
নকল পণ্য
যেদিকে হাত বাড়াবেন সেদিকেই পাবেন সব ধরনের নকল পণ্য। প্রসাধনী (কসমেটিক্স) শাড়ি, থ্রিপিস থেকে খাদ্যপণ্য কোনোকিছুই যেন আসল নয়, সব নকল। নিভিয়া লোশন, লাক্স, মাস্ক, এ্যাকুয়া মেরিন লোশন, ডাভ সাবান, ইম্পেরিয়াল সাবান, সুগন্ধির মধ্যে হুগো, ফেরারি, পয়জন, রয়েল, হ্যাভক, কোবরা সবই এখন ভেজাল আর নকলে ভরা। এই ভেজাল পণ্য এখন ঠাঁই করে নিয়েছে নামিদামি অনেক শপিং মলের দোকানে আর রূপচর্চার সেলুন বা পার্লারেও।
ইউনিলিভার, স্কয়ার টয়লেট্রিজ, কোহিনূর কেমিক্যালের পাশাপাশি আমদানি করা বড় বড় ব্র্যান্ডের পণ্য প্রকাশ্যে নকল করে বাজারজাত করছে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। এতে মূল প্রতিষ্ঠানের সুনামও নষ্ট হচ্ছে। ভ্যাট ও ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন সীমান্ত বিশেষ করে সিলেট ও কুমিল্লা দিয়ে ভারত থেকে আনা হচ্ছে এসব নকল পণ্য। আবার কিছু সুপরিচিত ব্র্যান্ড নকল করে দেশেই এসব পণ্য উৎপাদন করা হচ্ছে। নকল পণ্যের এই হাটবাজার খোদ ঢাকায়। পুরান ঢাকার চকবাজার, মৌলভীবাজার ও হাজী আনসার উল্লাহ প্লাজা যেন নকলপণ্যের হেড অফিস!
নকলপণ্যের আমদানিকারক, উৎপাদকারী ব্যবসায়ী এবং অসাধু পাইকার বিক্রেতারা সব সময় ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। কেউ এদের নাগাল পায় না। নকলপণ্য বিক্রি, আমদানি কিংবা উৎপাদনে জড়িত থাকার অভিযোগে দু’একজন অসাধু ব্যবসায়ী ও আমদানিকারক মাঝে মধ্যে গ্রেপ্তার হলেও আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে আবার বেরিয়ে এসে বীরদর্পে বাণিজ্যিক কর্মকা- পরিচালনা করেন। ফলে, যারা সৎ ব্যবসায়ী তারা আছেন চাপের মুখে। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখা কষ্টকর হয়ে পড়ছে।
ভালোমানের পণ্য আমদানিতে তারা সঠিকভ্যাবে সরকারকে ভ্যাট ও ট্যাক্স দিচ্ছেন। ফলে, ভালো পণ্যের দামও একটু বেশি। কিন্তু নকলের হাটবাজারে কমদামি পণ্যেরই বেশি চাহিদা ও কাটতি। এতে করে অসৎ ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে এখন অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠছে। এ অবস্থায় পুরান ঢাকার এসব পাইকারি বাজার থেকে নকলপণ্য জব্দ, অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার এবং কর ও ভ্যাট ফাঁকিবাজ ব্যবসায়ীদের দ্রুত করের আওতায় আনার তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
ব্যবসা-বাণিজ্য সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, নকল পণ্য তৈরির ‘হেড অফিস’ বলা হয় পুরান ঢাকার চকবাজার এলাকাকে। থানা-পুলিশ, বিএসটিআইর কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করেই বছরের পর বছর ধরে চকবাজার ও আশপাশ এলাকায় বিভিন্ন এলাকার মার্কেকেট এসব নকলপণ্য বিক্রি ও বাজারজাতকরণ হয়। এক শ্রেণির প্রতারক ব্যবসায়ীরা নানা নামে স্থান বদল করে এই ব্যবসা পরিচালনা করছেন। কেউবা প্রকাশ্যেই দোকানখুলে পাইকারি দরে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে নকলপণ্য বিক্রি করছেন।
এতে করে ভোক্তারাও ঠকছেন। তবে যে ব্যবসায়ীরা নকলপণ্য আমদানি ও বাজারজাতকরণ করছে, তাদের দিকে নজরদারি বাড়িয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এছাড়া জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর থেকেও নকলপণ্য আমদানি, বাজারজাতকরণ এবং উৎপাদনের বিষয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। এদিকে, চকবাজার ও মৌলভীবাজারের একাধিক ব্যবসায়ী অভিযোগ করেছেন আসাদ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আসাদ সেখ দীর্ঘদিন ধরে ভারত থেকে অবৈধ পথে নকল কসমেটিক্স, শাড়ি ও থ্রিপিস আমদানি করে বাজারজাতকরণ করছে।
মূলত ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের একাধিক নেতার সঙ্গে আত্মীয়তা এবং ব্যক্তিগত সম্পর্ক করে তিনি পুরো পুরান ঢাকাকে নকলপণ্যের বাজার বানিয়েছেন। ভ্যাট ও ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে সম্পত্তির পাহাড় বানিয়েছেন। ইতোমধ্যে তিনি একাধিক, প্লট, ফ্ল্যাট ও বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে- একজন চা বিক্রেতা থেকে তিনি এখন শিল্পপতি বনে গেছেন। ইতোপূর্বে ২০১৮ সালে তার বিরুদ্ধে র্যাবের অভিযান পরিচালনা করা হলেও ওই সময় তাকে না পেয়ে শ্যালককে গ্রেপ্তার করা হয়।
কিন্তু কিছুদিন পরই সেও জামিনে বের হয়ে আসে বাণিজ্যিক কর্মকান্ড পরিচালনা করছে। একই সঙ্গে যারা সৎ ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা তাদের পণ্য বিক্রি করতে পারছে না। অনেকেই ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন। তবে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও আসাদ সেখ ফোনটি রিসিভ করেননি। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কসমেটিক্স অ্যান্ড টয়লেট্রিজ ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, পুরান ঢাকায় নকলপণ্যের বড় বাজার এটি এখন প্রায় স্বীকৃত।
এতে করে এখানকার সৎ ও ভালো ব্যবসায়ীরা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। বর্তমান সরকার অসৎ ব্যবসায়ী ও নকল পণ্যের আমদানিকারকদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে এ সংকটের সমাধান হবে। অন্যথায় ভালো ব্যবসায়ীরা ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হবেন। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে জানান, নকলপণ্য আমদানি ও বাজারজাতকরণ করে যারা ভোক্তাদের ঠকাচ্ছে তাদের কোন ছাড় নয়। এদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান পরিচালনা করে আইনের আওতায় আনা হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ ব্যাপারে কাউকে ছাড় দিবে না।