
বাইরে শ্রাবণের ধারা ঝরছে।
গ্রীষ্মের তীব্রতা শীতল হয়ে গেছে, আর এক টুকরো শান্তি এসে বসেছে নীলার ছোট্ট ঘরের জানালায়। জানালার কাঁচে বৃষ্টির ফোঁটাগুলি যেন রাত্রির দীর্ঘশ্বাস-ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ছে, একে একে। সারা দিন ধরে ঘরের কাঁচ জানালায় আঙুল রেখে বৃষ্টি গুনছে নীলা-যেন প্রতিটি ফোঁটা একটি স্মৃতি, একটি না বলা কথা। জানালার পাশে রাখা মাটির ছোট টবের গোলাপ গাছের পাতায় জমে থাকা জল ফুঁটানো ক্ষীণ আলোয় ঝলকাতে থাকে। বৃষ্টির শব্দে পুরানো দিনের একটি সুর বেজে ওঠে তার ভেতর-
“তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে...”
ঘরটা ছোট, নিঃসঙ্গ, অথচ বড় অদ্ভুতভাবে প্রশান্ত। টেবিলের কোণে রাখা ডায়েরি, যেখানে আছে তার জীবনের সমস্ত আত্মকথা, প্রতিটা পাতায় একটা করে অপেক্ষা। অপেক্ষা—না কেবল আরিয়ানকে ফিরে পাওয়ার জন্য, না শুধু পুরানো দিনের সঙ্গীকে ফিরে পেতে চাওয়ার জন্য, বরং তার নিজের আত্ম-অন্বেষণের জন্য। সেই দিনের মতো, আজও তার মনে হয়-আজ যেন সেই অপেক্ষার শেষ দিন।
নীলা জানে, একদিন শেষ হবে এই সব। আর শেষ হবে বলেই আজকাল মনে হয়, কিছুই যেন শেষ হয়নি কখনো।
আরিয়ান।
সে নামটা উচ্চারণ করলেই যেন বুকের ভেতরে কোথাও কেঁপে ওঠে এক বাতাস। যেমন অনেক বছর আগে প্রথম দেখা হয়েছিল তাদের-এক মনোরম বিকেলে। যখন প্রতিটি পদক্ষেপে ছিল এক অজানা আশাবাদ, আর আকাশে ঘনিয়ে উঠেছিল প্রেমের ছায়া। যখন আরিয়ান আর নীলা চলত বিশ্ববিদ্যালয়ের লাল ইটের পথে, আকাশের দিকে তাকিয়ে ভবিষ্যতের ছায়া আঁকত। আরিয়ান যখন কথা বলত, তার কণ্ঠে থাকত সমুদ্রের মতো গভীরতা, আর চোখে বিস্ময়ের মতো স্বপ্ন। নীলা সেই স্বপ্নে আশ্রয় নিয়েছিল-না কোনো শর্তে, না কোনো দাবি নিয়ে। শুধু ভালোবেসেছিল।
আরিয়ানের সঙ্গে নীলার সম্পর্কটা ছিল এক অদ্ভুত এক তরঙ্গের মতো। কখনো তা শান্ত, কখনো প্রবল। তারা একে অন্যকে নাম ধরে ডাকত না-আরিয়ান বলত “আকাশ”, আর নীলা বলত “নীল ফুল”। একে অন্যের চোখে হারিয়ে যেতে থাকত তারা। দু’জনের হৃদয় যেন একে অন্যের গোপন কনভেনশন। তাদের প্রেম ছিল কবিতার মতো-অস্পষ্ট, অথচ স্পষ্টের চেয়েও সত্য। ছিল প্রেমের মধ্যে গভীর শ্রদ্ধা-যেখানে কোনো অহংকার ছিল না, ছিল শুধুই একে অন্যকে হৃদয়ে মিশিয়ে নেওয়া।
তবে একদিন, তারা জানত, শেষ হতে পারে এই স্বপ্নের দিনগুলি-যতই মন না চায়, তবুও একদিন শেষ হতে হয়।
একদিন বিকেলে বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগেই খবরটা এলো-
আরিয়ানের পরিবার তার বিয়ে ঠিক করেছে, এবং সে রাজি হয়েছে। পরিবারের ইচ্ছের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস আর হয়নি তার। তার চেয়ে বড় দুঃখ, সে জানত না কীভাবে তার নিজের জীবনের সিদ্ধান্তগুলো নিজের হাতে নিতে হবে।
সে বলেছিল, “আমি দায়ী, নীলা। কিন্তু আমি বন্দি।”
নীলা তাকিয়ে ছিল-নীরব। তার চোখে জল ছিল না, ছিল এক গভীর প্রশ্রয়, যেন কোনো মা সন্তানের জন্য নিজেকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে, যাতে তার সন্তান মুক্তির পথ পায়।
“তুমি কি জানো, আমি কখনো তোমার মধ্যে শুধু প্রেমই খুঁজিনি, আমি তো খুঁজেছি এমন কিছু যা আমার নিজের আত্মাকে আশ্রয় দিতে পারে?”
নীলা শব্দগুলো উচ্চারণ করল, কিন্তু তার কণ্ঠে কোনোরকম অভিমান ছিল না। সেখানে ছিল এক অদৃশ্য শক্তি-শুধু বুঝতে পারা, শুধু নিজেকে জানা।
রাতে, জানালার পাশে বসে নীলা লিখেছিল সেই চিঠি-
ভালোবাসার নয়-ত্যাগের।
আহ্বানের নয়-আনুগত্যের।
“আরিয়ান,
তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি বলেই, তোমার সবচেয়ে আপন হয়ে উঠছি।
তুমি যা হতে চেয়েছিলে, তা হও-আমার ভালোবাসা তোমাকে থামাতে নয়, উড়িয়ে দিতে জানে।
যখন তোমার সন্তানের চোখে প্রথম তুমি নিজেকে দেখবে,
মনে পড়বে, আমি চেয়েছিলাম-তুমি এমন কোনো ভালোবাসার চিহ্ন রেখে যাও, যা শুধু তোমার নিজের নয়।
ভালো থেকো। আমার চোখে না, ঈশ্বরের আশীর্বাদে।
তোমার ‘নীল ফুল’।”
বছর পাঁচেক কেটে গেছে।
আরিয়ান এখন একজন সম্মানিত মানুষ-সাহিত্যিক, সমাজসেবী, এক সংবেদনশীল পিতা। নীলা তাকে দেখে দূর থেকে-কখনো টেলিভিশনের পর্দায়, কখনো প্রবন্ধে। সে খুশি হয়। কোনো ঈর্ষা নেই, কোনো হাহাকারও নয়। তবে হঠাৎ করে কোনো এক সুর, অথবা বৃষ্টির ফোঁটা-ফিরিয়ে আনে সেই পুরানো জানালার দিনগুলো।
নীলা জানে, তার ভালোবাসা ইতিহাস নয়, চিঠি নয়, কোনো দাবি নয়। সে নিজেই একটা প্রার্থনা, একটা কুয়াশা-যা কাছে আসে, ছুঁয়ে যায়, কিন্তু ধরা পড়ে না।
ভালোবাসা মানে তো শুধুই নিজের অভ্যন্তরের শান্তির সন্ধান। পূর্ণতার নয়, উপলব্ধির।
নিজের জীবনের অন্যতম ত্যাগ, সুন্দর মুহূর্ত-এই ছিল তার ভালোবাসা।
প্যানেল