদের দিন চলে গেছে টের পাইনি। দেশ থেকে ফোন করে স্বজনেরা জানতে চেয়েছে কেমন আছি। জানা যায়, পবিত্র হজের অংশ হিসেবে ৯ জিলহজ দুপুরের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত হাজীদের আরাফাতের ময়দানে ও রাতে মিনার মুজদালিফায় অবস্থান করা ওয়াজিব। ১০ জিলহজ সকল হাজী ফজরের নামাজ পড়ে সূর্যোদয়ের কিছু আগে মুজদালিফা ছেড়ে মিনার জামারায় শয়তানের উদ্দেশে পাথর নিক্ষেপ করেছেন। জামারা হলো মিনার ময়দানে অবস্থিত তিনটি স্তম্ভ। এগুলো হচ্ছে- জামারাতুল উলা বা ছোট জামারাহ, জামারাতুল উসতা বা মধ্যম জামারাহ এবং জামারাতুল কোবরা বা বড় জামারাহ। এদিন পাথর নিক্ষেপের পর হাজীদের পরবর্তী কাজ ছিল কোরবানি করা। যদিও এ উপলক্ষে বাংলাদেশসহ বিশ্বের দেড় শতাধিক দেশ থেকে আসা অধিকাংশ হাজী আগেই কোরবানি দিতে ৪৭৫ রিয়াল বিভিন্ন ব্যাংক ও পোস্ট অফিসের মাধ্যমে জমা দেন। এজন্য তাদের দুম্বা, ছাগল, খাসি কেনার জন্য বাজারে কিংবা জবাইয়ের জন্য নির্ধারিত স্থানে যেতে হয়নি। কোরবানির পর এসব মাংস সৌদি সরকার সংরক্ষণ করে পরবর্তীতে বিভিন্ন মুসলিম দেশে উপহার হিসেবে পাঠায়। তবে কেউ কেউ বাজার থেকে দুম্বা কিনে নির্ধারিত স্থানে নিজের সামনে জবাই করে কোরবানি দিয়েছেন। শয়তানকে পাথর মারার পর হাজীরা কাবা শরিফের তাওয়াফ শুরু করেন হাজরে আসওয়াদ থেকে। ভিড়ের কারণে হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ বা চুমু দেয়া সম্ভব না হওয়ায় ইশারায় অনেকেই চুমু দিয়ে থাকেন। এরপর হাজীরা পাথর ছোড়ার জন্য পুনরায় মিনায় জামারাতে যান। এজন্য অনেকে মিনার তাঁবুতে রাত যাপন করেন। অনেকে মক্কা থেকেও পাথর মারতে সরাসরি মিনার জামারায় গেছেন। পবিত্র মক্কা শরিফের মসজিদুল হারামের চত্বরের এক প্রান্ত থেকে এক পথ জামারার দিকে চলে গেছে। আবার ঘুরপথেও যাওয়া যায় জামারায়। অধিকাংশ পথই পাহাড়ের ভেতরে ট্যানেল করে তৈরি। এর ভেতরে রয়েছে পর্যাপ্ত আলো ও বাতাসের ব্যবস্থা। তবে বিকট শব্দের কারণে টানেলের ভেতর দিয়ে যাতায়াত অনেকের কাছে ছিল আতঙ্ক। তীব্র যানজটের কারণে একমুখী প্রতিটি সড়ক ও টানেলে ছিল হাজীদের ভিড়। হজ উপলক্ষে প্রতিটি গণপরিবহন সার্ভিস ১০ টাকার ভাড়া ৫০ টাকা করে আদায় করেছে। যানজটের অজুহাতে অনেক চালক গন্তব্যস্থলের আগে হাজীদের জোর করে অজানা-অচেনা পথে নামিয়ে দিয়েছে। ফলে পথ হারিয়ে দুর্ভোগের শিকার হন অনেক হাজী। এছাড়া ১০ মিনিটের পথ গাড়িতে পাড়ি দিতে সময় লেগেছে প্রায় দুই ঘণ্টা। গত শনিবার ১১ জিলহজ মিনায় গিয়ে হাজীরা যে যার মতো শয়তানের উদ্দেশে পাথর নিক্ষেপ করেন। মিনায় দুইদিন অবস্থান করে হাজীরা হজের অন্য আনুষঙ্গিক কাজ সেরে নেন। হাজীরা প্রতিদিন জামারায় তিনটি (ছোট, মধ্যম, বড়) শয়তানকে সাতটি করে পাথর নিক্ষেপ করেন। মিনা দোয়া কবুলের জায়গা বলে হাজীরা তাঁবুর ভেতরে এবাদত বন্দেগীসহ দোয়া-দরুদ পড়ে কাটিয়েছেন। মিনার কাজ শেষে আবার মক্কা শরিফে বিদায়ী তাওয়াফ করার পর হাজীরা রবিবার থেকে নিজ নিজ দেশে ফিরতে শুরু করেছেন। এজন্য এখন মক্কায় হাজীদের মধ্যে বিদায়ের সুর বাজছে। অন্যদিকে এর আগে যারা মদিনায় যাননি তারা এখন মদিনায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সেখানে হাজীরা ৪০ ওয়াক্ত নামাজ পড়বেন। এজন্য মদিনায় হাজীদের কমপক্ষে আট দিন অবস্থান করতে হবে। তবে অনেক হাজী মদিনায় না গিয়ে মক্কা থেকে জেদ্দা হয়ে সরাসরি দেশে ফিরতে শুরু করেছেন। হজ শেষ করার আগে ও পরে অনেকে মক্কা ও মদিনা থেকে পরিবার, স্বজন ও প্রিয়জনদের জন্য জায়নামাজ, টুপি, আতরসহ পছন্দের জিনিসপত্র কেনেন। রবিবার জেদ্দা থেকে ৩০৫ হাজী নিয়ে প্রথম ফিরতি হজ ফ্লাইট ঢাকা পৌঁছে। আগামী ২৮ অক্টোবরের মধ্যে বিমান সব বাংলাদেশী হাজীকে দেশে ফিরিয়ে আনবে।
×