ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২১ জুলাই ২০২৫, ৬ শ্রাবণ ১৪৩২

‘জিভ বের করা’ আইনস্টাইন: আইকনিক ছবিটির পেছনের গল্প

প্রকাশিত: ০৭:৪৫, ২১ জুলাই ২০২৫

‘জিভ বের করা’ আইনস্টাইন: আইকনিক ছবিটির পেছনের গল্প

ছবি: সংগৃহীত

১৯৫১ সালের ১৪ মার্চ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের ৭২তম জন্মদিন উদ্‌যাপন শেষে গাড়িতে বসে ছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন। সারা সন্ধ্যা সাংবাদিকদের অনুরোধে ছবি তুলছিলেন এই তাত্ত্বিক পদার্থবিদ। ঠিক তখনই ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনালের (UPI) আলোকচিত্রী আর্থার স্যাসে ক্যামেরা তাক করতেই আইনস্টাইন হঠাৎ করেই জিভ বের করে মুখভঙ্গি করেন।

এই হাস্যরসাত্মক ছবিটি পরে হয়ে ওঠে ২০শ শতকের অন্যতম আইকনিক প্রতিকৃতি। ছবিটি আইনস্টাইনের এতটাই পছন্দ হয়েছিল যে তিনি সেটির একাধিক কপি বানিয়ে বন্ধুদের উপহার দেন।

সংবাদ উপস্থাপক হাওয়ার্ড কে. স্মিথকে দেওয়া ছবির এক কপিতে আইনস্টাইন জার্মান ভাষায় লিখেছিলেন, ‘এই অঙ্গভঙ্গিটি তোমার পছন্দ হবে, কারণ এটি মানবজাতির প্রতি আমার বার্তা। একজন সাধারণ মানুষ যা করতে পারে, একজন কূটনীতিক তা কখনো সাহস করবে না।’

অন্য একটি কপিতে বন্ধু জোহানা ফ্যানটোভাকে লেখা ছিল, ‘আমার জিভ বের করা এই ছবিটি আমার রাজনৈতিক মনোভাবের প্রতিফলন।’

রাজনীতির পটভূমিতে আইনস্টাইনের প্রতিক্রিয়া

এই বার্তাগুলো মূলত তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রে চলমান ম্যাকার্থিবাদ ও কমিউনিস্ট ভীতি-চালিত সময়কালকে ইঙ্গিত করে, যেখানে বহু বিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবী ‘দেশবিরোধী’ কর্মকাণ্ডের অভিযোগে তদন্তের মুখে পড়েন।

আইনস্টাইন সেই সময় জে. রবার্ট ওপেনহাইমার-এর পক্ষেও সাফাই গেয়েছিলেন, যিনি মার্কিন সরকারের কাছ থেকে কমিউনিস্ট সন্দেহে কালো তালিকাভুক্ত হন। পরে ২০২৩ সালের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র Oppenheimer-এ সেই ইতিহাসের একাংশ চিত্রিত হয়।

কিন্তু খুব কম মানুষ জানেন, আইনস্টাইন নিজেও মার্কিন সরকারের নজরদারিতে ছিলেন। ১৯৩২ সাল থেকেই এফবিআই তাঁর ‘দেশবিরোধী’ কর্মকাণ্ডের সন্দেহে তদন্ত শুরু করে। মৃত্যুর সময় (১৯৫৫ সাল) পর্যন্ত তাঁর ওপর সংস্থাটির গোপন ফাইলের পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল ১,৪২৭।

বিজ্ঞান বনাম রাজনীতি: আইনস্টাইনের জীবনের চিরন্তন দ্বন্দ্ব

১৯৩০-এর দশকে নাৎসি জার্মানির ক্ষমতা দখলের পর একাধিক ইহুদি বিজ্ঞানীর সঙ্গে আমেরিকায় আশ্রয় নেন আইনস্টাইন। তখনই হিটলারের শাসনে তাঁর আপেক্ষিক তত্ত্বকে ‘ইহুদি বিকৃতি’ বলে প্রচার চালানো হয়েছিল।

যুক্তরাষ্ট্রে এসেও রক্ষা পাননি তিনি। বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন, সমাজতন্ত্রের প্রতি সমর্থন এবং পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণে সক্রিয় ভূমিকা রাখার কারণে দেশটির কিছু রাজনীতিক তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ ছিলেন। হাউস অন-আমেরিকান অ্যাকটিভিটিজ কমিটির সদস্য কংগ্রেসম্যান জন র‌্যাঙ্কিন ১৯৪৫ সালে বলেছিলেন, ‘আমেরিকানদের এখনই আইনস্টাইনের মুখোশ উন্মোচন করা উচিত। তার বিচার হওয়া দরকার।’

ছবির আড়ালে লুকিয়ে থাকা বার্তা

‘জিভ বের করা’ ছবি একদিকে যেমন ছিল মজার ও নির্মল, তেমনি তাতে ছিল এক স্বাধীন মনের প্রতিক্রিয়া। ছবির মূল সংস্করণে আইনস্টাইন বসে ছিলেন তার সহকর্মী ফ্রাঙ্ক আইডেলট এবং তাঁর স্ত্রী মেরি জেনেটের মাঝখানে। কিন্তু সবচেয়ে পরিচিত হয়ে ওঠা ছবিটি হলো সেই মূল ছবির ক্রপকৃত সংস্করণ, যেখানে শুধু আইনস্টাইনকে দেখা যায়।

ছবি: আইনস্টাইনের সঙ্গে সহকর্মী ফ্র্যাঙ্ক আইডেলট এবং আইডেলটের স্ত্রী মেরি জেনেট

ছবিটি আইনস্টাইনের বিদ্রোহী চেতনার প্রতীক হয়ে ওঠে, যে চেতনা তাকে জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে নীতি, রাজনীতি এবং কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে উৎসাহিত করেছিল। যেমনটা তিনি ১৯০১ সালে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘চিন্তাবিহীন কর্তৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধাই সত্যের সবচেয়ে বড় শত্রু।’

 

সূত্র: https://www.history.com/articles/einstein-tongue-photo

রাকিব

×